বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ প্রশ্নে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক এবং চিন্তা-চেতনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উল্লেখ্য যে, এক্ষেত্রে উভয়পক্ষের মধ্যে অলিখিত সমঝোতা আছে। আবার কখনো কখনো দুটি পক্ষের মধ্যে মতভেদও দেখা দেয়। আশার কথা মতভেদগুলো কখনো তাদের মধ্যে কঠিন ফাটল ধরানোর মতো অবস্থা তৈরি করে না। সেই সুবাদে মতভেদগুলোও উভয় পক্ষের চিন্তা-ভাবনাগুলোকে এক অর্থে ইতিবাচক বলা যায়। যদিও রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু কিছু বক্তব্য শুনে মনে হতে পারে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সমাজের মধ্যে দূরত্বটা বাড়ছে।
আসলে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এমনটা হতেই পারে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সমাজের নেয়া রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলো অন্ধভাবে রাজনৈতিক দলগুলো সবই গ্রহণ করেনি। এটা যেমন সত্য, অন্যদিকে দলগুলোকে কখনো কখনো বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সমাজের গৃহীত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কঠিণ ভাষা প্রয়োগ করতেও দেখা গেছে। এরপরও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রয়োজনীয়তা এবং তাদের সমর্থনের কথা প্রকাশ করতেও সামান্য কুণ্ঠাবোধ করেনি রাজনৈতিক দলগুলো। এটাই হচ্ছে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের গৃহীত পদক্ষেপগুলো এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করলে মনে হতে পারে, কোথাও কোথাও পরিপক্কতার ঘাটতি আছে। যেমন রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ বা পদত্যাগে বাধ্য করার প্রশ্নে ছাত্ররা যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলো রাজনৈতিক দলগুলো তাকে গ্রহণযোগ্য মনে করেনি। সরাসরি তারা এ থেকে বিরত থাকার জন্য ছাত্রদের প্রতি আহ্বান জানায়। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, এতে করে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হবে।
ছাত্র সমাজ তাদের লক্ষ্য অর্জনে আন্দোলনেও নেমে গিয়েছিল। তারা বঙ্গভবনের সামনে ছাত্র জমায়েতের আয়োজন করেছিল। এত বড় একটা সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়ায় তারা কিছুটা সময় নেয়। সম্ভবত বিএনপিই প্রথম তাদের প্রতিক্রিয়ায় রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক শূন্যতার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। ছাত্ররা তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয়। ছাত্রদের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাতে হয়। তারা প্রমাণ করেছে, অন্যকে শ্রদ্ধা জানানোও রাজনীতির অংশ। তবে বিএনপির মতামতকে সম্মান জানালেও তারা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়টি থেকে সরে আসেনি।
বরং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী থেকে উপদেষ্টা হওয়া মাহফুজ আলমকে বলতে শোনা যায়-১দফাতেই সংবিধান ও সরকার বাতিলের নির্দেশনা রয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির বিদায়ে সংবিধান কিংবা রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হবে না। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে যায়-একটি সংবাদ দেখে। অতি সম্প্রতি একটি সংবাদ হয়েছে, এই সরকারের বৈধতা নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না এমন বিধান রেখে একটি অধ্যাদেশ জারি হতে যাচ্ছে। এই অধ্যাদেশ জারি হওয়ার পর সরকারের সিদ্ধান্তসমূহও আইনগত ন্যায্যতা পাবে। ফলে রাষ্ট্রপতি কিংবা সাংবিধানিক যে বাধ্যবাদকতাগুলো রয়েছে সেগুলোও দূর হবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না ঐকমত্যই হচ্ছে প্রধান বিষয়। যদি উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। নির্বাচন, নির্বাচন কমিশনসহ অন্য সংস্কার কমিশনের কাজের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পৃক্ততার বিষয়টিও আলোচনায় আসা উচিত। এই মুহূর্তে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে সেগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পৃক্ততা যত বেশি থাকবে ততই বিতর্ক এড়ানো সম্ভব হবে। শুধু বিতর্ক এড়ানোই নয় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনেও ভূমিকা রাখবে। সেক্ষেত্রে সংস্কার কমিশনগুলোর কিছু বক্তব্য এই ভাবনার বিপরীত মনে হয়।
যতটা মনে আসে নির্বাচন সংক্রান্ত সংস্কার কমিশনই বলেছিল তারা প্রস্তাব তৈরিকালে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনো আলোচনা করবে না। এধরনের সিদ্ধান্ত আসলে কাজের গতি কমিয়ে দেবে। একসময় যে সংস্কার প্রস্তাবগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনের প্রয়োজন হবে। এটা স্বাভাবিক বিষয়। কারণ তারাই সংস্কার কর্মসূচিকে বাস্তবায়নে নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। তাই কাজটি প্রস্তাব বা কর্মসূচি তৈরির সময়ই যদি রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেয়া হতো তাহলে কাজের গতি বৃদ্ধি পেতো। সম্পূর্ণ সংস্কার প্রস্তাবনা তৈরির পর তা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে উপস্থাপন করা হলে সময় নষ্ট হবেই। কারণ তারা যদি কোনো বিষয়ে সন্তোষ্ট না হন তাহলে সেটা আবার সংস্কার কমিশনের কাছে যাবে। কিংবা সরকারকে তা সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে। এবং সেসময় যা গৃহীত হবে তাকে আইনের তুল্য হিসেবে গণ্য করতে হবে।
বিশেষ করে সংবিধান বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। সংবিধানে সরকার পদ্ধতির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়েও কথা আসে। এ নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের মতপার্থক্য বিস্তর। সংস্কার কমিশন এবং সরকারের ঘনিষ্ঠজন চাইছেন সংবিধান পুনর্লিখন করা হবে এবং সেই অনুযায়ী তারা কাজ করছেন বলেও বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় সবাই বলছে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এখানেও দুটি পক্ষের অবস্থান অনড় বলেই প্রতীয়মান হয়। সরকারকে এই বিষয়ে মতৈক্য সৃষ্টিতে ভূমিকা নিতে হবে।
সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্ক আলোচনার পাশাপাশি সরকারের সঙ্গে বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের সম্পর্কও দেখার বিষয়। অতি সম্প্রতি উপদেষ্টা পরিষদের আকার বাড়ানো হয়েছে। এ নিয়ে সরকার ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের মতভেদ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।উপদেষ্টা নিয়োগ বিষয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের কেউ কেউ প্রথমই আপত্তি জানিয়েছিলো আলী ইমাম মজুমদারকে নিয়োগ করার সময়।
তিনি সরকারের সাবেক সচিব এবং প্রশাসনিক কাজে দক্ষ মানুষ। পেশাগত প্রয়োজনে তাকে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হতে দেখা গেছে। অন্যদিকে একজন কলাম লেখক হিসেবে ওই সময় তিনি প্রথম আলো পত্রিকায় যেসব মত প্রকাশ করেছিলেন, সেগুলো ওই সময়ের সরকারের বিরুদ্ধ মত হিসেবেও প্রমাণিত। তারপরও বেষম্য বিরোধী ছাত্ররা তার নিয়োগে আপত্তি জানিয়েছিলো।
সর্বশেষ উপদেষ্টা পরিষদের আকার বৃদ্ধিকালে সেখ বশির উদ্দীন ও চিত্র পরিচালক মুস্তফা সারওয়ার ফারুকীর নিয়োগ বিষয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সমাজ ও সরকারের মধ্যে দূরত্ব প্রকাশ হয়েছে একটু বেশিই। ছাত্রদের দাবি বশির সাহেব আওয়ামী ঘরানার মানুষ এবং আওয়ামী লীগের গুণগ্রাহী মানুষ। অন্যদিকে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে প্রকাশ্যে সমর্থনদানকারী ফারুকী সাহেবের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী এবং আওয়ামী লীগের মানুষ। এই নিয়োগ নিয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্ররা বিক্ষোভ সমাবেশও করেছে। তারা প্রশ্ন করেছে উপদেষ্টা নিয়োগকালে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করছে না সরকার। যে কারণে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্পিরিটের বিরুদ্ধে কাজ হচ্ছে।
এ নিয়ে নানা বিতর্ক-বিশ্লেষণ হতে পারে। কারণ বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের প্রতিনিধি সরকারেও আছে। এমনকি সরকারের নীতি নির্ধারণকারীদের মধ্যেও তাদের প্রতিনিধিত্ব আছে। এমন অবস্থায় সরকার যদি কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সেখানে ওই প্রতিনিধিদের সম্মতি আছে বলেই মনে করতে হবে।
এমতাবস্থায় সরকারের উচিত প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করা। সম্মিলিত প্রয়াসই পারে সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে। ভুলত্রুটি এড়িয়ে লক্ষ্য অর্জনেও সহায়ক হতে পারে পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি মাধ্যমে।
লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
এইচআর/এমএস