Author,
শুভজ্যোতি ঘোষ
Role,
বিবিসি নিউজ বাংলা, দিল্লি
২৮ মিনিট আগে
ছবির উৎস, Titumir Collective
ছবির ক্যাপশান,
এই নাটকে তিতুমীরের ভূমিকায় অভিনয় করছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য (মাঝে)
উনিশ শতকের বাংলায় সশস্ত্র কৃষক আন্দোলনের নেতা ও ‘বাঁশের কেল্লা’-খ্যাত তিতুমীরের জীবনের ওপর আধারিত একটি মঞ্চ নাটকের শো ভারতের সব চেয়ে মর্যাদাব্যঞ্জক থিয়েটার ফেস্টিভ্যালের কর্মকর্তারা আচমকা বাতিল করে দিয়েছেন।
‘তিতুমীর’ নামে ওই নাটকটির পরিচালক জয়রাজ ভট্টাচার্য বিবিসিকে বলেছেন, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণেই যে তাঁদের আমন্ত্রণ জানানোর পরও এই শো বাতিল করা হয়েছে, তা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
“তিতুমীরের মতো ইতিহাসের একজন অসাম্প্রদায়িক ও ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী নায়ককে যে ভারতের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর পছন্দ হবে না, এটা বুঝতে কোনও অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই”, মন্তব্য করেছেন তিনি।
দিল্লির যে সর্বভারতীয় থিয়েটার উৎসবে ‘তিতুমীর’কে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, সেই ‘ভারত রঙ্গ মহোৎসব’ আকারে, পরিসরে ও মর্যাদায় দেশের সবচেয়ে বড় নাট্যমেলা বললেও সম্ভবত ভুল হবে না।
ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
দিল্লিতে ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার প্রবেশদ্বার
ওই উৎসবের আয়োজক, সরকারি অর্থায়নে চলা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা (এন এস ডি) অবশ্য দাবি করছে, রিভিউয়ের জন্য তিতুমীর নাটকের নির্মাতারা যথাসময়ে তাদের শো-র ভিডিও রেকর্ডিং পাঠাতে পারেননি বলেই তারা উৎসবে ওই নাটকের শো বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন।
তবে নিজে থেকে ওই নাটকটিকে উৎসবে আমন্ত্রণ জানানোর পরও কেন এনএসডি কর্তৃপক্ষ নাটকের ভিডিও রেকর্ডিং দেখতে চাইছে, তারা এ প্রশ্নের কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি।
এদিকে দিল্লিতে তিতুমীর নাটকের শো বাতিল হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে অনেকেই যেমন এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, তেমনি দক্ষিণপন্থী ও হিন্দুত্ববাদীরা আবার সোশ্যাল মিডিয়াতে তাদের উল্লাস ব্যক্ত করতেও দ্বিধা করছেন না।
তিতুমীর বাংলায় ‘সাম্প্রদায়িকতার বিষ’ ছড়িয়েছিলেন এবং উগ্র ওয়াহাবি ভাবধারার প্রচারক ছিলেন, এই যুক্তি দিয়ে তারা বলছেন তিতুমীরের শো বন্ধ করা হলে সেটা একদম সঠিক কাজই হয়েছে!
বাংলা থিয়েটার জগতের লেজেন্ড উৎপল দত্ত তিতুমীরের জীবন নিয়ে একটি নাটক লিখেছিলেন সত্তরের দশকে।
তাঁর নাট্যগোষ্ঠী পিএলটি ‘তিতুমীর’ নামে সেই নাটকটি সত্তর ও আশির দশকে বহুবার মঞ্চস্থ করেছে। তখন ওই নাটকে নামভূমিকায় অভিনয় করতেন অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
পশ্চিমবঙ্গে ‘থিয়েটার ফর্মেশন পরিবর্তক’ নামে একটি গোষ্ঠী উৎপল দত্তের সেই পুরনো নাটকটিকেই নতুন করে মঞ্চে নামায় ২০১৯ সালে।
ছবির উৎস, Titumir Collective
ছবির ক্যাপশান,
নাট্য পরিচালক জয়রাজ ভট্টাচার্য
“এরপর জিজ্ঞেস করা হয়, নাটকটি কি সরকার বিরোধী? তখন আমি বলি হ্যাঁ, এটি সেই আমলের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে”, বলছিলেন তিতুমীরের পরিচালক জয়রাজ ভট্টাচার্য।
তিনি আরও জানান, “এরপর আমাদের কাছে পুরো নাটকের ভিডিও রেকর্ডিং চেয়ে পাঠানো হয়। আমাদের কাছে কোনও রেকর্ডিং তৈরি ছিল না, তবু আমরা ১৭ জানুয়ারি কলকাতার অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে আমাদের পরবর্তী শো-র পুরোটা রেকর্ড করে এনএসডি-র কাছে পাঠানোর প্রস্তুতি নিতে থাকি।”
“সেদিন রাতে আমাদের শো ভেঙেছে রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ। আর পরদিন সকালেই এনএসডি-র কর্মকর্তারা আমাদের ইমেইল আর হোয়াটস্যাাপে জানিয়ে দেন, ঠিক সময়ে রেকর্ডিং না-পাওয়ার কারণে উৎসবে আমাদের শো বাতিল করা হচ্ছে”, প্রবল হতাশার সুরে বলেন মি ভট্টাচার্য।
এনএসডি কর্তৃপক্ষ অবশ্য দাবি করছে, পদ্ধতিগত জটিলতার কারণেই তারা শেষ পর্যন্ত দিল্লিতে তিতুমীর মঞ্চস্থ করতে দিতে পারছেন না।
ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার অধিকর্তা আর সি গৌড় বিবিসিকে বলেছেন, “ভারত রঙ্গ মহোৎসবে যে নাটকগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে আর যেগুলো আবেদন করে এন্ট্রি পাচ্ছেন, তার সবগুলোরই স্ক্রিপ্ট আর রেকর্ডিং দেখে একটি রিভিউ কমিটি সবুজ সংকেত দেবেন বলে আমরা সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
দিল্লির এনএসডি ক্যাম্পাসে ভারত রঙ্গ মহোৎসবের আসর। ফাইল ছবি
“দুর্ভাগ্যবশত তিতুমীর নাটকটির স্ক্রিপ্ট আর রেকর্ডিং ঠিক সময়ে আমাদের হাতে আসেনি। মহারাষ্ট্রের ‘সঙ্গীত দেবভাওলি’ নামে আর একটি নাটকের ক্ষেত্রেও একই জিনিস ঘটেছে, ফলে এই দুটো নাটককে আমরা এবারের উৎসবে জায়গা দিতে পারছি না,” জানান মি. গৌড়।
তবে এনএসডি-র প্রাক্তনীদের সমিতির প্রধান ও দেশের সুপরিচিত থিয়েটার ব্যক্তিত্ব এম কে রায়না বলেছেন, আমন্ত্রণ জানানোর পরও একটি নন্দিত নাটকের শো কর্তৃপক্ষ যেভাবে বাতিল করেছেন তাতে তিনি ‘স্তম্ভিত ও হতাশ’!
ভারত রঙ্গ মহোৎসবে ‘তিতুমীরে’র মঞ্চায়ন বাতিল হয়েছে, এ খবর সামনে আসার পরই পশ্চিমবঙ্গের সাবেক বিজেপি সভাপতি তথাগত রায় টুইট করেন, “কেন্দ্রীয় নাট্য উৎসবে তিতুমীর নিয়ে উৎপল দত্তের নাটক মঞ্চস্থ করায় নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে থাকলে ঠিক কাজ হয়েছে।”
তিনি আরও লেখেন, “বাংলায় সাম্প্রদায়িক বিষ প্রচার করায় এবং হিন্দু ও মুসলমান, এই দুধরনের বাঙালির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করায় তিতুমীর অগ্রগণ্য। বাঙালি হিন্দুর এই আদিখ্যেতা ন্যাক্কারজনক।”
তথাগত রায়ের এই বক্তব্যকে সমর্থন করে সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেকেই পোস্ট করতে শুরু করেন, তারা তিতুমীরকে বাংলায় উগ্র ইসলামী ভাবধারার প্রবর্তক বলেও চিহ্নিত করতে থাকেন।
জনৈক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন, “এই তিতুমীর বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের জনক। অথচ বামফ্রন্ট সরকার একে বীর স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে স্কুলের পাঠ্য বইতে পড়িয়েছে।”
তন্ময় মজুমদার নামে আর একজন একটি ছবি পোস্ট করে লেখেন, “(তিতুমীরের জন্মস্থান) বারাসাতে চাঁপাডালি বাসস্ট্যান্ডের নাম যেরকম ঘটা করে (তিতুমীরের নামে) রাখা হয়েছে তা ন্যাক্কারজনক!”
ছবির উৎস, Titumir Collective
ছবির ক্যাপশান,
সোশ্যাল মিডিয়াতে কিছু প্রতিক্রিয়া
এর পাশাপাশি শো বাতিল করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদেও মুখর হয়ে উঠেছেন পশ্চিমবঙ্গের বহু নাট্যপ্রেমী।
এবারের ভারত রঙ্গ মহোৎসবের থিম হল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ‘আনসাং হিরোজ’ বা নেপথ্যের নায়করা।
সে দিকে ইঙ্গিত করে তিতুমীর নাটকের ফেসবুক ওয়ালে জনৈক হৈমন্তী মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “তাহলে সরকারের মতে তিতুমীর আনসাং হিরোজের আওতাতেও পড়েন না। এটাও দেখার ছিল শেষমেশ!”
‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’দের বেছে নিতে বিবিসি বাংলা ২০০৪ সালে যে শ্রোতা জরিপের আয়োজন করেছিল, তাতে মীর নিসার আলি তিতুমীর এসেছিলেন ১১ নম্বর স্থানে।
সেই অনুষ্ঠানমালা তৈরির সময় বাংলাদেশের ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আব্দুল মোমেন চৌধুরী বিবিসিকে বলেছিলেন, তিতুমীর জীবন শুরু করেছিলেন একজন সমাজ ও ধর্মীয় সংস্কারক হিসাবে।
ছবির ক্যাপশান,
তিতুমীরের চিত্রায়ন
মি চৌধুরীর কথায়, “তখন মুসলমান সমাজে যেসব বিদআত (এমন রীতি যা ইসলামসম্মত নয়) এবং শিরক্ (আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে উপাস্য হিসেবে সাব্যস্ত করা বা তার উপাসনা করা) ঢুকে গিয়েছিল, সেগুলোকে দূর করার উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি তাঁর কাজ শুরু করেছিলেন।”
“কিন্তু এই ধর্মীয় এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট পরে একটা অর্থনৈতিক এবং ব্রিটিশ বিরোধী প্রেক্ষাপটে পরিণত হয়েছিল”, আরও যোগ করেন তিনি।
তিতুমীর হিন্দু ও মুসলমান কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করেন এবং জমিদার ও ব্রিটিশ নীলকরদের বিরুদ্ধে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে নিতে উৎসাহিত করেন বলেও জানাচ্ছেন আব্দুল মোমেন চৌধুরী।
তবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক ইসলামের বিশেষজ্ঞ কিংশুক চ্যাটার্জির স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, বাংলাদেশের ইতিহাস বইতে তিতুমীরকে যেভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে তিনি সেই প্রাপ্য মর্যাদার জায়গাটা পাননি।
ছবির উৎস, Titumir Collective
ছবির ক্যাপশান,
তিতুমীর নাটকের একটি দৃশ্য
কিংশুক চ্যাটার্জি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “যেহেতু তিতুমীর ফরাজি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তার কর্মকান্ডকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার একটা প্রবণতা এদিকে আছেই।”
“কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, তিতুমীর তাঁর অনুগামীদের মোবিলাইজ করতে হয়তো ধর্মকে ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু তাঁর মূল প্রতিবাদটা ছিল কৃষক শোষণের বিরুদ্ধে – যেখানে তার নিশানায় ছিলেন অত্যাচারী জমিদার ও ব্রিটিশ শাসকরা।’
ড: চ্যাটার্জি আরও জানাচ্ছেন, মুসলিমদের পাশাপাশি বহু হিন্দু কৃষকও কিন্তু নারিকেলবাড়িয়া গ্রামে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লায় গিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলেন।
ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
অভিনেতা মাইকেল ইয়র্কের সঙ্গে নাট্যকার উৎপল দত্ত (ডাইনে)
কিন্তু তারপরেও সাম্প্রতিককালে পশ্চিমবঙ্গে তিতুমীরকে যে সাম্প্রদায়িক চরিত্র হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা হচ্ছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
তিতুমীর নাটকের পরিচালক জয়রাজ ভট্টাচার্যও এই কারণেই বলছিলেন, “নাট্যকার উৎপল দত্তও এই কারণেই দেখিয়েছেন, তাঁকে যে সাম্প্রদায়িক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা হবে এই আশঙ্কাটা খোদ তিতুমীরের ভেতরেও ছিল।”
“নাটকে তাঁর মুখে এমন সংলাপও আছে যেখানে তিতুমীর বলছেন কী কী ‘তরিকা’য় তাঁকে ধর্মান্ধ মুসলিম সাজানোর চেষ্টা হবে। যেমন, হয়তো গোমাংস খেয়ে মন্দিরের সামনে উচ্ছিষ্ট ফেলে এসে বলা হবে এটা তিতুমীরের কাজ,” জানান তিনি।
দিল্লির নাট্যোৎসবে ‘তিতুমীরে’র শো বাতিল হওয়ার পর ইতিহাসের সেই নায়ককে নিয়েই পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছে নতুন করে কাঁটাছেঁড়া।