চাহিদার সাথে জোগানের একটা যোগসূত্র আছে, এটা চিরাচরিত নিয়ম। চাহিদার সঙ্গে জোগানের ঘাটতি হলে হইচই পড়ে যায় বাজার ব্যবস্থাপনা, অস্থিরতা বিরাজ করে পুরো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়। আবার এই অস্থিরতার সাথে যোগ দেয় কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ, যারা ওত পেতে বসে থাকে কখন এই অস্থিরতার সময় আসবে! সব মিলিয়ে নাগরিক ও রাষ্ট্রকে চরমকালে প্রবেশ করতে হয়।

এই কথাগুলোর সঙ্গে আজকের শিরোনামের স্বাভাবিক মিল খুঁজে পাওয়ায় দুরূহ! কারণ একেবারেই মিল হওয়ার নয়। কিন্তু পাঠকদের একটু ভাবনায় নিয়ে যাওয়ায় জন্যেই এই কথাগুলো দিয়ে শুরু করা। আমাদের কর ব্যবস্থাপনায় যুগ যুগ থেকে নানান চড়াই উতরাই পার হয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হলেও একটা কূলে এসে হাত বাড়িয়ে মাটির সন্ধান পেয়েছে। ব্রিটিশ বিদায়ের পর দীর্ঘ কয়েক দশক পর ১৯৮৪ সালে “আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪” নামে একটা অধ্যাদেশ জারি হলো। এই অধ্যাদেশ, বিধিমালা আমলাতন্ত্রকে ব্যাপক ক্ষমতাবান করেছিল, যার ফলে করদাতাগণ যেমন উঁ, অ্যাঁ করার সুযোগ ছিল না, তেমনি সরকারগুলোও ছিল কোণঠাসা।

‘ছাগল মতিউর’ গ্রুপদের রোষানলে পড়ে সরকারগুলো কোনও পদক্ষেপ নিতে সাহস পেত না। অতীব সাহস করে বিগত সরকার একটা নতুন “আয়কর আইন ২০২৩” প্রণয়ন করলেন। কিন্তু আইনটি তৈরির সময় সেই আমলা দিয়ে তৈরি করা হলো। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো। করদাতার ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও যুগোপযোগী করদাতাবান্ধব আইনের জোগান দিতে রাষ্ট্র বড় ধরনের ব্যর্থতার পরিচয় দিলো। ফলে পুরনো ব্যবস্থাপনাই করদাতারা শোষণ হতে থাকলো।

বিশ্বের অনেক দেশ ডিজিটাল কর ব্যবস্থাপনার যুগে প্রবেশ করলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সুনির্দিষ্ট গবেষণার অভাব, দক্ষ কর প্রশাসনের অভাব, কারিগরি দক্ষতার ব্যাপক ঘাটতি ইত্যাদি কারণে আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেলো। বারবার চেষ্টা করেও কেন ডিজিটাল কর ব্যবস্থাপনায় যেতে পারেনি, এর কারণ বের করার জন্য বহু দূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই।

আমাদের প্রয়োজন ছিল আগে ডিজিটালবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা। এই ব্যবস্থাপনার সাথে যারা জড়িত তাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত না করে ডিজিটাল কর ব্যবস্থাপনায় যাওয়া ছিল বড় ধরনের ভুল।

যাহোক বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার একটা দৃঢ় মনোবল নিয়ে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু শুরুটা কত কঠিন ছিল, তা আমাদের সকলের জানা। অসৎ কর্মকর্তাদের আন্দোলনের ফল হয়তো আরও অনেক দিন রাষ্ট্রকে বহন করতে হবে।

বিশ্বের ও যুগের চাহিদার ভিত্তিতে কর ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল করা ছাড়া উপায় নেই। শতভাগ হয়তো নিশ্চিত হবে না। কিন্তু শুরুটা যেন ভালো হয়। এতে করে করদাতারা সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে। কিন্তু ডিজিটাল কর ব্যবস্থায় করদাতার দেওয়া তথ্য কি আসলে নিরাপদ থাকলো! তাও ভাবতে হবে। এছাড়া করদাতা কি সত্যিই হয়রানি থেকে মুক্তি পেলো? বর্তমান ব্যবস্থাপনায় দুই ধরনের বিপদ করদাতাদেরকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

