ভারত ও মিয়ানমারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল সীমান্ত একসময় ছিল মানচিত্রের দুর্গম রেখামাত্র। অরক্ষিত এই সীমানার সুযোগ নিতো চোরাকারবারি ও সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এক হাজার ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এক সুবিশাল সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করে দেশের সার্বভৌমত্বকে করছে সুসংহত। এই সড়ক শুধু নিরাপত্তার ঢালই নয়, এটি অবহেলিত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য বয়ে আনছে উন্নয়ন ও সম্ভাবনার নতুন ভোর।
সেনাবাহিনীর ৩৪ কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে নির্মিত এই সড়ক প্রকল্পটি দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে এক নতুন মানচিত্র এঁকে দিচ্ছে। বান্দরবানের ঘুমধুম থেকে শুরু হয়ে মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে এই পথ খাগড়াছড়ির রামগড়ে শেষ হবে। ৩ হাজার ১০০ ফুটেরও বেশি উচ্চতায় মেঘের রাজ্যে নির্মিত এই সড়ক কেবল একটি অবকাঠামো নয়, এটি দুর্গম পাহাড়ে রাষ্ট্রের কার্যকর উপস্থিতির এক বলিষ্ঠ ঘোষণা।
কৌশলগত নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা : অতীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বহুলাংশ ছিল কার্যত বিচ্ছিন্ন ও অরতি। বিজিবির টহল পৌঁছাতো না বহু এলাকায়। এই সুযোগে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো চাঁদাবাজি, অপহরণ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে পাহাড়ের জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। সীমান্ত সড়ক নির্মাণের ফলে এই চিত্র আমূল পাল্টে যাচ্ছে।
সেনাবাহিনীর ৩৪ কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের অধিনায়ক, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: শামছুল আলম বলেন, ‘একসময় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তৃত সীমানা আমরা শুধু মানচিত্রে দেখেছি। এখন আমার জায়গার মালিকানা আমি বুঝে নিচ্ছি। এই সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে আমরা দেশকে নতুনভাবে আবিষ্কার করছি।’ সড়কটি নির্মিত হওয়ায় এখন সীমান্ত চৌকিগুলো (বিওপি) সীমান্তের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে, যা বিজিবির টহল ও নজরদারি বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০ ইসিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আসিফ আহমেদ তানজিল জানান, সড়কের কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কুইক রেসপন্স করার সমতা বেড়েছে। সিসিটিভি ক্যামেরা ও ড্রোনের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে নজরদারি সহজ হয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব:) এমদাদুল ইসলামের মতে, ‘এই বিস্তৃত সড়কটি হবে সীমান্তে বাংলাদেশের ঢাল। এটি দিয়ে চলাচল শুরু হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসীরা নিজেদের গুটিয়ে নেবে।’
বদলে যাওয়া জনজীবন : এই সড়ক নির্মাণের সবচেয়ে বড় সুফলভোগী দুর্গম পাহাড়ের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। একসময় যেখানে জেলা শহরে যেতে সপ্তাহখানেক সময় লেগে যেত, সেখানে এখন কয়েক ঘণ্টায় পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে। বান্দরবানের শালোকিয়াপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাগরিকা ত্রিপুরা তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘৫ বছর আগেও বান্দরবান শহরে যেতে আমাদের মনে হতো যেন বিদেশে যাচ্ছি। এখন আমরা দিনে দিনেই যাতায়াত করতে পারি।’
যোগাযোগ ব্যবস্থার এই উন্নতির ফলে পাহাড়ের অর্থনীতিতে গতি এসেছে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন। রাঙ্গামাটির জুরাছড়ির কৃষক পুলনাথ চাকমা জানান, আগে ভালো দাম না পাওয়ায় তাদের ভারতে পণ্য বেচতে হতো, কিন্তু এখন সড়ক হওয়ায় তারা সরাসরি রাজস্থলী বা জেলা শহরে পণ্য নিয়ে যেতে পারছেন। শুধু তাই নয়, সেনাবাহিনী এই অঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়াতে তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছে, যেখানে প্রায় ২৫০ জন শিশু পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধা এখন তাদের দোরগোড়ায়।
পর্যটনে নতুন দিগন্ত : দার্জিলিং বা কাশ্মিরের সাথে পাল্লা দেয়ার মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য লুকিয়ে ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলে। সীমান্ত সড়ক সেই অপার সৌন্দর্যকে প্রথমবারের মতো উন্মোচিত করেছে। সর্পিল পথ বেয়ে মেঘের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া, হাত বাড়িয়ে মেঘ ছোঁয়ার অনুভূতি নিতে এখন আর দেশের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। বান্দরবানের বঙ্কুপাড়া বা রাঙ্গামাটির সাইচলের মতো এলাকাগুলো হয়ে উঠছে নতুন পর্যটন আকর্ষণ। পর্যটক জমির উদ্দিন বলেন, ‘আমি ভারতের দার্জিলিং, শিলং আর কাশ্মির ঘুরেছি। বাংলাদেশের দুর্গম পাহাড়ে সীমান্ত সড়কের সৌন্দর্য এর চেয়ে বেশি।’
সেনা কর্মকর্তারা মনে করছেন, এই সড়ককে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: শামছুল আলম জানান, পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হলে একজন পর্যটক ফেনীর রামগড় থেকে সীমান্ত সড়ক ধরে তিন পার্বত্য জেলা ঘুরে কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে পৌঁছাতে পারবেন, যা হবে দেশের অন্যতম সেরা একটি ট্যুরিস্ট সার্কিট। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডও এই সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে সাজেকে বৈঠক করার পরিকল্পনা করেছে।
নির্মাণযজ্ঞের কঠিন চ্যালেঞ্জ : তবে এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। সমতলের চেয়ে পাহাড়ে সড়ক নির্মাণের চ্যালেঞ্জ বহুমাত্রিক। নরম মাটি, পাথুরে পাহাড়, আকস্মিক ধস, দুর্গমতার কারণে নির্মাণসামগ্রীর আকাশছোঁয়া খরচ এবং সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হুমকি এসব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেই সেনাবাহিনী কাজ এগিয়ে নিয়েছে। প্রকল্পের পরিচালক কর্নেল মো: দেলোয়ার হোসেন তালুকদার জানান, ‘একটি ইট সমতলে ১০ টাকা হলে, সেটি সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছাতে অনেক সময় ১০০ টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ে যায়।’
পরিবার-পরিজন ছেড়ে, মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই প্রকল্পে কাজ করছেন সেনা সদস্য ও বেসামরিক শ্রমিকরা। এই পথ শুধু পাথর আর পিচে নয়, নির্মিত হয়েছে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়েও। এই শ্রমসাধ্য নির্মাণ কাজ চলাকালে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় সেনা সদস্যসহ মোট সাতজন তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁদের এই ত্যাগ ও পরিশ্রমে ধাপে ধাপে বাস্তবায়িত হচ্ছে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ৩১৭ কিলোমিটার সড়কের কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে বাকি দুই পর্যায়ের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই সীমান্ত সড়ক কেবল ইট-পাথরের কোনো স্থাপনা নয়; এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও সামাজিক অগ্রগতির এক লাইফলাইন, যা বিচ্ছিন্ন এক জনপদকে মূল ভূখণ্ডের সাথে একীভূত করে এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।