বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ২ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্রহ্মপুত্রের খনন প্রকল্প করছে। গাইবান্ধা, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর ও কিশোরগঞ্জ– এই পাঁচ জেলায় ব্রহ্মপুত্রের প্রায় ২২৭ কিলোমিটার অংশ খনন করার কথা। কোনো কোনো এলাকায় খনন শেষ (?); কোনো কোনো এলাকায় কাজ চলছে; কোনো কোনো এলাকায় কাজই শুরু হয়নি। পাঁচ বছর মেয়াদি খনন প্রকল্প শেষ হওয়ার পর গত জুন মাস থেকে আরও এক বছর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তাতে ব্রহ্মপুত্রের বিশেষ কোনো উপকার হয়েছে– এমন সাক্ষ্য কেউ দেবে না। নদের নাব্য বা প্রবাহ বাড়েনি। বরং প্রশস্ততা কমেছে। এক-দেড় কিলোমিটার প্রশস্ত এবং একাধিক ধারায় প্রবাহিত বিনুনি নদ ব্রহ্মপুত্রকে ১০০ মিটারের খালে রূপান্তরিত করা হয়েছে। একটি ধারা রেখে অন্যান্য ধারাকে বালু ফেলে ভরাট করা হয়েছে। নদের গতিপথ পরিবর্তন করা হয়েছে। এতে স্বতঃস্ফূর্ত বিনুনি নদের চিরায়ত চরিত্র বদলে ফেলা হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র থেকে উৎসারিত বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা ও খালের মুখ বন্ধ করা হয়েছে। খননের আগে নদের সীমানা নির্ধারণ করা হয়নি। হাজার হাজার দখলদার আছে বহাল তবিয়তে। খননের বালু নদের বুকে রাখার কারণে সেখানে নতুন নতুন দখলদারি চলছে। কোথাও অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি। খননের বালু নামমাত্র মূল্যে সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র খনন এবং বালু ব্যবসা সিন্ডিকেটে যুক্ত পলাতক আওয়ামী লীগ সরকারের একাধিক এমপি, মন্ত্রী ও নেতা। প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিরা এর সুবিধাভোগী। ফলে, ভয়ে মুখ খুলতে সাহস করে না ব্রহ্মপুত্রপারের মানুষ।
বালু সন্ত্রাস বন্ধ হয়নি
ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার উচাখিলা মরিচারচর নামাপাড়ায় প্রায় দুই যুগ ধরে অবৈধ বালু উত্তোলন চলছে। সেখানে ব্রহ্মপুত্রের নতুন আরেকটি ধারা তৈরি হয়েছে অর্ধচন্দ্রাকৃতির। এর ভাঙনে বছর বছর ফসলি জমি, বাড়িঘর বিলীন হচ্ছে। শতাধিক ড্রেজার, ট্রলার, বাল্ক সেখানে গভীর রাত থেকে বালু উত্তোলন ও বহনের কাজ করে। স্থানীয় এলাকাবাসী বারবার প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে দেনদরবার করেছেন। মিছিল-সমাবেশে স্মারকলিপি প্রদান করেছেন। কোনো কাজ হয়নি। সরকার পরিবর্তনেও বালু সন্ত্রাস দূর হয়নি। উল্টো, স্থানীয় জনতা প্রতিবাদ করতে গিয়ে বালু সন্ত্রাসীদের আক্রমণের শিকার হয়েছে বারবার। জানা যায়, শতকোটি টাকার এই অবৈধ বালু ব্যবসার ভাগ যায় উচ্চ মহল পর্যন্ত।
ব্রহ্মপুত্র খনন
চীনসহ অনেক দেশেই নদী খননে রাষ্ট্রের কোনো ব্যয় হয় না। উল্টো রাষ্ট্রের কোষাগারে রাজস্ব জমা হয়। বৈজ্ঞানিক জরিপ চালিয়ে উপযুক্ত পদ্ধতি নির্ধারণ করে পরিমাপ ঠিক করে ব্যবসায়ীদের কাজ দেওয়া হয় খননের। ব্যবসায়ীরা খননের বালু বা মাটির জন্য সরকার নির্ধারিত হারে বিনিময় মূল্য পরিশোধ করেন। বাংলাদেশে বালু এবং মাটির বিপুল চাহিদা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় বিশাল খরচে নদী খনন বা ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প নেওয়া হয়। সে কাজগুলো পায় সরকারেরই ঘনিষ্ঠজন। একেকটা নদী খনন প্রকল্প যেন কাঁচা টাকার মেশিন; দলীয় প্রভাবশালী এবং প্রশাসনের কিছু লোকের পকেট ভারী করার মাধ্যম। সামান্য কিছু খনন করে বাকি টাকা লোপাট করা হয়। খননের বালু নামমাত্র মূল্যে বালু ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিয়ে তাদের বিরাট লাভের সুযোগ করে দেওয়া হয়।
এখন ব্রহ্মপুত্রকে এই মহাবিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে জরুরি ভিত্তিতে চলমান খনন প্রকল্প বাতিল করে উপযুক্ত মহাপরিকল্পনা নেওয়া জরুরি। নদী বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে উচ্চতর একটি কমিটি করে ব্রহ্মপুত্র রক্ষার জাতীয় উদ্যোগ দরকার। পাশাপাশি খননের নামে যারা ব্রহ্মপুত্রকে খাল বানিয়ে টাকা লোপাট করেছে, তাদের বিচার হতে হবে। সেটা ভবিষ্যতে নদী নিয়ে তামাশা বন্ধ করতে সাহায্য করবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের বন্ধ থাকা উৎসমুখ। গাইবান্ধা জেলার যে ১৩-১৪ কিলোমিটার জায়গা ভূমিকম্পের কারণে বন্ধ হয়ে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রে প্রবাহ সংকট তৈরি করেছে, সেই অংশটা খনন করে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে যুক্ত করে দিলেই পুরোনো ব্রহ্মপুত্রে নতুন জীবন আসবে।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন বারবার ব্রহ্মপুত্র দখল করে স্থাপনা করতে চায়। সম্প্রতি ময়মনসিংহ শহরের পাশে ব্রহ্মপুত্র নদের অনেকটা ভেতরে অনেক গণশৌচাগার এবং ট্রান্সফার স্টেশন (শহরের ময়লা-আবর্জনা জড়ো করার বড় ভাগাড়) তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছিল ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন। ১২২ কোটি টাকার এ প্রকল্প একনেকে পাস হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েই জনগণের প্রতিরোধের মুখে স্থগিত হয়। সরেজমিন দেখা যায়, মসিক থ্রি পয়েন্ট মাল্টিরড পাইলিং করেছে, যা বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে করা হয়ে থাকে। ২০২২ সালে সংস্থাটি শহরের কাচারিঘাটে ব্রহ্মপুত্রের গভীর পর্যন্ত কংক্রিটের সড়ক তৈরি করেছে। একই সঙ্গে বিসর্জনের পাকাঘাট এবং কাচারিঘাট থেকে চায়না ব্রিজ পর্যন্ত নদীর মাঝ বরাবর একটি বড় সড়ক তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছিল। তখনও ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলন নাগরিকদের নিয়ে আন্দোলন করে নদবিধ্বংসী প্রকল্পটির বাস্তবায়ন বন্ধ করেছিল।
ব্রহ্মপুত্রের অনেক জায়গাজুড়ে নজর পড়েছে ভূমিদস্যুদের। ময়মনসিংহ শহরের পাশে ব্রহ্মপুত্রের বুক দখল করে কয়েকশ একর জায়গা দখল করা তাদের মহাপরিকল্পনা। স্থানীয় কিছু সামাজিক- সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারাও এর সঙ্গে জড়িত। সিটি করপোরেশন এ ক্ষেত্রে সহায়ক।
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে মানুষের মনে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। ফ্যাসিবাদের আগ্রাসনে বাংলাদেশের বিপন্ন নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয়, বন-পাহাড় রক্ষা পাবে– এই আশা যেন হতাশায় নিমজ্জিত না হয়। পুরোনো ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার কৃষি-কৃষ্টি, জীবন-জীবিকা নির্ভর করে ব্রহ্মপুত্রের ওপর। অতএব, ব্রহ্মপুত্রকে বাঁচান।
আবুল কালাম আল আজাদ: লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট; সমন্বয়ক, ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলন
azad.look@gmail.com