গত দুই সপ্তাহ ধরে বাজারে অন্যতম আলোচিত বিষয় হয়েছে ডলারের ঘাটতি, ঊর্ধ্বমূল্য এবং ও মূল্যস্ফীতি। প্রবাসী আয় কমার পাশাপাশি আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দেশে ডলারের চাহিদা হঠাত্ করেই বেড়েছে। মুদ্রাবাজারের এই অস্হিরতার কারণে অর্থনীতিতে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে মূল্যস্ফীতিও বেড়ে যাবে।

কয়েক দিন ধরেই কার্ব মার্কেটে (খোলাবাজারে) ডলারের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৭ মে প্রথম বারের মতো অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ডলারের দাম ১০০ টাকা ছাড়িয়ে প্রতি ডলার ১০০ থেকে ১০২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে এখন খোলাবাজারে ডলারের মূল্য আগের চেয়ে কিছুটা কমে ৯৯ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ গত ২৩ মে প্রতি ডলার ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা বেঁধে দিলেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তা মানছে না। ব্যাংকে এলসি করতে গেলে ডলারের বিপরীতে নেওয়া হচ্ছে ৯২ থেকে ৯৬ টাকা, কোনো কোনো গ্রাহককে ৯৭ টাকাও দিতে হচ্ছে। ফলে আমদানিতে প্রতি ডলারের জন্য এখন গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ। এতে চাপে পড়েছেন ছোট ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে আমদানিকারকেরা। যেসব ব্যবসায়ীর রপ্তানি আয় নেই, কিন্তু আমদানি করতে হয়, তারা আরো বেশি সমস্যায় পড়েছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে রপ্তানির তুলনায় আমদানি অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। বিশেষ করে ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি, ভোগ্যপণ্য, মূলধনি যন্ত্র ও কাঁচামালের দাম বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে জাহাজভাড়াও। ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) আমদানি খরচ বেড়েছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। তবে খরচ যে হারে বেড়েছে, রপ্তানি সে হারে বাড়েনি; বরং প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স কমছে। আয় দিয়ে ব্যয় মিটছে না। প্রতি মাসে ঘাটতি হচ্ছে ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলার। এর সঙ্গে আছে বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ। এসব সংকটে বাড়ছে ডলারের দাম, আর চাহিদা মেটাতে গিয়ে কমছে রিজার্ভ। এতে করে ডলারের চাহিদা বেড়েছে, টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। ফলে মূল্যস্ফীতিও বাড়ছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, প্রবাসী আয়ে নিম্নগতি ও উচ্চ আমদানি ব্যয়ের কারণে আমাদের রেকর্ড ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে ডলারের দাম বাড়ছে। সাধারণত টাকার মান কমানো হলে রপ্তানিকারকরা উত্সাহিত হন। কারণ, আগের তুলনায় প্রতি ডলারে বেশি স্থানীয় মুদ্রা পাওয়া যায়। আর টাকার অবমূল্যায়ন করলে আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ায় টাকার অবমূল্যায়নে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। তবে দেশের যে রপ্তানি পণ্য সেগুলোর বেশির ভাগ আমদানি পণ্যনির্ভর। তাই ডলারের দাম বাড়লে রপ্তানিতে সুখবর নেই। বরং উত্পাদিত পণ্যের খরচ বেড়ে যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে রপ্তানি বেড়েছে ৩২ দশমিক ৯২ শতাংশ। একই সময়ে আমদানি বেড়েছে ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে রপ্তানি আয় হযেছে ৩ হাজার ৬৬২ কোটি ডলার। একই সময়ে আমদানির ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ১৫২ কোটি ডলার। এই সময়ে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ২ হাজার ৪৯০ কোটি ডলার।

ব্যবসায়ীদের মতো স্বস্তি ও অস্বস্তি আছে ব্যাংকগুলোতেও। যেসব ব্যাংকের আমদানি দায়ের চেয়ে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বেশি, তারা স্বস্তিতে আছে। বিশেষ করে কয়েকটি বড় ব্যাংক। আর যাদের আমদানি খরচ বেশি, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কম, তারা অস্বস্তিতে আছে।

ডলারের দাম যাতে না বাড়ে, সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক তদারকি জোরদার করেছে, ব্যাংকগুলো কত দামে প্রবাসী আয় আনতে পারবে ও রপ্তানি বিল নগদায়ন করতে পারবে, তা বেঁধে দিচ্ছে। একইভাবে আমদানি বিলের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে। তবে কোনো ব্যাংক এই দামে ডলার লেনদেন করতে পারছে না। ব্যাংকাররা বলছেন, বিভিন্ন উদ্যোগের পরও ডলারের বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। ৯৭ টাকা দরেও আমদানি বিল সমন্বয় করতে হচ্ছে। প্রবাসী আয় ও রপ্তানি বিলেও কাছাকাছি দাম দিতে হচ্ছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া বিনিময় মূল্যের চেয়ে ১০ টাকা বেশি। এই চাপের কারণে ডলারের আন্তঃব্যাংক লেনদেন প্রায় স্হবির।

ব্যাংকাররা পরামর্শ দিচ্ছেন, যারা বিদেশ সফরে যেতে চান, তারা যেন নগদ ডলারের পরিবর্তে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন। কারণ, ব্যাংকের কার্ডের মাধ্যমে খরচে প্রতি ডলারের দাম ৮৮ টাকার নিচে। দেশে এখন আমদানির জন্য যে পরিমাণ অর্থ বা ডলার খরচ হচ্ছে, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স দিয়ে তা মিটছে না। এর ফলে সংকট তৈরি হয়েছে। আমদানি দায় মেটাতে রিজার্ভ থেকে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে রিজার্ভও কমছে। রিজার্ভ কমে এখন দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারে। আর ডলারের বিনিময় মূল্য ধীরে ধীরে বাড়ছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রপ্তানির তুলনায় আমদানির ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ডলারের চাহিদা বাড়ছে। ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার সরবরাহ করছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের গত ১৮ মে পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ৫ বিলিয়নের বেশি ডলার বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বিক্রি করেছে। অথচ ২০২০-২১ অর্থবছরে টাকার মান ধরে রাখতে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ২৪ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ রেকর্ড পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল। বর্তমানে তা কমে গত ১১ মে ৪১ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন নেমে এসেছে। এখন দেশে যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে, তা দিয়ে সাড়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় নির্বাহ করা যাবে। আগে এটা ছিল আট মাসেরও বেশি।

পরিস্হিতি সামাল দিতে বিলাসবহুল গাড়ি ও ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানিতে ৭০ শতাংশ নগদ জমার বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ সফর বন্ধ করেছে সরকার। ইতিমধ্যে বিলাস পণ্য আমদানিতে লাগাম টানা শুরু হয়েছে। বাজেটের আগেই প্রসাধনসামগ্রী, ফল, ফুল এবং আসবাব আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) বাড়িয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাতারাতি রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়ানো সম্ভব নয়। আবার ডলারের দাম বাড়ালে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তারও কোনো নিশ্চয়তাও নেই। আবার ডলারের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। এমন পরিস্হিতিতে আমদানি খরচে লাগাম টানতে হবে। পাশাপাশি রেমিট্যান্স বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews