চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় পুলিশের অবহেলাকে দুষছেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নেতারা। চট্টগ্রাম আদালতের ১৮৬ বছরের ইতিহাসে কোনো আসামির জামিন না দেওয়াকে কেন্দ্র করে আইনজীবী হত্যার মতো এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা আর ঘটেনি। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আরও কঠোর হলে এ পরিস্থিতি এড়ানো যেত। পুলিশ শুরু থেকে ঢিলেঢালাভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন বলে তারা মন্তব্য করেন। যে কারণে আশপাশে পুলিশের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও আইনজীবীকে হত্যা করে ঘাতকরা বীরদর্পে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। এদিকে, বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিনের মতো চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যার বিচার চেয়ে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন আইনজীবীরা। তাদের সঙ্গে যোগ দেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্রছাত্রীরা। আইনজীবী সমিতির বর্জন কর্মসূচির কারণে ৭৪টি আদালতের কোথাও বিচার কার্যক্রম চলেনি। আইনজীবী হত্যার ঘটনায় রাজিব ভট্টাচার্য নামে আরও একজনকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। কারাগারে ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী সুস্থ স্বাভাবিক আছেন। তাকে ডিভিশন দেওয়া হয়েছে। এদিকে চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফজলুল কাদের চৌধুরীকে বৃহস্পতিবার ডিবি বন্দর বিভাগে বদলি করা হয়েছে। আর সিটিএসবির ইনস্পেক্টর আব্দুল করিমকে বদলি করা হয়েছে কোতোয়ালি থানার ওসি হিসাবে।

বৃহস্পতিবার আইনজীবীদের সঙ্গে আদালতে আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় (আইআইইউ) চট্টগ্রামের ল’ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগেও মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। মানববন্ধনে জেলা আইনজীবী সমিতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী, নিপীড়নবিরোধী আইনজীবী সমাজসহ বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরাও যোগ দেন।

আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট নাজিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আজ আমরা দুঃখ-ভারাক্রান্ত। আমরা একটি কঠিন সময়ের মধ্যে রয়েছি। ইসকনের এক সন্ত্রাসী নেতাকে গ্রেফতার করে আদালতে তোলার পর বিজ্ঞ আদালত কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিলেন। তাকে প্রিজন ভ্যানে তোলা হলো। আমরা পরবর্তীতে দেখলাম তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম। ওই প্রিজন ভ্যানে তোলার পর ইসকন সমর্থিত সন্ত্রাসীরা ভ্যান ঘেরাও করে আদালত অঙ্গনে উল্লাস করেছে। আমরা পুলিশকে দেখেছিলাম নিষ্ক্রিয়। তারা নিরাপদ স্থানে দূরে দাঁড়িয়েছিল। এটার পেছনে পুলিশের ইন্ধন আছে বলে আমরা মনে করি।

পুলিশ কমিশনারকে উদ্দেশ করে আইনজীবী সমিতির এই শীর্ষ নেতা বলেন, চিন্ময় দাসের হাতে হ্যান্ডমাইক কিভাবে গেল। এর জবাব দিতে হবে। না হলে পুলিশ কমিশনার চট্টগ্রামে থাকতে পারবেন না। আমরা পুলিশ কমিশনারকে চাই না। জুলাই ৩৬ এ অনেক রক্ত ঝরেছে। অনেকে শহিদ হয়েছেন। শহিদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা যাবে না। আমরা সব জানি, চিনি। পুলিশ প্রশাসন এখনো বসে আছে। আপনাদের হুঁশিয়ার করছি, আপনারা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করুন। না হয় আমরা গিয়ে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে ফেলব।

তবে সিএমপির এডিসি (গণমাধ্যম) কাজী তারেক আজিজ যুগান্তরকে বলেন, পুলিশ পেশাদারত্বের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। দায়িত্বে অবহেলার প্রশ্নই ওঠে না।

কোন ধারায় চিন্ময়কে ডিভিশন দেওয়া হয়েছে জানতে চেয়ে আইনজীবী নেতা নাজিম উদ্দীন বলেন, আমরা জানতে পেরেছি চিন্ময় দাসকে ডিভিশন দেওয়া হয়েছে। জেল কোডের কোন নিয়ম এবং আইনের কোন ধারা অনুযায়ী আপনি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামিকে ডিভিশন দিয়েছেন? জেল সুপার এবং সিনিয়র জেল সুপারকে অনুরোধ করব আপনি চিন্ময়ের ডিভিশন প্রত্যাহার করবেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ল’ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাফর ইকবাল বলেন, আমরা আমাদের ভাইকে হারিয়েছি। চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ের ১৮৬ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা এটি। আমার ভাইয়ের রক্তে আজ আমাদের আদালত অঙ্গন লাল হয়ে গেছে। আমরা মানুষকে ইনসাফ দিই, অথচ আমরা আজ জুলুমের শিকার হয়েছি। আমরা তার দুই বছরের শিশুপুত্রকে কী জবাব দেব?

পুলিশের ওপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর ও সরকারি কাজে বাধাদানসহ একাধিক অপরাধে তিনটি পৃথক মামলায় ৭৭ জনের নাম উল্লেখসহ ১ হাজার ৪০০ জনকে আসামি করে কোতোয়ালি থানায় মামলা করা হয়েছে। বুধবার রাতে দায়ের করা এ মামলায় আরও একজনকে গ্রেফতার করেছে সিএমপির গোয়েন্দা পুলিশ-ডিবি। তার নাম রাজিব ভট্টাচার্য। এ নিয়ে ওই ঘটনায় ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হলো। যার মধ্যে ভিডিও ফুটেজ দেখে ৭ জনকে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত বলে শনাক্ত করা হয়েছে। তবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আইনজীবী হত্যার ঘটনায় কোনো হত্যা মামলা হয়নি। বৃহস্পতিবার রাতে অথবা আজ শুক্রবার কোতোয়ালি থানায় মামলাটি দায়ের হতে পারে। আইনজীবীদের একটি টিম হত্যা মামলার এজাহার প্রস্তুত করতে কাজ করছেন বলে জানা গেছে।

আরও এক ঘাতক গ্রেফতার : আইনজীবীকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় আরও একজনকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ-ডিবি। তার নাম রাজিব ভট্টাচার্য। বুধবার রাতে কোতোয়ালি থানার জেল রোড এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। রাজিব ফটিকছড়ির আবদুল্লাহপুর গ্রামের মৃত সুনীল ভট্টাচার্যের ছেলে। তার বাসা কোতোয়ালি থানার বান্ডেল রোড এলাকায়। সেখানে তিনি ভাড়ায় থাকেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এডিসি (গণসংযোগ) কাজী মো. তারেক আজিজ।

গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, আইনজীবীকে হত্যার ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে রাজিব নামে ওই যুবকের ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এরপর গোয়েন্দা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে মাঠে নামে। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে তাকে জেল রোড এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পরপরই তাকে কোতোয়ালি থানায় হস্তান্তর করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

সিএমপির সর্বশেষ তথ্যমতে, ইসকনের কর্মীরা কোতোয়ালি থানার আদালত প্রাঙ্গণ, রঙ্গম সিনেমা হল এবং কোতোয়ালি মোড়-এই তিন এলাকায় পুলিশের ওপর হামলা এবং গাড়ি ভাঙচুর করেছে। তিন ঘটনায় পৃথকভাবে কোতোয়ালি থানা পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি মামলা করেছে। আদালত প্রাঙ্গণে হামলার ঘটনায় ৪৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৬০০-৭০০ জন, রঙ্গম সিনেমা হলের সামনে সংঘর্ষের ঘটনায় ১৪ জনকে এজাহারনামীয় করে অজ্ঞাত ৩০০ থেকে ৪০০ জন এবং কোতোয়ালি মোড়ের ঘটনায় ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ২৫০-৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

কারাগারে সুস্থ রয়েছেন চিন্ময় : চট্টগ্রাম কারাগারে সুস্থ ও স্বাভাবিক রয়েছেন বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ও ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী তাকে খাবার দেওয়া হচ্ছে। তিনি নিয়মিত খাবার খাচ্ছেন, ঘুমাচ্ছেন। কারাগারে শীর্ষ কর্মকর্তারা তার বিষয়ে তদারকি করছেন। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ইকবাল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘বন্দি চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রক্ষ্মচারী ভালো ও সুস্থ আছেন। নিরাপদে আছেন। কারাবিধি অনুযায়ী সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী খাবার দেওয়া হচ্ছে। আদালতের আদেশের কপি পাওয়ার পর তাকে ডিভিশন দেওয়া হয়েছে।

মঙ্গলবার বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন চলাকালে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। চট্টগ্রাম আদালত ভবনের অদূরে রঙ্গম সিনেমা হলের গলিতে প্রকাশ্যে নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews