রাশিয়ার বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর সংকট নতুন মাত্রা পেয়েছে। সেনাদের পালিয়ে যাওয়া ক্রমশই যুদ্ধ পরিকল্পনায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। যা ভবিষ্যৎ যুদ্ধবিরতির আলোচনায় কিয়েভকে দুর্বল অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে।
যুদ্ধের তৃতীয় বছরে প্রবেশ করা এই সংঘাতে ইউক্রেনীয় সেনাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা আশঙ্কাজনক। হাজার হাজার সেনা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে গিয়ে অজানার পথে পাড়ি জমাচ্ছেন। সেনাবাহিনী, আইনজীবী ও সরকারি কর্মকর্তাদের তথ্যানুযায়ী, কোথাও কোথাও সম্পূর্ণ ইউনিট একসঙ্গে অবস্থান ত্যাগ করছে, ফলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ফাঁক তৈরি হচ্ছে এবং রুশ বাহিনীর অগ্রগতিকে আরও ত্বরান্বিত করছে।
কিয়েভভিত্তিক সামরিক বিশ্লেষক ওলেক্সান্দার কোভালেঙ্কো বলেন, এই সমস্যা গুরুতর। যুদ্ধের তৃতীয় বছরে এটি আরও প্রকট হবে।
সেনারা চিকিৎসা ছুটি নিয়ে আর ফিরে আসছে না। যুদ্ধের ট্রমা ও জয়ের অনিশ্চয়তায় অনেকেই মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। কেউ কেউ সরাসরি কমান্ডারদের আদেশ অমান্য করছেন, এমনকি লড়াই চলাকালেও।
ইউক্রেনের প্রধান প্রসিকিউটরের অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার আক্রমণের পর থেকে ১ লাখেরও বেশি সেনার বিরুদ্ধে বিচ্যুতির অভিযোগ আনা হয়েছে। এদের প্রায় অর্ধেক গত এক বছরে লড়াইয়ের মধ্যে পালিয়েছেন।
বিচ্যুতির প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। একজন আইনপ্রণেতার মতে, এই সংখ্যা ২ লাখ পর্যন্ত হতে পারে। সাম্প্রতিক নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে বিচ্যুতির হার বেশি।
অভিজ্ঞ সেনা সের্হি হ্নেজদিলভ বলেন, এই সমস্যার বিষয়ে নীরব থাকা আমাদের দেশকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। তিনি নিজেও বিচ্যুতি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলার কারণে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন।
পালানোর কারণ
যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ হারানো সঙ্গীদের স্মৃতি, অপ্রতুল গোলাবারুদ ও আদেশ পালনের চাপ অনেক সেনাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এক সেনা বলেন, একদিকে প্রতিপক্ষের দিক থেকে ৫০টি গোলাবারুদ ছুটে আসছে, আর আমাদের দিক থেকে মাত্র একটি। তখন মনে হয়, যেকোনও মুহূর্তে আমিও মারা যেতে পারি।
অন্যদিকে, সামরিক সেবার নির্দিষ্ট সময়সীমা না থাকায় এটি অনেকের কাছে কারাগারে থাকার মতো মনে হচ্ছে। হ্নেজদিলভ বলেন, যদি সেবার কোনও শেষ সীমা না থাকে, এটি একটি কারাগারে পরিণত হয়। তখন দেশের জন্য লড়াইয়ের কোনও মানসিক শক্তি পাওয়া যায় না।
কৌশলগত প্রভাব
বিচ্যুতির কারণে সামরিক পরিকল্পনা বিপর্যস্ত হচ্ছে। সামরিক কমান্ডাররা জানিয়েছেন, পুরো ইউনিট আদেশ অমান্য করে অবস্থান ত্যাগ করায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে। গত অক্টোবর মাসে ভুহলেদার শহর রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বিচ্যুতিকে দায়ী করা হচ্ছে।
৭২তম ব্রিগেডের এক কর্মকর্তা জানান, যখন একটি ইউনিট অবস্থান ত্যাগ করে, তখন শত্রুপক্ষ সেই দুর্বল জায়গা ব্যবহার করে আমাদের সেনাদের আক্রমণ করে।
আইনি পদক্ষেপ ও মানসিক চাপ
বিচ্যুতির অভিযোগে অভিযুক্ত সেনাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন সাধারণত শেষ উপায়। অনেক সেনাকে মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন দেওয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
আইনজীবী তেতিয়ানা ইভানোভা বলেন, মানসিকভাবে অসুস্থ সেনাদের বিচ্যুতির দায় থেকে মুক্তি দিলে এটি বিপজ্জনক উদাহরণ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, তখন প্রায় সবাই মানসিক সমস্যার অজুহাতে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যাবে।
বিচ্যুতির এই সংকট কিয়েভের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। সামরিক নেতৃত্ব ও পরিকল্পনায় কার্যকর সমাধান না আনলে যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের দুর্বলতা আরও প্রকট হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
৭২তম ব্রিগেডের এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের সেনাদের সর্বোচ্চটা ইতোমধ্যে কাজে লাগানো হয়েছে। তবে এভাবে চললে সামরিক সাফল্যের আশা করা কঠিন।
সূত্র: এপি