জিদান ইউসুফ ইসলাম। বয়স চার বছর। প্রায় চার মাস হলো লিডসের হিয়ার হিলস প্রাইমারি স্কুলের নার্সারিতে ভর্তি হয়েছে। স্কুলে যেতে তার কাঁধে নেই কোনো বইয়ের বোঝা। মা-বাবা শুধু টিফিন সঙ্গে করে স্কুলে দিয়ে আসেন। বাকি দায়িত্ব স্কুলের শিক্ষকদের। জিদানের বাসায় নেই কোনো বইখাতা। স্কুলেই ড্রয়িং, খেলাধুলা আর নানা বিনোদনে ব্যস্ত জিদান। তার কাছে স্কুল শুধুই বিনোদনের ক্ষেত্র।

জিদানের মা বেগম শামসুন্নাহার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘জিদান বাসায় থাকতে চায় না। কখন স্কুলে নিয়ে যাব সেই অপেক্ষায় থাকে। বাসায় কোনো পড়াশোনা নেই। স্কুলের শিক্ষকরাই তার সব। স্কুলে এমন এক পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, পুরো স্কুলই যেন একটি শিশুপার্ক।

শুধু লিডসের হিয়ার হিলস প্রাইমারি স্কুলই নয়, যুক্তরাজ্যের সব স্কুলেরই একই চিত্র। বিনোদনের মাধ্যমেই পড়াশোনা করে শিক্ষার্থীরা। শিশুরাও স্কুলে যাওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকে। অভিভাবকরা কোনো দিন স্কুলে নিতে না চাইলে বাচ্চারা কান্নাকাটি করে। স্কুলের শিক্ষকদের কাছে যেতে মরিয়া হয়ে ওঠে শিশুরা।

অভিভাবক ও স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,  শিশু-কিশোরদের নার্সারি থেকে ইয়ার সিক্স পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেই। শুধু শিক্ষার্থীদের আচার-আচরণ, উপস্থিত বুদ্ধি, খেলাধুলা, বিশেষ কোনো গুণাবলি থাকলে বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে তাদের মেধা যাচাই করা হয়। পুঁথিগত বিদ্যা নয়, বাস্তবিক জ্ঞানকেই গুরুত্ব দেওয়া হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। 

লন্ডনের গ্যাংস হিল প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র আদিয়ান। সে ওই স্কুলের ইয়ার ফাইভে (পঞ্চম) পড়াশোনা করে। তার বাসায় বা বাইরে কোথাও প্রাইভেট পড়তে হয় না। আদিয়ানের বাবা শাহ নূরুল আলম জানান, একদিন আদিয়ান সামান্য জ্বরসর্দি অনুভব করে। আমরা তাকে স্কুলে যেতে নিষেধ করি। এ সময় সে কান্নাকাটি শুরু করে। পরে শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আদিয়ানকে স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দিনভর শিক্ষকরা আদিয়ানের সেবাযত্ন করে সন্ধ্যায় যখন বাসায় পাঠান, তখন সে পুরোপুরি সুস্থ। শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্কুলে পড়ুয়া প্রত্যেক বাচ্চাকে তারা সমান দৃষ্টিতে দেখেন। এখানে ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু, সাদা-কালো বলে মেধার মানদন্ডে কোনো বিভাজন করা হয় না। বিদ্যালয়ের স্লোগান হলো- ‘হয়ার এভরি চাইল্ড কাউন্টস’ অর্থাৎ সব শিশুকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। কোনো শিশু যদি মনে হয় পিছিয়ে পড়ছে, তার জন্য অতিরিক্ত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়। জানা যায়, যুক্তরাজ্যের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বাচ্চাদের কোনো পরীক্ষা দিতে হয় না। এমনকি মুখস্থ বিদ্যার বিষয়টি এখানকার বাচ্চারা বোঝেও না। এখানে একটি শিশুর স্কুল শুরু হয় তিন বছর থেকে। তিন থেকে পাঁচ এই দুই বছর তারা নার্সারি ও রিসিপশন শেষ করে ইয়ার ওয়ান শুরু করে। ১১ বছরে তারা পড়ে ইয়ার সিক্সে। পুরো প্রাইমারিতে কোনো পরীক্ষা পদ্ধতি নেই। ইয়ার নাইন থেকে শুরু হয় বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা। কে কোন বিষয়ে পড়াশোনা করতে আগ্রহী তখনই সাবজেক্ট চয়েজ করা হয়। কার্যত, ইয়ার সিক্সে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় বসতে হয়। তাই প্রাইমারি স্কুলের সময়টা প্রতিটি বাচ্চার জন্য স্বপ্নময় জগৎ। বইখাতা, কলম, পেনসিল সবকিছু স্কুল থেকে দেওয়া হয়। আবার সেগুলো স্কুলেই রেখে দেওয়া হয়। ছোটদের ক্লাসে বেশির ভাগই ধাঁধা মেলানো, লেগো দিয়ে নতুন কিছু তৈরি, ছবি আঁকা, রং করা এসবের মধ্য দিয়ে শেখানো হয়। স্কুলগুলো ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের নারী-পুরুষ বৈষম্যহীনতার শিক্ষার সংস্কৃতি চালু করে খেলনা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। এলাটন গ্রেঞ্জ হাইস্কুলের শিক্ষক আহমেদ আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যুক্তরাজ্যে বাচ্চারা যখন খেলে তখন ছেলেমেয়ে হিসাব করে বল বা হাঁড়িপাতিল দেওয়া হয় না। এখানে সবাই সবকিছু নিয়ে খেলতে পারে। এখানে ইংরেজি, অংক, বিজ্ঞান, ভুগোল যেমন পড়ানো হয় তেমনি বাস্তবাদী শিক্ষার ওপরও জোর দেওয়া হয়। এখানে শারীরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। প্রতিটি বাচ্চাকে সাঁতার শেখানোর আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন স্পোর্টস ক্লাবে ভর্তি করানো হয় স্কুলের মাধ্যমেই। শেখানো হয় নাচ, গান। যে বাচ্চা যেদিকে পারদর্শী সেটা বিবেচনায় নিয়ে তাকে সেভাবেই গড়তে চান এখানকার শিক্ষকরা। বাংসাইড প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা ঝরনা বেগম বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই সামাজিকতা, নৈতিকতা শিক্ষার মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে শিশুদের সাহায্য করা হয়। তাদের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয় না। লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুশফিক উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশে একটি শিশুর কাঁধে যেভাবে বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তা খুবই দুঃখজনক। যুক্তরাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশ শিক্ষা নিতে পারে। মূলত শিশু-কিশোরদের বিনোদনের মাধ্যমে পড়াশোনা করাতে হবে। বাংলাদেশের মতো এত ঘন ঘন পরীক্ষা পদ্ধতিও কোথাও নেই। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews