হেলমেট ও মুখোশ পরে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা নতুন কিছু নয়। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে অপরাধের এই প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজনৈতিক কোন্দল কিংবা প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা, এমনকি খুন করার ঘটনা ক্রমে বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে, নওগাঁ, নাটোর ও রাজশাহীতে এ ধরনের ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে। ইনকিলাবসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নওগাঁয়ে গত দুই মাসে ৫টি, নাটোরে এক মাসে ১০টি এবং রাজশাহীতে ৩টি ঘটনা ঘটেছে। হেলমেট ও মুখোশ পরে সন্ত্রাসীরা হামলা করেছে। এসব হামলার মূল টার্গেট হচ্ছে, বিএনপি ও জামায়েতের নেতাকর্মীরা। সন্ত্রাসীরা নির্জন এলাকা থেকে নেতাকর্মীদের তুলে নিয়ে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙ্গে, অস্ত্র দিয়ে রগ কেটে কিংবা কুপিয়ে পালিয়ে যায়। এক চিকিৎসককে নির্জন এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করেছে। গত শনিবার রাত দশটার দিকে নওগাঁ পৌর এলাকার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপির যুগ্মআহ্বায়ককে মুখোশধারীরা কুপিয়ে হত্যা করেছে। অন্যদিকে, যশোর শহরের ঘোপের পিলু খান সড়কে অবস্থিত বিএনপি’র মরহুম নেতা তরিকুল ইসলাম ও নির্বাহী কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের বাড়িতে গত রবিবার রাতে মুখোশধারীরা দেড় মিনিটে ২৫টি ককটেল হামলা করে এবং ওই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নওগাঁ, নাটোর ও রাজশাহীর ঘটনায় এ পর্যন্ত ১০টি মামলা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে মাত্র ২ জন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব ঘটনায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধীদল এক দফা দাবিতে অবরোধ ও হরতালসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে। এ পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেমন বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রেখেছে, তেমনি হেলমেট ও মুখোশ পরা সন্ত্রাসীরাও গুপ্ত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে শুধু বিএনপি নেতাকর্মীরাই নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। মুখোশধারীদের প্রত্যেকটি ঘটনায় বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা শিকার হয়েছে। এতে প্রতীয়মান হচ্ছে, বিরোধীদলের নেতাকর্মীরা টার্গেট কিলিংয়ের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। গুপ্ত হত্যার এই প্রবণতা যে শুধু বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, তা মনে করার কারণ নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব ঘটনার সাথে যারা জড়িত, তারা পেশাদার সন্ত্রাসী। তাদের নির্দিষ্ট কোনো দল নেই। প্রতিপক্ষের ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনায় তাদের ব্যবহার করা হয়। রাজনৈতিক আন্দোলন দমাতে বিরোধীদলের নেতৃস্থানীয় নেতাদের হত্যার মিশনে নামানো হয়। উল্লেখিত তিন জেলার গুপ্ত হামলার ঘটনা থেকে এ ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কয়েক দিন আগে পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জেল থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ জামিন নিয়ে বের হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর হামলা ও হত্যার কাজে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে, আরো হতে পারে। দেখা গেছে, জেল থেকে বের হয়েই কোনো কোনো সন্ত্রাসী প্রকাশ্যে প্রতিপক্ষের সাথে সংঘাতে জড়িয়েছে। এতে তেজগাঁওয়ে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে একজন নিহত হয়েছে। এ নিয়ে এলাকাভিত্তিক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যতই দিন যাবে, সন্ত্রাসীদের হামলা ও হত্যাকাণ্ড তত বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। পরিস্থিতি অবলোকনে বোঝা যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুপ্ত হামলা ও সন্ত্রাসী দমনের চেয়ে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দমনে বেশি ব্যস্ত। তা নাহলে, উল্লেখিত তিন জেলায় মুখোশধারী সন্ত্রাসীরা একের পর এক হামলা চালিয়ে যেতে পারত না। দেখা যাচ্ছে, এসব হামলা নিয়ে পুলিশ তেমন তৎপর নয়। তারা তদন্ত চলছে, খতিয়ে দেখা হচ্ছে ইত্যকার কথা বলে কালক্ষেপণ করছে।
হেলমেট ও মুখোশ পরে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও হত্যার যে ট্রেন্ড চালু হয়েছে, তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে রাজধানীসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা দেখেছি, ২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে হেলমেটধারীরা ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে মারাত্মক জখম করেছে। সে ঘটনায় আজ পর্যন্ত কাউকে পুলিশ শনাক্ত করে গ্রেফতার করতে পারেনি। নওগাঁ, নাটোর ও রাজশাহীতে যেভাবে গুপ্ত হামলা হচ্ছে, সে ব্যাপারেও পুলিশের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, পুলিশ কি তাহলে জানে, কারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে? অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, যেখানে পুলিশের কাছে অপরাধী শুধু অপরাধী হিসেবে গণ্য হওয়ার কথা এবং সে যেই হোক তাকে গ্রেফতার করে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা, সেখানে করব, করছি ও দেখব, দেখছি নীতি অবলম্বন করা হচ্ছে। এই যদি নীতি হয়, তাহলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও জননিরাপত্তা কোনোদিনই নিশ্চিত হবে না। আমরা মনে করি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিৎ, দলমত নির্বিশেষে যেই অপরাধ করুক তাকে আইনের আওতায় আনা। হেলমেট ও মুখোশ পরে যারা গুপ্ত হামলা ও হত্যা চালাচ্ছে, তাদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে দ্রুত বিচারের সম্মুখীন করা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই তাদের দমন করতে হবে।