২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে দেশে ঐতিহাসিক এক ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান সফল হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে ১ জুলাই থেকে শিক্ষার্থীরা রাজপথে নামে, সেটা শেষ হয় ৫ আগস্ট সরকার পতনের মধ্য দিয়ে। মূলত কোটা সংস্কার ও মেধার ভিত্তিতে সমান সুযোগ প্রতিষ্ঠার দাবিতে এ আন্দোলনের সূত্রপাত হলেও তা দ্রুত সার্বজনীন গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। আন্দোলন চলাকালে পরিস্থিতির বাস্তবতায় আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়, যার মধ্যে বাংলা ব্লকেড অন্যতম। কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে নানামুখী কৌশলের মধ্যে বাংলা ব্লকেড ছিল অন্যতম। ৬ জুলাই তারিখে আনুষ্ঠানিক এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। এ দিন দেশজুড়ে নানা স্থানে সড়ক, রেলপথ ও মেট্রোরেল অবরোধ করে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা।

ঢাকা শহরের শাহবাগ, সায়েন্স ল্যাব, নীলক্ষেত ও মতিঝিলসহ গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রাখে শুধু অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড়, জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা তাঁতীবাজার মোড়, শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করেন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম নগরীর ব্যস্ততম দুই নম্বর গেট মোড়, ময়মনসিংহ শহর এবং কুষ্টিয়া-খুলনা, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-পাবনা ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এদিন শাহবাগ থেকে ‘বাংলা ব্লকেড’ তথা সারা দেশের প্রতিটি পয়েন্ট এবং মহাসড়ক অবরোধ করার আহ্বান জানানো হয়। শিক্ষক ও অভিভাবকদেরও আন্দোলনে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান আন্দোলনকারীরা। এদিন আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দেন দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো। প্রয়োজনে টানা হরতালের ডাক দেবো ।

শাহবাগে অবরোধ ঢাবি শিক্ষার্থীদের : ৬ জুলাই বিকেল ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতিটি হল থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে প্রথমে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জড়ো হন। পরে সেখান থেকে বিশাল মিছিল নিয়ে হলপাড়া-ভিসি চত্বর-টিএসসিত-বকশিবাজার-বুয়েট-ইডেন-হোম ইকোনমিকস-নীলক্ষেত ঘুরে পুনরায় টিএসসি হয়ে বিকেল ৫টায় শাহবাগ মোড়ে গিয়ে অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা।

আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থী মো: সাইফুর রহমান বলেন, বর্তমানে বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর মাঝে কোটার জন্য মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েও একটা চাকরি জোগাড় করা কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে।

অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, এতদিন পুলিশ আমাদের সহযোগিতা করে এসেছে। কিন্তু আজকে পুলিশের একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠী আমাদের ‘ভুয়া’ বলে সম্বোধন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে আঙুল উঁচিয়ে কথা বলেছে। আমার দিকে তেড়ে এসেছে।

তিনি বলেন, পুলিশের সাথে আমাদের যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে সেটি উপেক্ষা করে সুবিধাবাদী কোনো গোষ্ঠী যদি কোনো ফায়দা লোটার চেষ্টা করে তাহলে আমরা তাদের হাত গুঁড়িয়ে দেবো। আজকের মতো কালকেও যদি আমাদের বোনরা আমাদের সাথে দাঁড়িয়ে যায় কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।

সেদিন নাহিদ ইসলাম বলেন, সরকার মনে করেছে আমরা দুই-তিন দিন রাস্তা অবরোধ করে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে যাবো। সরকারের এই ধারণা যে ভুল সেটি আমাদের প্রমাণ করে দিতে হবে। আমরা এখন পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছি, প্রয়োজনে আমরা হরতাল দিতে বাধ্য হবো।

নাহিদ বলেছিলেন, ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, কোটা থাকবে না, সেই কোটা এখন কেন ফিরে এলো এর জবাব চাই। শুধু প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতেই নয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণীর চাকরিতেও কোটার বৈষম্য দূর করতে হবে।

অভিভাবকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনার সন্তানও কিন্তু চাকরি পাবে না যদি কোটা থাকে। আপনাকেও নেমে আসতে হবে। অভিভাবক এবং শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা শাহবাগে এসে আমাদের আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করুন। ক্লাসে না ফেরার ঘোষণা দিয়ে নাহিদ বলেন, শিক্ষকদের আন্দোলন একদিন বন্ধ হয়ে যাবে কিন্তু আমাদের আন্দোলন বন্ধ হবে না। শিক্ষকরা ক্লাসে ফিরে গেলেও দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা ক্লাসে ফিরব না।

তাঁতীবাজার মোড় অবরোধ জবি শিক্ষার্থীদের : রাজধানীর তাঁতীবাজার মোড় অবরোধ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরা। বেলা ৩টায় মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা রায়সাহেব বাজার মোড়ে পৌঁছলে পুলিশ বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। বাধা উপেক্ষা করে তারা তাঁতীবাজার মোড়ে অবস্থান নেয়। এতে গুলিস্তান থেকে বাবুবাজার, সদরঘাট ও যাত্রাবাড়ীগামী যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুই ঘণ্টা পর বিকেল ৫টায় শিক্ষার্থীরা তাঁতীবাজার মোড় ত্যাগ করে মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসে ফেরে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী শাহিন বলেন, আমরা বাংলাদেশে আর বৈষম্য চাই না। দেশের সব মানুষের অধিকারের জন্য আমরা রাজপথে নেমেছি। এক পুলিশ ভাই বলেছে, ‘গুলি করে দেব’, অথচ তার সন্তানদের অধিকারের জন্যই মাঠে নেমেছি আমরা।

ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ : ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক ১ ঘণ্টা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থীরা। বেলা ১১টার দিকে মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে মহাসড়ক অবরোধ করেন তারা। এতে সড়কে যানবাহন চলাচলে বিঘœ ঘটে। পরে দুপুর ১২টায় মিছিল নিয়ে কাজলা গেট হয়ে বেলা ১টা পর্যন্ত প্যারিস রোডে অবস্থান করেন শিক্ষার্থীরা।

বৃষ্টিতে ভিজে সড়ক অবরোধ ইবি শিক্ষার্থীদের : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শিক্ষার্থীরা বৃষ্টিতে ভিজে বেলা ১২টা থেকে কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়ক প্রায় আধা ঘণ্টা অবরোধ করেন। এর আগে বেলা সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে পদযাত্রা বের করেন তারা। এটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণের পর প্রধান ফটক হয়ে শেখপাড়া বাজার ঘুরে আসে।

চট্টগ্রামে দুই নম্বর গেট মোড়ে অবরোধ : শহরের ব্যস্ততম দুই নম্বর গেট মোড় অবরোধ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। বিকেল পৌনে ৫টা থেকে প্রায় এক ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করেন তারা। এর আগে বিকেল ৪টার ট্রেনে ক্যাম্পাস থেকে প্রায় ১৫ কিমি. দূরে নগরের ষোলশহর স্টেশনে আসেন চবি শিক্ষার্থীরা। সেখানে চবি অধিভুক্ত কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে তারা দুই নম্বর গেট মোড়ে যান। ব্যস্ততম সড়কটি অবরোধ করায় ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়।

সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক অবরোধ শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের : শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা বেলা সাড়ে ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকসংলগ্ন সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক অবরোধ করে। এতে দুই পাশে রাস্তায় প্রায় ৫ কিমি. যানজটের সৃষ্টি হয়। আটকে পড়েন হাজারো যাত্রী। বিকেল সোয়া ৫টায় শিক্ষার্থীরা অবরোধ তুলে নেন।

ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ মাভাবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের : ঢাকা-টাঙ্গাইল বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক অবরোধ করেন টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (মাভাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা। বেলা ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত মহাসড়কের নগর জলপাই বাইপাসে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন তারা। এতে মহাসড়কের দুইপাশে প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন : কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) ১১ বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করেন। এর মধ্যে রয়েছে আইন, বাংলা, নৃবিজ্ঞান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, লোক প্রশাসন, প্রতœতত্ত্ব, ব্যবস্থাপনা, মার্কেটিং, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস্, গণিত ও ফার্মেসি বিভাগ।

ঢাকা-পাবনা মহাসড়ক অবরোধ পাবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের : পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (পাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা দুপুর ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ঢাকা-পাবনা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। ঘণ্টাব্যাপী অবরোধে মহাসড়কের দুই পাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে প্রশাসনের অনুরোধে ক্যাম্পাসে ফিরে যান শিক্ষার্থীরা।

ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে অবরোধ-বিক্ষোভ : এ দিন দুপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য অর্জন মোড়ে প্রায় দুই ঘণ্টা ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেন। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন তারা।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মানববন্ধন : ওই দিন সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব চত্বরে মানববন্ধন করেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এ সময় সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ফাহিম মুনতাসির বলেন, যদি মেধাবীদের দেশে রাখতে চান, তাহলে অবশ্যই এই কোটা প্রথা বাতিল করতে হবে।

বশেমুরবিপ্রবিতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন ও অবরোধ : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে সড়ক অবরোধ করেন। বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকসংলগ্ন ঘোনাপাড়া-গোপালগঞ্জ সড়ক অবরোধ করেন তারা। এতে গোপালগঞ্জ শহরমুখী যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews