একসময় পৃথিবীতে শক্তিই ছিল সব ক্ষমতার উৎস। ‘জোর যার মুল্লুক তার’-এই প্রবাদটির কার্যকারিতা এখনো প্রাসঙ্গিক। শুধু এর রঙঢঙ-কলাকৌশল বদলেছে মাত্র। ফ্যাসিস্ট শক্তির ক্ষমতার উৎস সম্মতি নয়- শক্তি। এরা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সম্মতি আদায় করে। তত্ত্ব ও তথ্য যদি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে ছলেবলে-কলেকৌশলে তারা অন্যায়কে ন্যায়, মিথ্যাকে সত্য ও অনায়াসে প্রতারণাকে প্রচারণায় প্রয়োগ করে।

বাংলাদেশে প্রায় দেড় দশক ধরে ক্ষমতাসীন সরকারের কলাকৌশল, কর্মসূচি ও কার্যকলাপ পর্যালোচনা করলে একই প্রবণতা ফুটে উঠবে। আওয়ামী লীগ যে সংবিধান প্রণয়ন করল তা মানবাধিকারের অনুচ্ছেদে অনুচ্ছেদে ভরপুর। কিন্তু তারাই ’৭৩ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণয়ন করে অবশেষে বাকশালে লীন হলো। বিস্ময়ের ব্যাপার, অনেক বছর পরে তারা যখন আবার ক্ষমতায় এসেছে- সেই কালাকানুন, সেই কালো আচরণ ও কালো অধ্যায়ের আবার সূচনা হয়েছে। বিশেষ করে বিগত দেড় দশক ধরে তারা যে ক্ষমতা প্রয়োগ করছে তা কেবলই শক্তিনির্ভর। শক্তি মদমত্ততার কারণে আইন-কানুন, রীতি-রেওয়াজ, ভদ্রতা-সভ্যতার একপ্রকার অবসান ঘটেছে। সর্বত্রই এর প্রমাণ ভূরি ভূরি। কেবল বিচার বিভাগই যদি বিবেচনায় আনা হয়, তাহলে বাস্তব প্রমাণ মিলবে।

গত মাসে কলামিস্ট কামাল আহমেদ প্রথম আলো পত্রিকায় প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘আদালতে কাঠগড়ার বদলে খাঁচা কেন?’ তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় হঠাৎ নীরবে এক বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। এমনকি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলেও যার চল ছিল না, তাই এখন চালু হয়েছে। তবে কিভাবে তা সম্ভব হলো, তা অস্পষ্ট ও রহস্যময়। ঢাকার কয়েকটি আদালতের যে ছবি ও বিবরণ পাওয়া গেছে, তাতে তা কায়রো বা মস্কোর আদালত কি না, সেই বিভ্রমেরও আশঙ্কা আছে। আদালতের কাঠগড়ার জায়গায় এসেছে লোহার খাঁচা। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই পড়েছেন। চিড়িয়াখানার পোষা প্রাণীদের যে ধরনের খাঁচায় রাখা হয়, সে রকম খাঁচা।’ তার ভাষায়, ‘প্রথমত, আইনের চোখে ন্যায্যতা ও সমতার নীতি অনুযায়ী আদালত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার আগ পর্যন্ত যেহেতু আসামিকে নির্দোষ গণ্য করতে হয়, সেহেতু তার প্রতি এমন কোনো আচরণ করা যায় না, যা নিবর্তনমূলক ও বিচারের আগেই তার প্রতি দোষীর ন্যায় আচরণ বলে প্রতীয়মান হয়। দ্বিতীয়ত, খাঁচায় আটকে রাখা অমানবিক, মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণকারী ও নিষ্ঠুর আচরণ।’ তিনি দেখিয়েছেন যে, এ ধরনের খাঁচায় পুরে রাখার অমানবিক আচরণ পৃথিবী থেকে প্রায় উঠে গেছে। এখন চিড়িয়াখানায়ও সবসময় পশুদের খাঁচায় পুরে রাখা হয় না।

আওয়ামী সরকারের আরেকটি নিষ্ঠুর আচরণ ডাণ্ডাবেড়ি। বছর খানেকের মধ্যে ডাণ্ডাবেড়ির কয়েকটি নির্মম উদাহরণ ঘটে। গত ২০ ডিসেম্বর তিন ঘণ্টার জন্য পেরোলে মুক্তি পেয়েছিলেন গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালি ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি আলী আজম। নিজ বাড়িতে নেয়ার পর তিনি নিজেই মায়ের জানাজা পড়ান। এ সময় তার হাতকড়া ও ডাণ্ডাবেড়ি পরানো ছিল। ওই ঘটনা নিয়েই রাজনৈতিক মহলে ও গণমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়। বিভিন্ন সংগঠন এর নিন্দা করে। সেই ঘটনার পর এক মাস যেতে না যেতেই আরেকটি নির্মম ডাণ্ডাবেড়ির ঘটনা প্রত্যক্ষ করল জাতি। এবারের স্থান শরীয়তপুর। হাতকড়া আর ডাণ্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় মায়ের জানাজায় অংশ নিলেন সেলিম রেজা নামে ছাত্রদলের এক কেন্দ্রীয় নেতা।

মায়ের মৃত্যুতে কারাগার থেকে পেরোলে মুক্তি পেলেও জানাজার সময় তার হাতকড়া ও ডাণ্ডাবেড়ি খোলা হয়নি। গত ১৫ জানুয়ারি দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে শরীয়তপুর সদর উপজেলার সুজনদোয়াল গ্রামে সেই জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরের তিনটি ঘটনা আরো সংবেদনশীল এ কারণে যে, রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ তারা। সমাজ তাদেরকে আরো বেশি বেশি করে সম্মান করে। জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মাওলানা রফিকুল ইসলাম খানকে ২০১২ সালের রমনা থানার একটি মামলায় হাজিরা দিতে ৩০ জানুয়ারি পুরান ঢাকার সিএমএম আদালতে আনা হয়। এ সময় তার হাতে হ্যান্ডকাফ ও পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়। মার্চ মাসের শেষের দিকে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে ও রশি দিয়ে বেঁধে হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হককে আদালতে হাজির করা হয়। সর্বশেষ ঘটনাটি হচ্ছে গত ১৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল গুরুতর অসুস্থ এ টি এম আজহারুল ইসলামকে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। এর আগেও তার সাথে একই আচরণ করা হয়।

শক্তি প্রয়োগে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ সরকার আদালতে কাঠগড়ার পরিবর্তে খাঁচা স্থাপন করেই ক্ষান্ত হয়নি, ছোট-বড় নেতাদের ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়েই সন্তুষ্ট থাকেনি; তাদের কালো হাত আরো সম্প্রসারিত হয়েছে ভিন্নমত পোষণকারী মানবাধিকারকর্মী পর্যন্ত। গত বৃহস্পতিবার এক দশক আগের হেফাজতে ইসলামের মামলায় মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক এ এস এন নাসির উদ্দীনকে কারাদণ্ড দেন আদালত। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে রক্তপাতের ঘটনা ঘটে। আদিলুর রহমান তথ্য প্রমাণ দিয়ে দেখান যে, সেখানে ৬১ জন মাদরাসাছাত্রের প্রাণ গেছে। অপর দিকে, সরকার বলেছিল সংখ্যাটি ১১। ‘বিকৃত তথ্য প্রচারের মামলায়’ আদিলুর রহমানকে জেলে পাঠান আদালত। সাজা ঘোষণার পর প্রিজন ভ্যানে তোলার সময় হাত তুলে প্রতিবাদ করতে গেলে আদিলুর রহমানের হাত চেপে ধরে পুলিশ। হয়তো বা তিনি মুষ্টিবদ্ধ হাত উত্তোলন করতে চেয়েছিলেন। অথবা তিনি কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য হাত নাড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশের এই হাত উত্তোলন পছন্দ হয়নি। পুলিশ তো এমনি এমনি আচরণ করে না। তারা উপরের নির্দেশে চলে। সেখানে আদিলুর রহমানকে জেলে পুরেও সরকার নিজেদের নিরাপদ মনে করছে না। তার উত্তোলিত হাতেও তাদের ভয়।

বিচার বিভাগকে কলুষিত করার এই তিনটি বিষয় বিশ্লেষণ করা যাক। আমাদের সংবিধানের ৩৫ এর ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না। কিংবা নিষ্ঠুর, অমানবিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেয়া যাইবে না কিংবা কাহারো সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।’ আওয়ামী লীগ সরকার আরোপিত ওই তিনটি ব্যবস্থা আদালতে কাঠগড়ার পরিবর্তে খাঁচা স্থাপন, ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের আদালতে উপস্থাপন অথবা প্যারোলে থাকা অবস্থায় অনুরূপ আচরণ আইন ও সংবিধানবিরোধী। ব্যক্তি আদিলুর রহমানের সাথে যা করা হয়েছে তাও আইন ও সংবিধানের বিপরীত।

শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। ব্যক্তির আশা-আকাক্সক্ষা তথা শারীরিক আচরণের প্রতি শক্তি প্রয়োগ করা যায় না। এটি মনীষী হবসের ভাষায়- ‘Selfish, Solitery, Poor, Brutish, Nasty and Sort’. সরকার ক্ষমতার স্বার্থে বেআইনি ও অমানবিক আচরণ করেছে। আদিলুর রহমানের হাত উত্তোলনকে বাধা দেয়ার বিষয়টি সাধারণ নয়। অসাধারণ অর্থেই তা গ্রহণ করতে হবে। এটি একটি প্রতীকী ব্যবস্থা। গোটা জাতির বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতা- তথা মৌলিক অধিকার যে শক্তির কাছে আবদ্ধ হয়ে আছে এটি তার প্রমাণ। গোটা জাতি যে সম্মতির পরিবর্তে শক্তির জাঁতাকলে নিস্পৃষ্ট হচ্ছে, আদিলের প্রতি পুলিশের আচরণই তার প্রমাণ।

এই তিনটি নিবর্তনমূলক আইন ও ব্যবস্থা প্রমাণ করে, বাংলাদেশে আইনের শাসনের অনুপস্থিতি রয়েছে। সংবিধান লঙ্ঘন করেই শাসন চলছে। বাংলাদেশের আইন ও আদালতে মানবাধিকারের স্বীকৃতি কাগজে থাকলেও শাসকদের মগজে নেই। ক্ষমতাসীন সরকার শুধু সংবিধানকেই লঙ্ঘন করছে না, তারা বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতিকেও অস্বীকার করেছে। বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘ প্রণীত ১৯৪৮ সালের মানবাধিকার সনদের স্বাক্ষরকারী দেশ। ২০০৪ সালের আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত সংবিধি বা রোম সংবিধিতেও স্বাক্ষরকারী দেশ বাংলাদেশ। এ ছাড়া অন্যান্য আন্তর্জাতিক বিধি ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতিকারী এই দেশ। সুতরাং দেশজ পরিপ্রেক্ষিত ও আন্তর্জাতিক বিচারে বাংলাদেশ সরকার দায়বদ্ধ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে ফ্যাসিবাদ, নাজিবাদ ধরনের মতবাদ ও সরকার যাতে সাধারণ মানুষের অধিকার অস্বীকার করতে না পারে এবং জাতিসঙ্ঘ ও অন্যান্য রাষ্ট্র যাতে মানুষের অধিকার রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে পারে সেই পরিপ্রেক্ষিতেই বিশ্বজনীন মানবাধিকারের স্বীকৃতি। আজকের বাংলাদেশে যে বৈশ্বিক হস্তক্ষেপের কথা বলা হয়, তার আইনগত ও নৈতিক ভিত্তি মানবাধিকারের স্বীকৃতি।

কলামিস্ট কামাল আহমেদ নিয়তির এক নিষ্ঠুর পরিহাসের কথা লিখেছেন। তার ভাষায়- ‘গোড়ার দিকে মিসরের কথা বলেছিলাম, দেশটিতে সব ফৌজদারি মামলাতেই বিচারের সময় আদালতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের খাঁচায় আটকে রাখা হতো। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস, দেশটিতে ১৯৮১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত লৌহমানবের মতো শাসন পরিচালনাকারী হোসনি মোবারক ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিচারের মুখোমুখি হলে তাকেও একই রকম খাঁচায় পুরে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল।’ আমরা উদ্ধৃতিটি উল্লেখ করলাম মাত্র।

অবশেষে মনীষী প্লেটোর একটি উক্তি দিয়ে শেষ করি- ‘অধম প্রবৃত্তির দল এবার তাদের হাতে বন্দী আত্মাকে তার সব মহৎগুণ থেকে শোধন করতে শুরু করে। এবার তার দম্ভ, অনাচার, অমিতব্যয় ও নির্লজ্জতাকে মশাল শোভাযাত্রাসহকারে পুষ্পমাল্যে ভূষিত করে এবং প্রশংসার মধুর বাণী উচ্চারণ করে বরণ করে এনে আত্মাশূন্য ঘরে তাদের প্রতিষ্ঠা করে। এবার তারা ঔদ্ধত্যকে অভিহিত করে আভিজাত্য বলে, অরাজকতাকে বলে স্বাধীনতা এবং অপব্যয়কে মহানুভবতা আর মূর্খতাকে বলে বিক্রম।’ (রিপাবলিক-৮ : ৫৬০)

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews