বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে সরকারি-বেসরকারি কোম্পানিগুলোর পাওনা ৩৭ হাজার ৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৩৭ হাজার ৭০ কোটি টাকা দেনায় পড়েছে পিডিবি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিল পাবে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র বা আইপিপি। তাদের পাওনা ২১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া পিডিবির কাছে গ্যাস বিল বাকি ১১ হাজার ২৫ কোটি টাকা। এ পরিস্থিতিতে বকেয়া পরিশোধে জরুরি ভিত্তিতে ৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ফাওজুল কবীর খান যুগান্তরকে বলেন, বকেয়া পরিশোধে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পিডিবির তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে দেখা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়মেই অন্তর্বর্তী সরকার ভারত এবং আদানি থেকে বিদ্যুৎ কিনছে। বিগত সরকারের সময়ে ভারতের কাছে যে পরিমাণ অর্থ বকেয়া বিল ছিল, তা অনেক কমিয়ে এনেছে বর্তমান সরকার। তবে বকেয়া বেড়েছে আইপিপিগুলোর।
পিডিবির এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে ভারত বিদ্যুৎ বিক্রির বকেয়া বিল পেত ২ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। তবে ২০২৫ সালের ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির এক টাকাও বকেয়া নেই। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বর্তমান সরকার ভারত ও আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিল বাবদ ২ বিলিয়ন ২৩৭ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে।
অন্যদিকে ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত ভারতের আদানির থেকে বিদ্যুৎ কেনার বকেয়া বিল ছিল (বিলম্ব সারচার্জসহ) ৫ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। বর্তমান সরকার সেই বিল নামিয়ে এনেছে মাত্র ৮৮৫ কোটি টাকায়। যদিও আদানির কর্মকর্তারা এ দাবি মানতে নারাজ। তারা জানিয়েছেন, কয়লার দাম নিয়ে সরকারের সঙ্গে চরম বিরোধ আছে। পিডিবির কাছে তাদের পাওনা দাবি ৩০ কোটি ডলারেরও বেশি। ভারত সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ভেড়ামারা দিয়ে আমদানি হয় ১ হাজার মেগাওয়াট, ত্রিপুরা থেকে বেসরকারিভাবে ১৬০ মেগাওয়াট এবং নেপাল থেকে ভারত হয়ে আসে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
এদিকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত পিডিবির কাছে আইপিপিগুলোর পাওনা ছিল ১৮ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর সংগঠন বিপ্পার সভাপতি ডেভিড হাসনাত সোমবার যুগান্তরকে বলেন, আগের সরকার (আ.লীগ সরকার) আমলে আদানি বা ভারতীয়রা তেমন চাপ দিত না। এ সরকার আমলে চাপ দিয়ে অনেক বকেয়া আদায় করে নিয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো তেমন কোনো বিল পাচ্ছে না। অনেক কোম্পানি ব্যাংকের দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, পিডিবির কাছে ৩৭ হাজার ৭০ কোটি টাকার বিল নিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবীর খানের সভাপতিত্বে সম্প্রতি এক বৈঠক হয়। সেখানে বিদ্যুৎ খাতের সব দিক আলোচনায় আসে। বৈঠকে বলা হয়, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন। এর আগে বকেয়া বিল পরিশোধ না করলে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে বিদ্যুৎ নিয়ে বিপাকে পড়তে পারে। কারণ মার্চ-এপ্রিল থেকেই শুষ্ক মৌসুম শুরু হবে। তখন বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়বে অনেক। শীতকালে পিক আওয়ারে ১০ থেকে ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হলেও শুষ্ক মৌসুমে চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে ১৬ থেকে ১৭ হাজার মেগাওয়াটে।
সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চেষ্টা থাকলেও বেশ কয়েকটি কারণে এ সরকার বকেয়ার পরিমাণ কমাতে পারেনি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-দুটি বৃহৎ আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ কিনে লোকসানের টাকা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ভর্তুকি না দেওয়া। যার পরিমাণ ৪ হাজার কোটি টাকা। শিগগিরই অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে এ টাকা দাবি জানাতে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
জানা গেছে, পিডিবির কাছে ৩৭ হাজার কোটি টাকা পাওনার মধ্যে আদানি ও আইপিপি ছাড়াও পেট্রোবাংলার গ্যাস বিল বকেয়া ১১ হাজার ২৫ কোটি টাকা। যা বিগত সরকার আমলে ছিল ১৭ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। সরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র বিল পাবে ৩ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা। যা বিগত সরকার আমলে ছিল ৫ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। আগের সরকারের আমলে গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) হুইলিং চার্জ ছিল ৪৭৮ কোটি টাকা। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৮৬ কোটি টাকা।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর চলতি বছরের ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পিডিবি বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য বিল বাবদ পরিশোধ করেছে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৯৫ কোটি টাকা। পিডিবি জানিয়েছে, গ্যাসের চাপ কমার কারণে কয়লা এবং তেলের প্ল্যান্ট বেশি চালাতে হচ্ছে। এতে করে অতিরিক্ত বিল ৪ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা দিতে হচ্ছে। এছাড়া ফার্নেস অয়েল ও ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে বকেয়ার স্তূপ বাড়ছে। সরকারি কর্মকর্তারা জানান, প্রতিবছর ৭ শতাংশ করে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু সেই পরিমাণে বিদ্যুতের ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে না। গত অর্থবছরে পিডিবি ভর্তুকি পেয়েছে মাত্র ৩৮ হাজার কোটি টাকা। অথচ বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রির কারণে পিডিবির লোকসান হয়েছে ৫৫ হাজার কোটি টাকা।
জানা গেছে, গত ২০২২-২০২৩, ২০২৩-২০২৪ এবং ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে ভর্তুকির বাইরে পিডিবি লোকসান দিয়েছে ৩৬ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। এ বিপুল লোকসানের ঘাটতি কোনোভাবেই মেটানো যাচ্ছে না। পিডিবির হিসাবে এখন গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ক্রয়মূল্য প্রতি ইউনিট ১১ টাকা ৮৩ পয়সা। আর বিতরণ কোম্পানি পর্যন্ত সরবরাহ দিলে খরচ দাঁড়ায় প্রতি ইউনিট ১২ টাকা ৩৫ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে ঘাটতি ৬ টাকা ৬৩ পয়সা। এর মানে হচ্ছে, প্রতি ইউনিটে পিডিবি লোকসান দিচ্ছে ৫ টাকা ৭২ পয়সা।
যদিও পিডিবি মনে করে, গত প্রায় দেড় বছরে পিডিবি বিভিন্নভাবে ৮৯৮ কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পেরেছে। যার মধ্যে ফার্নেস অয়েল আমদানিতে সারচার্জ ৯ থেকে ৫ শতাংশ কমানোয় সাশ্রয় হয়েছে ৩৪৮ কোটি টাকা এবং আদানির বিল একসঙ্গে পরিশোধ করায় তারা বিল ছাড় দিয়েছে (ডিসকাউন্ট) ২৪৪ কোটি টাকা।