একটু দেখা যাক কেন বিপদ:

ক. কর-ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির ব্যবহারে যে ঝুঁকিগুলো রয়েছে:

ডিজিটাল কর ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু দুর্বলতা রয়েছে, যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও কর ব্যবস্থার কার্যকারিতা এবং নির্ভরযোগ্যতা প্রভাবিত করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুর্বলতা হলো:

ডেটা সুরক্ষা ও গোপনীয়তা: ডিজিটাল কর ব্যবস্থা পরিচালনায় ব্যক্তিগত তথ্য এবং আর্থিক ডেটা সংগ্রহ করা হয়, যা সাইবার আক্রমণ এবং তথ্য চুরির ঝুঁকি তৈরি করে। আমাদের ডিজিটাল কর-ব্যবস্থাপনায় করদাতার তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্য শক্তিশালী সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে কিনা তা করদাতার অজানা।

প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর অভাব: বিশ্বের অনেক দেশে ডিজিটাল কর-ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত অবকাঠামো গড়ে তুলতে সক্ষমতা অর্জন করেছে। এর মধ্যে এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, নাইজেরিয়া, মেক্সিকো উল্লেখযোগ্য। এই দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে এস্তোনিয়া। তারা ২০১০-এর শুরুর দিকেই কর ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল নিরাপত্তার অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করে এবং ২০১৩-১৪ সালে এসে ৯০ শতাংশ নিশ্চয়তা নিয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ প্রায় একই পথে এগোচ্ছে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির অবকাঠামো উন্নয়নে কর ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য কোনও বিনিয়োগ হয়েছে কিনা তা জানা নেই। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ই-রিটার্ন/ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার জন্য সিনেসিস আইটি লিমিডেট নামীয় একটা আইটি ফার্মকে দায়িত্ব দিয়ে বর্তমান অনলাইন পোর্টাল তৈরি করেছে।

একান্ত নিজস্ব আইটি ব্যবস্থাপনায় তা করা গেলে নিরাপত্তার বিষয়টি আরও গুরুত্ব পেতো। এই ক্ষেত্রে করদাতার ডেটা নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আরও ঝুঁকি বাড়লো। সরকারকে কর-ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তিগত অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগের প্রতি নজর দিতে হবে।

অব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষণের অভাব: ডিজিটাল কর ব্যবস্থাপনার জন্য প্রযুক্তিগত দক্ষতার কোনও বিকল্প নেই। একদল দক্ষ লোকবল তৈরি করা জরুরি, যেখানে নাগরিকগণ তাৎক্ষণিক সমাধান ও সঠিক নির্দেশনা পাবে। কারণ দক্ষতার অভাবের কারণে ডিজিটাল সিস্টেমের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয় এবং সঠিকভাবে কর সংগ্রহে বাধা সৃষ্টি করে। বাস্তব উদাহরণ হলো বর্তমানে ৪ আগস্ট ২০২৫ থেকে ২৪ অক্টোবর’ ২৫ পর্যন্ত বিগত বছরের সমান বা উল্লেখযোগ্যভাবে রিটার্ন জমা পড়েনি।

আইনি ও নীতিগত সমস্যা: আমাদের দেশে ডিজিটাল কর-ব্যবস্থাপনা আইন এবং নীতিমালা পুরোপুরি উন্নত নয়, যা কর পরিসেবা প্রদানে বিভ্রান্তি এবং আইনগত জটিলতা তৈরি করতে পারে।

কার্যকর ডিজিটাল নেটওয়ার্ক অসমতা: আমাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তি, ব্যক্তি থেকে আয়কর বিভাগের সাথে আন্তনেটওয়ার্কিং মারাত্মক অসমতা বিরাজমান। কার্যকর নেটওয়ার্ক না থাকায় ই-রিটার্ন দাখিলে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সার্ভারের সাথে সংযোগ ব্যাহত হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে যথাসময়ে রিটার্ন দাখিল করা যায় না।

বিগত সপ্তাহে প্রায় ৫ দিনই সঞ্চয়পত্রের সার্ভারের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল, যার কারণে অনেকে রিটার্ন দাখিল করতে পারেনি। বিভিন্ন জায়গায় ফোন দিয়েও সমাধান পাওয়া যায়নি। যার ফলে রাজস্ব আহরণ ব্যাহত হয়। ডিজিটাল ডিভাইস এবং ইন্টারনেট সংযোগের অভাব অনেক করদাতার জন্য ডিজিটাল কর ব্যবস্থায় প্রবেশ করার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। এই অসমতাগুলো দূর করার ক্ষেত্রে বিটিআরসি, আইসিটি বিভাগের সাথে রাজস্ব বিভাগের সার্ভারে একটি কার্যকর নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থাপনা তৈরি করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

টেকনোলজির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা: ডিজিটাল ব্যবস্থা অনেকটা প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। যদি প্রযুক্তি ব্যর্থ হয় বা সিস্টেমে সমস্যা ঘটে, তাহলে পুরো কর ব্যবস্থাপনা বিপর্যস্ত হতে পারে। তাই সরকার তথা রাজস্ব বিভাগকে অতীব সতর্ক থাকতে হবে যেন নির্ভরশীল না হয়ে বরং নিজস্ব ব্যবস্থাপনা তৈরি করা যায়।

খ) মানব সৃষ্ট ঝুঁকি:

১. ই-রিটার্নে দালিলিক প্রমাণ দাখিল করা হয় না। ফলে কোনও করদাতা তার মনগড়া হিসাব দিয়ে করযোগ্য আয় থাকলেও তা গোপন করে করসীমার নিচে আয় প্রদর্শন করতে পারে।

২. প্রযুক্তিগত জ্ঞান না থাকায় কম খরচে অদক্ষ লোক দিয়ে রিটার্ন সাবমিট করার ক্ষেত্রে জটিলতা হতে পারে। প্রয়োজনীয় দালিলিক প্রমাণ ছাড়াই সম্পদ ও দায় বা অন্যান্য তথ্যাদি ভুলভাবে উপস্থাপন হতে পারে।

৩. প্রমাণাদি দাখিল করতে হয় না বলে অনেক করদাতা দালিলিক প্রমাণ সংরক্ষণে রাখতে অনীহা প্রকাশ করবে, পরবর্তীতে কর অফিস থেকে দালিলিক প্রমাণ দাখিলের নির্দেশনা আসলে জটিলতা বাড়বে।

৪. একইভাবে কর অফিসের দালিলিক প্রমাণ না থাকায় সময় সময় করদাতাকে আইন মোতাবেক প্রমাণাদি দাখিলের জন্য চিঠি ইস্যু করতে পারে। এতে করে করদাতা তথ্য প্রমাণ যথাযথভাবে দাখিল করতে না পারলে আর্থিক ও ব্যক্তিগত হয়রানির সম্ভাবনা থেকে যায়।

এই ঝুঁকিগুলো কমিয়ে আনতে পারে কেবল আগাম পরিকল্পনা, যথাসময়ে কার্যকর সিদ্ধান্তগ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং করদাতার সতর্কতা ও সচেতনতা।

আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কর-ব্যবস্থাপনা ও করনীতি নাগরিকদের কল্যাণে, রাষ্ট্রের কল্যাণে আনতে হলে দরকার সমন্বিত প্রচেষ্টা। দরকার পরিবর্তনের মানসিকতা, নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের আগ্রহ, সময়ের সাথে-যুগের সাথে খাপ খেয়ে চলার মানসিকতা। নিজের স্বার্থ, দেশের স্বার্থ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থ যখন এক হয়ে কাজ করবে ঠিক তখনই কল্যাণকর রাষ্ট্র বিনির্মাণ সহজ হবে। সকলের শুভবুদ্ধি জাগ্রত হোক।

লেখক: আইনজীবী

[email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews