অর্থনীতি শাস্ত্রের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, উত্পাদন কী এবং কীভাবে উত্পাদন বাড়ানো যায় তা নির্ধারণ করা। একই সঙ্গে অর্জিত উন্নয়নের সুফল সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বণ্টনের ব্যবস্থা করা। আধুনিক অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, রাষ্ট্র কখনোই ভালো ব্যবসায়ী বা উত্পাদক হতে পারে না। রাষ্ট্রের প্রধান ভূমিকা হবে ভৌত অবকাঠামো বিনির্মাণের মাধ্যমে ব্যক্তি খাতের উন্নয়নের পথ সুগম করা। কারণ রাষ্ট্র যদি উত্পাদকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তাহলে দুর্নীতির প্রাধান্য পরিলক্ষিত হবে, যা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের ধারণার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। রাষ্ট্র ব্যক্তি খাতের উন্নয়নের পথ সুগম করার পাশাপাশি অর্জিত উন্নয়নের সুফল যাতে সমাজের সর্বস্তরে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বণ্টিত হয় তার ব্যবস্থা করা। কিন্তু রাষ্ট্র চাইলেই উন্নয়নের সুফল সমাজের সর্বস্তরে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বণ্টনের ব্যবস্থা করতে পারে না, যদি ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাগণ সদিচ্ছার পরিচয় প্রদান না করেন। এটা সর্বজন স্বীকৃত যে, উন্নয়নের সুফল যদি সমাজের উঁচু স্তরের একটি বিশেষ শ্রেণির হাতে পুঞ্জীভূত হয় তাহলে তাকে কখনোই প্রকৃত এবং সুষম উন্নয়ন বলা যায় না। টেকসই উন্নয়ন তো নয়ই। অর্জিত উন্নয়ন সমাজে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বণ্টিত না হলে সমাজে শ্রেণি বৈষম্য বাড়ে এবং এক সময় নানা রকম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। তাই প্রতিটি সরকারই চেষ্টা করে সর্বাধিক উন্নয়ন অর্জনের পাশাপাশি কীভাবে অর্জিত উন্নয়নের সুফল সমাজের একেবারে নিম্ন স্তর পর্যন্ত পৌঁছানো যায়। উন্নয়নের সুফল যদি সমাজের সর্বস্তরে ন্যায্যতার ভিত্তিতে পৌঁছে দেওয়া যায় তাহলে মানুষের জীবন মান পরিবর্তন এবং গতিশীল করা সম্ভব। এই কঠিন কাজটি কীভাবে করা যায় তা নিয়ে অর্থনীতিবিদগণ বিস্তর গবেষণা করেছেন। উদ্ভাবিত হয়েছে নতুন নতুন থিউরি। এমনই এক থিউরি হচ্ছে ট্রিকেল ডাউন ইকোনমি বা চুইয়ে পড়া অর্থনীতি।
ট্রিকেল ডাউন থিউরির উদ্ভাবক এবং অনুসারীগণ মনে করেন, রাষ্ট্র বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা যদি সমাজের উঁচু স্তরের বিত্তবান ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে বিভিন্ন ধরনের কর মওকুফ, কর অবকাশ সুবিধা প্রদান, বিপণন ক্ষেত্রে সহায়তা করাসহ বিভিন্ন রকম নীতি সাপোর্ট প্রদান করে তাহলে তারা তাদের ব্যাবসায়িক ও উত্পাদন কার্যক্রম সম্প্রসারণ করতে পারবে। উত্পাদনের নতুন নতুন ইউনিট চালু করতে পারবে। এতে দেশের অর্থনীতি যেমন গতিশীল ও সমৃদ্ধ হবে তেমনি নিম্ন স্তরে বাস করা মানুষগুলোর কর্মসংস্থানের চমত্কার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতে সমাজের নিম্ন স্তরে বসবাসরত মানুষ উপকৃত হবে। এই থিউরি হচ্ছে পুঁজিবাদী অর্থনীতির একটি চমত্কার কৌশল যার মাধ্যমে কিছু নির্দিষ্টসংখ্যক ব্যক্তির অনুকূলে রাষ্ট্রীয় সমর্থন ও সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারিত করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই গোষ্ঠী বিশেষের প্রতি রাষ্ট্রের এই সাপোর্ট অনৈতিক ও বৈষম্যমূলক মনে হতে পারে। কিন্তু তারপরও রাষ্ট্র প্রায়শই এমন ধরনের সাপোর্ট দেয় দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রত্যাশায়। এখন প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্র সমাজের উঁচু স্তরে বসবাসরত মুষ্টিমেয় বিত্তবানকে এই সুযোগ দেবে কেন? সাধারণ দরিদ্র মানুষকেও তো এমন সাপোর্ট দিয়ে সমাজের উঁচু স্তরে পৌঁছে দেওয়া যায়। এখানে সমস্যা হচ্ছে, সমাজের নিম্ন স্তরে যে সব দরিদ্র মানুষ বাস করে তাদের অর্থ বা অন্য কোনোভাবে সহায়তা করলেই যে তারা বিত্তবৈভবের মালিক হয়ে উঠতে পারবেন তা নাও হতে পারে। কারণ এক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার একটি ব্যাপার থাকে। এই থিউরির সমর্থকগণ মনে করেন, সরকারের উচিত সমাজের বিত্তবান শ্রেণিকে সার্বিক সাপোর্ট দেওয়া। তাহলে তারা দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে। এতে দীর্ঘ মেয়াদে সমাজের সবাই উপকৃত হবে। এই তত্ত্বটি সাপ্লাই সাইড ইকোনমিক্সের অন্তর্ভুক্ত। এর অনুসারীগণ বিশ্বাস করেন বড় বড় কোম্পানিকে কর হ্রাসসহ নীতি সাপোর্ট দিলে তারা ব্যবসায় সম্প্রসারণ এবং বর্ধিত হারে বিনিয়োগ করতে পারবেন। তারা নতুন ফ্যাক্টরি স্থাপন ও পুরোনো ফ্যাক্টরি আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ করতে পারবেন। নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে। বিত্তবান শ্রেণি বেশি পরিমাণে ব্যয় করতে পারবে। বাজারে প্রচুর পরিমাণ পণ্য ও সেবা পাওয়া যাবে। ভোক্তার হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ অর্থ সঞ্চালিত হলে তারা বেশি বেশি পণ্য ক্রয় করতে পারবে। ফলে অর্থনীতিতে গতিশীলতা সৃষ্টি হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই তত্ত্ব প্রথম অনুসরণ করা হয় ১৯২১ সালে।
ক্লাসিক্যাল ইকোনমিস্টদের ধারণা, পণ্যের জোগান নিজেই তার চাহিদা সৃষ্টি করে। অর্থাত্ বাজারে কোনো পণ্যের উপস্থিতি ঘটলে ভোক্তারা সেই পণ্য ক্রয় করার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠে। কিন্তু এই ধারণা সব সময় সত্যি নয়। কারণ ভোক্তা কোনো পণ্য ক্রয় করবে কি করবে না, তার অনেকটাই নির্ভর করে তার ক্রয়ক্ষমতার ওপর। সীমিত ক্রয় ক্ষমতাবান মানুষ চাইলেই বাজার থেকে বিভিন্ন পণ্য ক্রয় করতে পারেন না। বলা হয়, পণ্য ও সেবার জোগান বৃদ্ধি পেলে উচ্চমাত্রায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। কিন্তু এই ধারণা মোটেও ঠিক নয়। যদি বাজারে কোনো পণ্যের অতিমাত্রায় জোগান থাকে তাহলে সেই পণ্যের মূল্য হ্রাস পাবে। এতে উত্পাদকগণ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রিকেল ডাউন থিউরি সঠিকভাবে কাজ করেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হোভার ১৯৩০ সালের দিকে এই তত্ত্ব তার দেশে প্রয়োগ করেন। সেই সময় মনে করা হয়েছিল ব্যবসায় সমৃদ্ধিতে ইনসেনটিভ দিলে জনগণ উপকৃত হবে। কিন্তু কার্যত বিপরীত ফলই প্রত্যক্ষ করা গেছে। প্রতীয়মান হয়েছে যে, কর হ্রাস ও অন্যান্য নীতি সহায়তার ফলে করপোরেট মুনাফা বৃদ্ধি পেলেও সব সময় কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ, উত্পাদনশীলতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্ভব হয়। বিশ্বব্যাপী যে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় তা প্রতিরোধে এই তত্ত্ব কোনো কাজে আসেনি। সে সময় ডিমান্ড সাইড অর্থনীতির তত্ত্ব জোরদার হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড রিগ্যানের সময় প্রত্যক্ষ করা গেছে যে, কর হ্রাসের ফলে দেশটির কর্মসংস্থান বাড়েনি। সাপ্লাই সাইড পলিসি বিনিয়োগকে দুর্বল করেছে। এ তত্ত্বের অনুসারী রিগ্যান ও বুশের সময়ের তুলনায় পরবর্তী সময়ে অর্থাত্ ১৯৯০-এর দশকে নন-সাপ্লাই সাইড নীতি গ্রহণের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ অনেকটাই বেড়েছে।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা করলে দেখা যাবে, জ্ঞাতসারেই হোক আর অজ্ঞাতসারেই হোক আমরা ট্রিকেল ডাউন ইফেক্ট তত্ত্বটি অনুসরণ করে চলেছে। সমাজের উঁচু স্তরের একটি বিশেষ শ্রেণিকে রাষ্ট্রের তরফ থেকে নানা ধরনের নীতি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। কর অবকাশ ও কর হ্রাস সুবিধাসহ তুলনামূলক স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তি ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমনকি যারা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে তা নির্ধারিত কাজে ব্যবহার না করে অন্য খাতে প্রবাহিত করেছেন অথবা বিদেশে পাচার করেছেন তাদেরও কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। ঋণ খেলাপের অভিযোগে কারখানা বন্ধ হলে কর্মরত বিপুলসংখ্যক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে—এই অজুহাতে কোনো ঋণখেলাপির কারখানা বন্ধ করা হচ্ছে না। যারা নিয়মিত ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন তাদের তেমন কোনো আর্থিক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু যারা ইচ্ছে করে ঋণের কিস্তি আটকে রাখছেন তাদের জন্য উদারভাবে নানা ধরনের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। পণ্য রপ্তানি ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা প্রদান, রপ্তানি ফান্ড গঠন করে আর্থিক সহায়তা প্রদানসহ করপোরেট ট্যাক্স হ্রাস করা হচ্ছে। বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের শাস্তির পরিবর্তে সামান্য কর প্রদান সাপেক্ষে পাচারকৃত অর্থ দেশে আনার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কেউই বিদেশে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনেননি। রাষ্ট্র বৃহত্ কোম্পানির উদ্যোক্তাদের যে সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে তা সঠিকভাবে ব্যবহূত না হওয়ার কারণে দেশে বিদ্যমান কলকারখানা সম্প্রসারিত হচ্ছে না। বরং কোনো কোনো উদ্যোক্তা রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তাদের উপার্জিত অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, দেশে আয় বৈষম্য দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
যারা অর্থ পাচার করেন এবং মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে যুক্ত তারা কখনোই তাদের আয়ের উত্স এবং টাকার পরিমাণ কারো কাছে প্রকাশ করেন না। তাই এ-সংক্রান্ত কোনো পরিসংখ্যানই চূড়ান্ত নয়। তবে পাচারকৃত টাকার অঙ্ক যে বিশাল তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই টাকা যদি পাচার না হয়ে দেশেই ব্যবহূত হতো তাহলে ট্রিকেল ডাউন ইফেক্টের সুফল হয়তো কিছুটা হলেও পাওয়া যেত। বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের দৃশ্যমান বা প্রদর্শিত পরিমাণ হচ্ছে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু প্রকৃত হিসাব প্রকাশ করলে এটা ৩ লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করে যাবে। সিপিডির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতি বছর কর ফাঁকির কারণে দেশ ৪১ হাজার কোটি টাকা থেকে ২ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। একটি দেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও অন্তত ১৫ শতাংশ হওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে এ হার মাত্র ৭ দশমিক ৯ শতাংশ।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা নেটওয়ার্ক আরো জোরদার এবং দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের ব্যাবসায়িক নৈতিকতা বাড়াতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, দেশের অভ্যন্তরে অথবা দেশের বাইরে থেকে যে সম্পদ অর্জিত হবে তার সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
অনুলিখন: এম এ খালেক