নূরুন্নাহার নীরু
একটি বিয়ের দাওয়াতে পাবনা যাওয়ার সুযোগ পেয়ে মন দুলে উঠল। দিনটি ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি। ইবনে সিনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত রেডিওগ্রাফার রফিকুল ইসলামের বিয়ের দাওয়াত। তাদের আদর্শিক নেতা ডা: জলিল সাহেবকে তারা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে দেখে থাকে। ঠিক হলো গোটা স্টাফের সাথে জলিল দম্পতিও যাবে। দারুণ চার্মিং! একে তো দেশ ঘোরার নেশা তার ওপর পাবনা! যেখানে শুয়ে আছেন মর্দে মুজাহিদ শহীদ মতিউর রহমান নিজামী। এ সুযোগও ছাড়া যায়? তড়িঘড়ি অনলাইনে অর্ডার করে একটি ব্যাগ কিনে নিলাম নববধূর গিফট হিসেবে। সকাল সাড়ে ৬টায় ইবনে সিনা মেডিক্যাল কলেজ, কল্যাণপুরের গেট থেকে একটি মাইক্রোবাসে আমরা ক’টি পরিবার একত্রিত হলাম। গাড়ি ছাড়ল যথারীতি। আব্দুল্লাহপুর থেকে আরো তিনজন সঙ্গী হলেন। গোলাম মাওলা, মোশাররফ হোসেন, সোহেল হাওলাদারসহ সঙ্গী আরো ছয়জন মোট আমরা ১১ জন। খুবই মজার মানুষ যারা। সারা রাস্তা খুনসুঁটি আর মজাদার গল্পে এগোচ্ছিল গাড়িটি। আমরা খুব উপভোগ করছিলাম।
আমাদের বিয়ে বাড়ি ছিল ঈশ্বরদী। কাছাকাছি গিয়ে একটি জামে মসজিদে পুরুষরা সবাই জুমা পড়ে নিলেন। অবশেষে গাড়ি কিছুদূর যেতেই সেই মাহেন্দ্রণ- বিয়ে বাড়িতে উপস্থিতি। মোড় থেকেই অপেমান দুটো বাইক পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল অনুষ্ঠানস্থলে। আমরা গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে আসা নারীদের সাথে অন্দরমহলে ঢুকলাম। আর পুরুষরা সাজানো প্যান্ডেলের নিচে গিয়ে বসলেন। বহুদিন পর গ্রামের বিয়ে দেখা। এটিও ছিল আমার ভ্রমণের আরেকটি উদ্দেশ্য, অর্থাৎ- গ্রামীণ বিয়ে উপভোগ করা। বিশেষ করে ঘরে পাতা দধির সমাহার। যার সাথে লেগে থাকে সযতেœ হাতের আন্তরিক ছোঁয়া। অবশেষে খাবার পালা। পুরুষরা সাজানো প্যান্ডেলে আর আমরা মহিলারা অন্দরমহলে খুবই স্বাধীনভাবে আয়েশ করে খেয়ে উঠলাম।
বিকেল ৪টায় আমরা আবার মাইক্রোতে উঠে বসলাম। আন্তরিক হৃদ্যতার মাঝে বিদায় নিয়ে ফিরছি আমরা। উদ্দেশ্য কয়েকটি স্থান পরিদর্শন শেষে ঢাকা ফেরা। খুব কাছে হওয়ায় প্রথমেই যাওয়া হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে। সত্যিই দর্শনীয় বিষয়। কিন্তু যখনি দেশের সার্বভৌমত্বের কথা মনে হলো- মুষড়ে গেল হৃদয়টা! হায়রে উন্নয়ন! উন্নয়নের নামে কত লোটপাট, কত জালিয়াতি- এ যেন এক টাকা রোজগারের চরম খেলা শুরু হয়ে গিয়েছিল ছোট্ট বদ্বীপটাকে ছিঁড়ে-ফেঁড়ে। ফ্যাসিবাদের হাত থেকে রেহাই দিয়েছেন আল্লাহ! এবার রেহাই চাই ঘরে-বাইরে সব ষড়যন্ত্র থেকে। অনেক বিতর্কিত এই প্রকল্প কতটা সুফল বয়ে আনবে দেশ ও জাতির জন্য তা সময়ই বলে দেবে।
হঠাৎ ট্রেনের শব্দে সম্বিৎ ফিরতেই শুনছি সবাই সমস্বরে বলছে, ‘এই তো সেই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ!’ হার্ডিঞ্জ ব্রিজ! স্বপ্নের ব্রিজ! কালের সাী সেই ব্রিজ! একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যে ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে গেরিলারা পাকহানাদের থেকে এ অঞ্চলকে রেহাই দিয়েছিল। ছোটবেলায় কী হারেই না মুখস্ত করেছিলাম : কে তৈরি করেছেন? কত সালে তৈরি? দৈর্ঘ্য-েপ্রস্থে কত? ইত্যাদি। সেই ব্রিজ আজ এই বয়সে চাক্ষুস দেখছি! এ প্রজন্ম কি জানে এর ইতিহাস? হার্ডিঞ্জ ব্রিজ তৈরি হয়েছিল ১৯০৯-১৯১৫, এর দৈর্ঘ্য এক হাজার ৭৯৮.৩২ মিটার বা পাঁচ হাজার ৮৯৪ ফুট বা ১.৮ কিলোমিটার। এটি বাংলাদেশের সর্ব দীর্ঘ রেলসেতু। এর নির্মাতা ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যার রবার্ট গেইলস তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের নামানুসারে নামকরণ করে নির্মাণ করেন। এটি পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী থেকে কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলা পর্যন্ত যুক্তকারী পদ্মা নদীর উপরে একটি রেলসেতু। এর ওপর দুটো ব্রডগেজ রেললাইন রয়েছে।
ততণে ব্রিজের নিচে চলে এসেছি। গাড়ি থেকে নেমে সবাই লাফিয়ে লাফিয়ে রাস্তা থেকে অনেক দূর নিচে নেমে গেল। একজনের সহযোগিতায় আমিও ধীরে সুস্থেই নামলাম। তাকিয়ে দেখি ও পাশের সিঁড়ি ভেঙে অনেকের সাথে সাহেবও নামছেন বেশ সহজে। ফেরার পথে আমিও ওই সিঁড়ি বেয়েই উঠেছি- যেন পাহাড় ভেঙে উঠছি। নিচে পুরোটাই চর। বিশাল এলাকা। এ বালুচরের শেষ প্রান্তে নদী। মরে যেতে বসা পদ্মা নদী। অথচ এখানে আনন্দ গোসলে নেমে কত মৃত্যু হলো যা প্রায়শই পত্রিকায় দেখে থাকি। অদূরেই তাকিয়ে দেখলাম লালন শাহ ব্রিজ! বলা যায়, একই সাথে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ ব্রিজ এক দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যের অবতারণা করে রেখেছে যা অনায়াসে একই ফ্রেমে বন্দী করা যায়।
রাস্তা থেকে নিচে নেমে বেশ ভালো লাগছিল খোলা শীতল বাতাসে। বিশাল বালুচর। প্রচুর পর্যটক। বাঙালির বিলাসিতায় ভাটা নেই- না হলো এটি কুয়াকাটা। আগত যুগল অথবা পরিবার অথবা বন্ধু-বান্ধব কিংবা দলবাঁধা রমণীদের ঝাঁক চোখে পড়ার মতো। রমণীদের ওমন ঝাঁকানাকা সাজ কেন? মনে করতেই মনে হলো : ওহ, সেই বিশেষ দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি। যাকে বিশ্ব বেহায়া দিবস বলা যায়। তবে ভাগ্যিস অশ্লীল কিছু চোখে পড়েনি। তবে হ্যাঁ, চোখে পড়ে গেল সেই একই সমান্তরালে দেখা বিশেষ তিনটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। সবাই ছবি নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সাদা রঙের লালন সাঁই ব্রিজটি। কুষ্টিয়ার বিখ্যাত বাউল সম্রাট লালন শাহের নামানুসারে পদ্মার উপরেই নির্মিত এ ব্রিজের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৮০০ মিটার। এটি পদ্মা বহুমুখী সেতু ও যমুনা সেতুর পরই তৃতীয় দীর্ঘতম সেতু। এটি চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড দ্বারা ২০০৪ সালে নির্মিত হয়েছিল।
আমরা ফিরে চললাম পাবনা শহরের দিকে, পাশেই একটি সুন্দর মসজিদে আসর পড়ে। শহরের দিকে যেতে যেতে এবং ঢুকেও বেশ কিছু মনোরম বিষয়াদি চোখে পড়ল। চোখে পড়ল পাবনা মেডিক্যাল কলেজও। একেবারেই নতুন! শহরের বেশ কিছু শিাপ্রতিষ্ঠান দেখার মতো যা তৈরি হয়েছে বা ওয়াক্ফ করে গেছেন স্বনামধন্য এমপি মাওলানা আব্দুস সোবহান। যার নাম আমার স্বামীর মুখে অনেক শুনেছি।
সাঁথিয়ায় পৌঁছুতে পৌঁছুতে রাত সাড়ে ৮টা বেজে গেল। গাড়ি এসে থামল সোজা মনমথপুর লেখা সাইনবোর্ডটির মুখোমুখি হয়ে। পুরুষরা নেমে গেল কবর জিয়ারতে। আমি যতটুকু সম্ভব ফাতিহা পাঠ ও দোয়া করলাম। ডুবে গেলাম কতশত স্মৃতিতে। এই সেই মর্দে মুজাহিদ- কত শীতল হয়ে ঘুমিয়ে আছেন অন্ধকার এই ঘুটঘুটে ছায়াতলে। একদিন আমাকেও ফেলে রেখে আসা হবে এমন কোনো স্থানে। কিন্তু কত পার্থক্য! উনি আজ বিজয়ী! দুনিয়া-আখিরাতে। শহীদের মর্যাদায় ভূষিত। দুনিয়াতেও ছিলেন তাকওয়াধারী হয়ে। একজন মন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও যার চরিত্রে এতটুকু কালিমা মাখার সাধ্য কারো হয়নি। সেই নিরপরাধ মানুষটিকেও ফ্যাসিবাদীরা যুদ্ধাপরাধী সাজিয়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে প্রহসনের বিচার করেছে। কবর তো ওদেরও হবে। তাই তো মরহুমা পার্লামেন্টারিয়ান হাফেজা আসমা খাতুন তার লেখা বই ‘আমার স্মৃতিকথায়’ লিখে গেছেন- ‘জামায়াতে ইসলামীর নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেব ১০ বছর পার্লামেন্টের মেম্বার ছিলেন, পাঁচ বছর মন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি যুদ্ধাপরাধী ছিলেন না। অথচ ২০১১-১২ সালে হঠাৎ কিভাবে যুদ্ধাপরাধী হয়ে গেলেন?’ (২৮-২৯) তিনি আরো লিখেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা-মাতা সবাই কবরে। আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন, ‘মানুষের মৃত্যুর পর তার সব কর্মমতা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু কবরে শুয়ে শুয়ে মৃত ব্যক্তিরা তিনটি কাজে পুণ্য পেতে থাকে। তার মধ্যে অন্যতম হলো- রেখে যাওয়া সৎ সন্তানের দোয়া!’ মহীয়সী হাফেজা আসমা খাতুন স্পষ্ট ইঙ্গিত করে গেলেন, এক দিন এই কবরে সবাই ঢুকবে কিন্তু তার রেখে যাওয়া কৃতকর্ম কী রেখে যাচ্ছে তাই উপলব্ধির বিষয়। সত্যিই একজন মুসলিম হিসেবে কবর জিয়ারত এক অনাবিল অনুপ্রেরণার অনুভূতি হয়েই যেন সবাইকে আপ্লুত করে দিলো সেই ভ্রমণটি। কিছু গভীর উপলব্ধি নিয়ে ফিরে চললাম আমরা অস্থায়ী দুনিয়াবি গন্তব্যে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক, প্রাথমিক ও গণশিা অধিদফতর, ঢাকা