কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে ২৬ পর্যটক ও পর্যটকবাহী টাট্টু ঘোড়ার একজন চালক হত্যাকা-ের পর ফুঁসে উঠে ভারত। পাকিস্তানের দিকে আঙ্গুল তুলে জানায়, এ হত্যাকা-ের জন্য পাকিস্তানই দায়ী। ভারতের এ অন্যায় দাবি পাকিস্তান অস্বীকার করে। দুই দেশের সরকার চরম উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পাশাপাশি সীমান্তে গোলাগুলি ও ড্রোন টহল বাড়ায়। এ নিয়ে শেষ পর্যন্ত দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

এতদিন তারা কূটনৈতিক তৎপরতার মৃত্যু ঘটিয়ে পরস্পর পরস্পরকে কড়া ভাষায় যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছিল। গত ৩০ এপ্রিল স্কার্দু ও গিলগিটগামী ১০টি ফ্লাইট বাতিল করে এবং আকাশসীমা লঙ্ঘন করায় অধিকৃত কাশ্মীরে টহলরত ভারতের দুটো কোয়াডকপ্টার গুলি করে ভূপতিত করে এবং চারটি রাফাল যুদ্ধবিমানকে শনাক্ত ও তাড়া করে পিছু হটিয়ে দেয় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর পিএএফ জেটগুলো। সব ছাপিয়ে গত ৬ মে দুই দেশের মধ্যে তীব্র আকাশযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ভারতীয় বিমান হামলার বিরুদ্ধে পাকিস্তান পাল্টা হামলা চালিয়ে পাঁচটি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান ও একটি ড্রোনকে ভূপাতিত করেছে।

এক সপ্তাহ পূর্বে ভারত আগামী ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে পহেলগাঁও হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানে আক্রমণ করতে চেয়েছিল। ভারত একটি ইট ছুঁড়লে পাকিস্তান পাথর ছুঁড়ে সেটার জবাব দেবার জন্য প্রস্তুত রয়েছে বলে পাল্টা জবাব শোনা গিয়েছিল পাকিস্তানের বিবৃতিতে। পাকিস্তান বলেছিল, সে আগে হামলা করবে না। তবে হামলা হলে তার পাল্টা সমুচিত জবাব দিতে প্রস্তুত। পাকিস্তান আরো বলেছিল, তাদের কেউ পহেলগাঁও হত্যাকা-ে জড়িত নয়। সন্ত্রাসীদের বিস্ফোরক দিয়েছে ভারত। এছাড়া কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে অতীতের সিন্ধু নদীর পানির স্রোত উজান থেকে ভাটিতে গড়ানোর ভারতের চুক্তিভঙ্গের সমস্যা থেকে এখন দু’দেশের মধ্যে পরমাণু যুদ্ধের পদধ্বনি আসন্ন হয়েছে বলে সারা বিশ্বে গুঞ্জন শুরু হয়েছে।

এই লেখকের শৈশবে যখন বই পড়া, পত্রিকার পাতার ছবি দেখা ও রেডিওতে সংবাদ শোনার জ্ঞান হয়েছিল তখন থেকে ভূস্বর্গ কাশ্মীর নিয়ে অনেক কৌতূহল ছিল। এরপর সমস্যাবহুল কাশ্মীরে ভয়ংকর যুদ্ধ চলাকালেও কেন গোটা পৃথিবীর পর্যটককে আকর্ষণ করে তা নিয়ে অনেক জিজ্ঞাসা ছিল। যদিও অনেকে বলেছেন, ভারত-পাকিস্তান চির বৈরীতার এরকম সীমান্ত হত্যাকা-ের ঘটনা নতুন কিছু নয়। তবে কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে হঠাৎ ২৬ জন নিহত হবার পর থেকে সেই কৌতূহলের মাত্রা শীতল থেকে অতি উষ্ণ হয়ে উঠেছে।

পাকিস্তান বলেছে, বহুদিন ধরে সিন্ধু নদীর পানি চুক্তি বাতিল করার পাঁয়তারা করে আসছিল ভারত। সেজন্য একটি উস্কানি খুঁজছিল তারা। পহেলগাঁও হত্যাকা-কে এর সেই উস্কানি হিসেবে ধরে নেয়া হচ্ছে। এটাকে ভারতের সাজানো নাটক হিসেবে মনে করছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেছেন, ‘ভারত যদি একটি ইট ছুড়ে, আমরা জবাবে ছুড়ব পাথর।’ তাঁর দাবি, পহেলগাঁওয়ের হামলার ঘটনাকে ভিত্তি করে ভারত ‘সাজানো নাটক’ তৈরি করছে। এর মাধ্যমে তারা ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানি চুক্তি বাতিলের পথ খুঁজছে। তবে পাকিস্তান এই চুক্তি বাতিল মেনে নেবে না। বলেন, ‘ভারত একতরফাভাবে এই চুক্তি বাতিল করতে পারে না।’ পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘আমাদের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি সৃষ্টি হলে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের দ্বিধা থাকবে না।’

ভারতের পক্ষেও এসেছে কড়া বার্তা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের তিন বাহিনীর প্রধান, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা। মোদি বৈঠকে সশস্ত্র বাহিনীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। বলেছেন, কোথায়, কীভাবে জবাব দিতে হবে, সে সিদ্ধান্ত তারাই নেবে। বলা হচ্ছে, সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাটনই ভারতের জাতীয় সংকল্প। জরুরি বৈঠক করে পাকিস্তান তাদের সেনাবাহিনীকে ভারতের হামলার উপযুক্ত জবাব দিতে অনুমতি দিয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে শুরু হয়েছে তীব্র আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণ।

ভারত-পাকিস্তান উভয়ই পারমাণবিক শক্তিধর বিধায় পারমাণবিক হুমকি দিয়ে পরস্পরের সাথে টেক্কা দিয়ে কথা বলতে ভালবাসে। তারা পরস্পরের সঙ্গে লাগতে যাচ্ছে কিন্তু ভুলে যাচ্ছে সেটা নিজেদের জীবনকে বাজি রেখেই।

বিষেøষকগণ বলেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের ধনী সব মুসলিমের দেশে পাকিস্তানী ও ভারতীয়রা কামলা খাটে এবং সেই কামলা খাটার টাকায় তাদের দেশ চলে। ওয়েজ আর্নিং নির্ভর এই দুই দেশ যদি পরস্পরের বিরুদ্ধে পারমাণবিক আক্রমণ চালায় তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি কি আঙ্গুল চুষবে? ওদের সব কামলাকে ঘাড় ধরে যদি বের করে দেয় তাহলে তো না-খেয়ে মরতে হবে তাদেরকে।’

পাকিস্তানীরা অনেকটাই আনপ্রেডিকেটবল। এর কারণে তাদের ১৯৬৫, ১৯৭১ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ও অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, চীন ও তুরস্ক তাদের সাথে আছে।’ ভারতও তার সাথে পশ্চিমা-ইসরাইলি ব্লক থাকার কথা বলতে দেরী করছে না। তবে যদি পশ্চিমা চাটুকার, স্বার্থপর, অস্ত্রবিক্রেতাদের সাহসে বলিয়ান হয়ে আক্রমণ জোরদার করেই বসে তবে বলা চলে ভারত নামের রাষ্ট্রটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে।

হঠকারী যুদ্ধ সব সময় সকলের জন্য ক্ষতিকর। নির্ভরযোগ্য প্রমাণ না দিয়ে ভারত যুদ্ধ বাঁধাতে চায় বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে প্রমাণের দাবি জানানো হয়েছিল। কারণ, যে কোনো প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের প্রথম শর্ত হলো, নির্ভরযোগ্য প্রমাণ। মোদি সরকার ২০১৯ সালে কাশ্মীর সরাসরি শাসনের আওতায় এনে শান্তি আনার অঙ্গীকার করেছিল। সেই শান্তির কথা চূর্ণ হয়েছে পহেলগাঁও হত্যাকা-ের মাধ্যমে। এমতাবস্থায়, তিনি রাজনৈতিকভাবে চাপ অনুভব করলেও নিজেকে কিছুটা শক্তিশালী নেতা দেখাতে ‘প্রতিশোধ’ নেয়ার পদক্ষেপ নিয়ে থাকতে পারেন।

এক্ষেত্রে ভারত সীমিত সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখালেও তা দ্রুত বিস্তৃত হতে সময় নেবে না। হামলার প্রকৃত উৎস নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত উভয় দেশকে সংযত থাকতে পরামর্শ দিয়েছিলেন অনেকে। তবে কে শোনে কার কথা! এছাড়া ভারত তার নিকট প্রতিবেশীদের সাথে পানি, সীমান্ত ইত্যাদি নিয়ে সবসময় সদ্ভাব বজায় রাখার পরিবর্তে সমস্যা তৈরিতে বেশি পারঙ্গম, যদিও নিকট ও ছোট প্রতিবেশীরা ভারতের কোনো ক্ষতি সাধন করে না। বাস্তবিক অর্থে ভারতের স্মরণ রাখা উচিত, তার প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামাবাদ নয়, কাঠমান্ডু, ঢাকা বা মালে নয়। তাই, এখন পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করাটা প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য চরম ক্ষতিকর এবং এটা ভারতের জন্য বুমেরাং হতে পারে।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন।
E-mail: [email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews