ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার বওলা গ্রামের কৃষক নুরু বলছিলেন, তার খেতের ধান পেকে গেছে, কাটা প্রয়োজন, কিন্তু তিন দিন ধরে সারা গ্রাম ঘুরে ধান কাটার শ্রমিক পেলেন না। গ্রামের অধিকাংশ জমিই খণ্ড  খণ্ড, ফলে হার্ভেস্টার দিয়ে কাটাও কঠিন। এমন সংকট শুধু ময়মনসিংহে নয়, হয়তো সারা দেশেই। যেমন ফরিদপুরের কৃষক জহুরুল বলছিলেন, ‘শ্রমিকদের জামাই আদর করেও পাওয়া যায় না। মজুরি বাড়ালেও মানুষ আর শ্রম দিতে রাজি নন। অনেকে অটোরিকশা চালাচ্ছেন, কেউবা দোকান নিয়ে বসেছেন হাটে। আবার কারও মেয়ে হয়তো গার্মেন্টে কাজ করে, কারও ছেলে আছে বিদেশে, সেখান থেকে টাকা পাঠায়, সংসার খরচ চলে যায়। কাজ করতে চায় না।’ সারা দেশেই বোরোর বাম্পার ফলন, কিন্তু শ্রমিকসংকটের কারণে কৃষিজীবীরা আছেন বিপদে। পরিস্থিতি পুরোটাই আমি অনুধাবন করতে পারছি। আশির দশকে মাটি ও মানুষ শুরুর পর থেকে কয়েক বছর আগেও দেখেছি অনুষ্ঠান ধারণ করতে কাকডাকা ভোরে ঢাকা থেকে রওনা হয়ে কোনো জেলায় গিয়ে যখন পৌঁছতাম তখন মাঠে কর্মরত কৃষক পাওয়া যেত, সঙ্গে থাকত কৃষিশ্রমিকও। কিন্তু এখন চিত্র একেবারে উল্টো। কৃষককে মাঠের ধারেকাছেও পাওয়া যায় না। সকাল থেকে পাড়া বা বাজারের চা স্টলে কৃষককে পাওয়া যায় টেলিভিশন দেখতে বা আড্ডা দিতে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হচ্ছে কৃষি, আর কৃষির প্রাণ হচ্ছে ধান। এ দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে ধানের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর একটি। প্রতি বছর কয়েক কোটি টন ধান উৎপাদন হয়, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি লাখ লাখ মানুষের জীবিকা নির্বাহের পথ সুগম করে। কিন্তু এ ধান উৎপাদনব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল ধাপ- কাটাই ও মাড়াই বর্তমানে বড় সংকটের মুখে। প্রতি বছর ধান কাটা মৌসুম এলেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দেয় শ্রমিকসংকট। ফলে অনেক সময় ফসল মাঠেই নষ্ট হয়ে যায়, কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং সামগ্রিকভাবে দেশীয় কৃষিব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

এ সংকটের পেছনে রয়েছে একাধিক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও কাঠামোগত কারণ। মূল বিষয়গুলোর একটি হলো, গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন। বর্তমানে বাংলাদেশের বেশির ভাগ তরুণ শহরমুখী। উচ্চশিক্ষা, চাকরি, গার্মেন্ট, রাইড-শেয়ারিং, রেস্তোরাঁ ও অন্যান্য খাতে কাজ করার জন্য তারা গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছে। ফলে গ্রামীণ এলাকায় শ্রমশক্তি কমে যাচ্ছে।

গ্রামীণ শ্রমশক্তির একটি বড় অংশ মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইতালি বা দক্ষিণ কোরিয়ায় চলে যাচ্ছে। যারা আগে কৃষিকাজে যুক্ত ছিলেন, তারাও বিদেশে গিয়ে তুলনামূলক ভালো আয়ের আশায় দেশের কৃষি খাত থেকে ছিটকে পড়ছেন। বাংলাদেশে কৃষিশ্রম এখনো কিছুটা ‘নীচু’ পেশা হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে তরুণ সমাজ কৃষিকাজে আগ্রহ হারাচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বর্তমানে সার, বীজ, কীটনাশক, সেচসহ সব কৃষি উপকরণের দাম বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে শ্রমিকসংকট ও বাড়তি মজুরি যুক্ত হয়ে কৃষকের লাভের অঙ্ক দিনদিন সংকুচিত হচ্ছে।

ধান কাটার সময় পুরো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একসঙ্গে ধান পাকতে শুরু করে। ফলে তখন বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের প্রয়োজন হয়, যা স্থানীয়ভাবে জোগান দেওয়া সম্ভব হয় না। বিশেষ করে যখন বন্যা, ঘূর্ণিঝড় বা বৃষ্টির আশঙ্কা থাকে, তখন সংকট আরও ভয়াবহ রূপ নেয়।

ইতোমধ্যে এ সংকটের বহুমাত্রিক প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। কৃষক সময়মতো ধান কাটতে না পারলে ফসল নষ্ট হয়, উৎপাদিত ধান বিক্রি করতে না পারায় ক্ষতির মুখে পড়ে। ধান মাঠেই নষ্ট হলে দেশের খাদ্য মজুত কমে যায়, যার প্রভাব পড়ে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তায়। সরবরাহ কমে গেলে বাজারে চালের দাম বেড়ে যায়, ভোক্তা পর্যায়ে চাপ সৃষ্টি হয়। ধান চাষে লাভ না থাকায় অনেক কৃষক পরবর্তী সময়ে চাষ না করার সিদ্ধান্ত নেন বা জমি পতিত রাখেন, যা কৃষিজমির ক্ষয়িষ্ণুপ্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। ধান উৎপাদনের বড় একটি জেলা নওগাঁ। সম্প্রতি দেখেছি নওগাঁয় ফল চাষের পরিমাণ বেড়েছে। নওগাঁ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ধান চাষের বিশাল জমিতে চাষ হচ্ছে ফলফলাদির। বছরখানেক আগে মানিকগঞ্জে দেখেছি কৃষক ধান চাষের পরিবর্তে পেঁপে চাষ করছেন। কোনো কোনো কৃষক নিজের খাবারের জন্যও ধান চাষ করছেন না, তারা বলছেন চাল কিনে খাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে আমাদের ধানের উৎপাদন আদৌ বাড়বে কি না, সে আশঙ্কা রয়েছে। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা দিনদিন হুমকির মুখে পড়বে কি না, তা-ও ভেবে দেখতে হবে।

কথা হচ্ছে এ সমস্যার সমাধান কী? বছর দুই আগে নেদারল্যান্ডসের রয়্যাল আইকোলক্যাম্প নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দেখার সুযোগ হয়েছিল। রয়্যাল আইকোলক্যাম্প মূলত কৃষি প্রযুক্তি ও অর্গানিক কৃষি নিয়ে গবেষণা করে। প্রতিষ্ঠানটির বিজনেস ইনোভেশন স্ট্র্যাটেজি বিভাগের ড. ইয়োখেন ফরুবিখ বলছিলেন, এখনকার কৃষি হচ্ছে ‘সেক্সি অ্যাগ্রিকালচার’, যার ফলে তরুণরা এখানে যুক্ত হচ্ছেন এবং তাদের হাত ধরেই ক্রমাগত পাল্টে চলেছে কৃষিচিত্র। তরুণ কৃষকের প্রযুক্তি সম্পর্কে জানা-বোঝা হবে কৃষিতে দক্ষ হওয়ার মূল জ্ঞান। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সব তথ্যই কৃষকের কাছে তুলে ধরবে। প্রযুক্তি নিজেই সব কাজ সম্পন্ন করতে পারবে। যে কৃষক স্মার্ট ফার্মিংয়ে ড্রোন, স্যাটেলাইট ইমেজ, সেন্সর ও জিপিএসের মতো প্রযুক্তিকে আরও দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করবেন, তিনি হয়ে উঠবেন সফল। আমরা ইয়ন নামে একজন সফল ক্যাপসিকাম চাষির গ্রিন হাউসে গিয়েছিলাম। বিশাল ক্যাপসিকাম বাগানটি সামলাচ্ছিলেন রোবটের মাধ্যমে মাত্র একজন কর্মী।

প্রতি বছর চীনের আন্তর্জাতিক কৃষি যন্ত্রপাতির মেলায় সাক্ষাৎ মেলে জাপানের কৃষি সাংবাদিক ইয়োসুকি কিশিদার। বয়স ৮০ বছরের কাছাকাছি। তিনি বলেছিলেন, জাপানের অধিকাংশ কৃষকের বয়স ৬০ বছরের বেশি। তরুণরা কৃষিবিমুখ। তাই সরকার বাধ্য হয়েই জাপানের কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ করেছে।

শুধু নেদারল্যান্ডস বা জাপান নয়, উন্নত বিশ্বের অনেক দেশই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদনে যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। সেখানে আমরা এখনো নিশ্চিত করতে পারিনি কৃষির যান্ত্রিকীকরণ। আমাদের কৃষিশ্রমিকের সংকট সমাধানের অন্যতম প্রধান পথ হলো কৃষির যান্ত্রিকীকরণ। আধুনিক যন্ত্র যেমন কম্বাইন হার্ভেস্টার, রাইস রিপার, থ্রেসার মেশিন ইত্যাদির মাধ্যমে দ্রুত ধান কাটা, মাড়াই ও বস্তাবন্দি করা সম্ভব। সরকার ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকিতে কৃষিযন্ত্র তথা হার্ভেস্টার সরবরাহ করেছে, কিন্তু সেটি পর্যাপ্ত নয় এবং কাক্সিক্ষত ফলও আসেনি। ধরুন বিশালাকার একটি হার্ভেস্টারের দাম ২৫ লাখ টাকা হলে কৃষককে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ অর্থাৎ সাড়ে ১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হয়েছে। এত বিনিয়োগ করার সামর্থ্য ক্ষুদ্র বা মাঝারি কৃষকের নেই। অথচ আমাদের দেশের অধিকাংশই ক্ষুদ্র কৃষক, তাদের ব্যবহার উপযোগী কৃষিযন্ত্র দিতে না পারলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায়ে যন্ত্র বিতরণে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।

কৃষকরা নিজ উদ্যোগে বা স্থানীয় সমবায় গঠন করে একে অন্যের সঙ্গে সহযোগিতা করে ধান কাটার কাজ ভাগ করে নিতে পারেন। এতে শ্রমিকের ওপর নির্ভরতা কিছুটা হলেও কমবে। স্কুল-কলেজে কৃষিশিক্ষা বাস্তবভিত্তিক করতে হবে। যুবকদের জন্য কৃষিকে লাভজনক ও সম্মানজনক পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে তারা কৃষিকাজকে আধুনিক পেশা হিসেবে বিবেচনা করে যুক্ত হয়।

সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অ্যাপস চালু করে কৃষক ও শ্রমিকের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা যেতে পারে। এতে দালালদের দৌরাত্ম্য কমবে এবং শ্রমিক পাওয়া সহজ হবে। বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদনের মেরুদণ্ড হচ্ছে কৃষক। ধান কাটার মৌসুমে শ্রমিকসংকট তাদের জীবনে এক ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। এটি কিন্তু শুধু কৃষকের সমস্যা নয়, বরং এটি সমগ্র জাতির খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে জড়িত। তাই এ সংকটকে অবহেলা করলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের কৃষি বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। সরকার, কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি খাত এবং স্থানীয় জনগণের সমন্বিত উদ্যোগে শ্রমিকসংকট নিরসনের টেকসই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। কৃষিকে লাভজনক ও আধুনিক পেশায় রূপান্তর না করতে পারলে, দিনদিন আমরা কৃষক হারাব, উৎপাদন কমবে, খাদ্য নিরাপত্তা দুর্বল হবে।



লেখক : মিডিয়াব্যক্তিত্ব

[email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews