স্বাস্থ্য মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন একটি দেশের উন্নতির প্রধান মাপকাঠি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশে সুষ্ঠু চিকিৎসার অভাবে সাধারণ মানুষের জীবনমান মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। দেশের শহর ও গ্রামে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে যে অসামঞ্জস্য ও অব্যবস্থাপনা বিদ্যমান, তা সাধারণ মানুষের ভোগান্তির অন্যতম প্রধান কারণ।

চিকিৎসা সেবার বর্তমান চিত্র

বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের চিকিৎসাসেবা বিদ্যমান। তবে সরকারি চিকিৎসাসেবা সাধারণ মানুষের জন্য সুলভ হলেও তা অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রতুল। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর অবস্থা অত্যন্ত করুণ।

প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব, চিকিৎসকের সংকট এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতা সাধারণ রোগীদের জন্য চিকিৎসা পাওয়া দুষ্কর করে তুলেছে। অন্যদিকে বেসরকারি চিকিৎসা খাতে খরচ এত বেশি যে দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষের পক্ষে তা বহন করা প্রায় অসম্ভব।

রাজধানীর সাতারকুলে ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে পাঁচ বছর বয়সী শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় দুই চিকিৎসক ও হাসপাতালের দায় পেয়েছে তদন্ত কমিটি। মাদারীপুর শিবচরে ভুল চিকিৎসায় পলি আক্তার (৩০) নামে এক রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে (৮ জানুয়ারি, ২০২৪)।

গত বছরে নাকের পলিপ অপারেশন করাতে গিয়ে রাজধানীর গ্রিন রোডের কমফোর্ট হাসপাতালে চিকিৎসকদের ভুল চিকিৎসার কারণে এক রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিক্যাল চেকআপ সেন্টারে আহনাফ তাহমিদ (১০) নামের এক শিশুর খতনা করাতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে।

স্বজনদের অভিযোগ, লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া (আংশিক অচেতন) দেওয়ার কথা থাকলেও আহনাফকে দেওয়া হয় ফুল অ্যানেস্থেসিয়া। শিশুটির আর জ্ঞান ফিরে আসেনি।

এর আগে আয়ান আহমেদ নামে আরও এক শিশুর এভাবে মৃত্যু হয়েছিল। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর সাঁতারকুলের ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে খতনার জন্য অজ্ঞান করা হয়েছিল আয়ানকে। খতনা করানোর পর ১১ ঘণ্টায়ও তার সংজ্ঞা না ফিরলে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে এনে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। সাত দিন সেখানে থাকার পর গত ৭ জানুয়ারি আয়ানকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

শিশুটির পরিবারের অভিযোগ ছিল, আংশিক অচেতন করে খতনা করানোর কথা থাকলেও চিকিৎসকরা আয়ানকে পুরোপুরি অজ্ঞান করেছিল। গত বছর ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে মৃত্যু হয় এক তরুণের।

সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, এন্ডোস্কোপি করাতে গিয়ে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাহিব রেজা (৩১) নামে ওই তরুণের মৃত্যু হয়। স্বজনদের অভিযোগ, ল্যাবএইড হাসপাতালে পরীক্ষার রিপোর্ট না দেখেই রাহিবকে অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়া হয়েছিল।

শারীরিক জটিলতার মধ্যেই এন্ডোস্কোপি করা হয়। যে কারণে তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় এবং একপর্যায়ে শারীরিক অবস্থা আরও জটিল হয়ে মারা যান তিনি। গত বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হয় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাহেদ আহমদ (৪০)।

সুষ্ঠু চিকিৎসার অভাবের কারণ

১. অপর্যাপ্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী : দেশের অনেক সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসক ও নার্সের সংখ্যা কম। চিকিৎসাসেবার মান বজায় রাখার জন্য যে সংখ্যক জনবল প্রয়োজন, তা অনেক হাসপাতালেই নেই।

২. অপ্রতুল অবকাঠামো : গ্রামীণ হাসপাতালগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব ও প্রয়োজনীয় ওষুধের ঘাটতি রয়েছে। ফলে রোগীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য শহরে আসতে বাধ্য হতে হয়।

৩. চিকিৎসার ব্যয়ের অসামঞ্জস্য : বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর উচ্চ ব্যয় সাধারণ মানুষের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

৪. দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা : স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার ফলে সঠিক সময়ে সেবা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

৫. সচেতনতার অভাব : সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা ও প্রাথমিক চিকিৎসা জ্ঞানের অভাবও চিকিৎসা সংকট বাড়িয়ে তোলে।

ভোগান্তির প্রভাব

সুষ্ঠু চিকিৎসার অভাবে সাধারণ মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক রোগী সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করছে। অসুস্থতার কারণে অনেক পরিবার আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এর পাশাপাশি, গ্রামীণ এলাকা থেকে শহরে চিকিৎসার জন্য ছুটে আসা মানুষের ভিড় শহরের চিকিৎসা ব্যবস্থায় অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে।

সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে রোগীরা গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটায়। চিকিৎসার জন্য উচ্চ ব্যয়ের কারণে অনেক পরিবার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

চিকিৎসার খরচ মেটাতে অনেকেই জমি বিক্রি বা ঋণ নিতে বাধ্য হয়, যা তাদের আর্থিক অবস্থাকে আরও দুর্বল করে তোলে। একজন রোগীর চিকিৎসার খরচের বোঝা পুরো পরিবারের ওপর পড়ে। এতে পারিবারিক অস্থিরতা ও মনোমালিন্য দেখা দেয়।

অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের কর্মক্ষম সদস্যের অসুস্থতা পুরো পরিবারকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটে ফেলে দেয়। চিকিৎসা না পেয়ে রোগীরা দীর্ঘদিন কাজ করতে অক্ষম হয়। ফলে ব্যক্তির উৎপাদনশীলতা কমে যায় এবং দেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

গ্রামীণ এলাকার মানুষ উন্নত চিকিৎসার জন্য শহরে আসতে বাধ্য হয়। এতে শহরের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে এবং গ্রামীণ ও শহুরে মানুষের মধ্যে চিকিৎসা সেবার বৈষম্য আরও প্রকট হয়। চিকিৎসার অভাব রোগী এবং তার পরিবারের মধ্যে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।

সঠিক সেবা না পেলে রোগীর আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং হতাশা সৃষ্টি হয়। সুষ্ঠু চিকিৎসার অভাবে নবজাতক ও প্রসূতিদের সঠিক সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। যার ফলে শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার বাড়ে। স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে।

একটি অসুস্থ জনগোষ্ঠী কখনই দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে পারে না। সুষ্ঠু চিকিৎসার অভাবে সৃষ্ট ভোগান্তির প্রভাব শুধু ব্যক্তিগত জীবনে নয়, সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, যাতে মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন সম্ভব হয়।

সমাধানের উপায়

১. সরকারি উদ্যোগ বৃদ্ধি : গ্রামীণ ও শহুরে এলাকাগুলোতে হাসপাতালের সংখ্যা বৃদ্ধি ও আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

২. স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ : নতুন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের পাশাপাশি তাদের মানসম্মত প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

৩. চিকিৎসার ব্যয় কমানো : সাধারণ মানুষের জন্য চিকিৎসা সেবা সাশ্রয়ী করতে সরকারি উদ্যোগ বাড়াতে হবে।

৪. দুর্নীতি দমন : স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি।

৫. সচেতনতা বৃদ্ধি : জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য জাতীয় পর্যায়ে প্রচারণা চালানো প্রয়োজন।

চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে অনেক দেশে টর্ট আইনে মামলা করা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের আদালত নেই। ফলে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতে অভিযুক্ত চিকিৎসকের শাস্তি চেয়ে বা ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে হয়।

এজন্য সুনির্দিষ্ট আইন নেই। ফলে কোন কোন কাজগুলো চিকিৎসায় অবহেলা হিসেবে গণ্য হবে এবং অবহেলার প্রমাণ পেলে কখন দেওয়ানি বা কখন ফৌজদারি মামলা করা যাবে; কী পরিমাণ শাস্তি বা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে; সেসব বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই।

তবে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩০৪ (এ) ধারামতে, কোনো ব্যক্তি বেপরোয়াভাবে বা অবহেলাজনিত কোনো কাজের মাধ্যমে কারও মৃত্যু ঘটালে এবং সেই অপরাধ শাস্তিযোগ্য নরহত্যা না হলে; সেই ব্যক্তি অবহেলাকারী হিসেবে বিবেচিত হবেন।

সুষ্ঠু চিকিৎসার অভাব সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে। এই সংকট সমাধানে সরকারি ও বেসরকারি উভয় পক্ষের সম্মিলিত উদ্যোগ অপরিহার্য। স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা একটি রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব।

শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews