ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী? এমন প্রশ্ন তুলে দু’টি দেশের মধ্যকার সম্পর্কের উত্থান-পতনের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। কলকাতার অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সহযোগী ফেলো সোহিনী বোস আলজাজিরাকে বলেছেন, বিদ্যমান ‘প্রাকৃতিক’ পারস্পরিক নির্ভরতার কারণে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত করার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু ঢাকার সেন্টার ফর অল্টারনেটিভসের বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির গবেষণা তথ্যবিশ্লেষক খন্দকার তাহমিদ রেজওয়ান মনে করেন ‘ন্যায্যতা’ই দুই দেশের সম্পর্ককে কেবল সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে।
ঢাকার গবেষক রেজওয়ান বলেন, বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কটি কেবল সর্বোচ্চ স্তরে উষ্ণ ছিল। কিন্তু ভারতের আচরণ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে যে বিরক্তি সৃষ্টি করছিল তা আরো আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক চ্যানেলে প্রতিফলিত হচ্ছে। যাই হোক, ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক পারস্পরিকভাবে উপকারী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তবে এটি অবশ্যই সাম্যের ভিত্তিতে হওয়া উচিত এবং সীমান্ত হত্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সুরাহার সাথে এর অগ্রগতি দেখতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি এসবের সমাধান করতে এবং নয়াদিল্লির সাথে ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তা শেখ হাসিনার শাসনামলের মতোই বিবেচিত হবে।
তবে সোহিনী বোস বলেন, ‘বিশ্বের পঞ্চম-দীর্ঘতম সীমানাজুড়ে সংলগ্ন অঞ্চলগুলোর সাথে, বাংলাদেশ ও ভারতের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাণিজ্য থেকে শুরু করে পারিবারিক সংযোগ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি সাধারণ সম্পদ রয়েছে। এই ভৌগোলিক বাস্তবতা যেকোনো রাজনৈতিক পরিবর্তন সত্ত্বেও অনস্বীকার্য, যা ভারত ও বাংলাদেশের জন্য একটি কার্যকরী সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় করে তোলে।’ সম্প্রতি বাংলাদেশের ভারতে ইলিশ রফতানির বিষয়টিকে ইতিবাচক দেখে বোস বলেন যে, সংক্ষিপ্ত নিষেধাজ্ঞাটি ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে শুভেচ্ছা ও বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে মাছ উপহারের হাসিনার ধারা থেকে ‘দৃঢ় প্রস্থান’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ভারতের এ বিশেষজ্ঞের সাথে দ্বিমত প্রকাশ করে ঢাকার গবেষক রেজওয়ান বলেন, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর হাসিনা প্রথম ইলিশ মাছকে কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। প্রতিবেশীদের মধ্যে একটি প্রধান দ্বিপক্ষীয় সমস্যা জল বণ্টনের যুগান্তকারী চুক্তির আগে তিনি পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে ইলিশ উপহার দেন। ২০১৬ সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রধান মমতা ব্যানার্জির কাছে ইলিশের একটি চালান পাঠিয়েছিলেন। এক বছর পরে, ভারতের তখনকার রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে ইলিশ উপহার দেয়া হয়েছিল।

আলজাজিরার প্রতিবেদনে মৎস্য কূটনীতি বা ইলিশ নিষেধাজ্ঞা ভারত-বাংলাদেশ উত্তেজনা সম্পর্কে কী প্রকাশ করে তার অনুসন্ধান করেছে। তারা দেখছে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত মাছ রফতানির ওপর সংক্ষিপ্ত নিষেধাজ্ঞা কূটনৈতিক উত্তেজনা ও রন্ধনসঙ্কটের সৃষ্টি করেছে। হাসিনা তার প্রতিবেশী ভারতের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য কূটনীতির হাতিয়ার হিসেবে বঙ্গোপসাগরে ও নদীতে পাওয়া মাছটিকে ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের কিছু বিশেষজ্ঞ এই পদক্ষেপকে নয়াদিল্লির হাসিনার প্রতি সমর্থনের জন্য একটি কূটনৈতিক তিরস্কার হিসেবে দেখেছেন।
আলজাজিরার প্রশ্ন হচ্ছে, ইলিশ কি কেবল একটি জনপ্রিয় খাবারের চেয়ে বেশি? ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা মাছ ইলিশ আসলে কী? বাংলাদেশ বিশ্বের ৭০ শতাংশ ইলিশ রফতানি করে। কিন্তু অত্যধিক মাছ ধরা, চাহিদা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের কারণে মূল্যবান মাছটি ক্রমেই বিরল এবং ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। এ বছর মৎস্যজীবীরা বলছেন, সমুদ্রের রুক্ষ অবস্থার কারণে তারা পর্যাপ্ত পরিমাণে ইলিশ ধরতেও হিমশিম খাচ্ছেন। গবেষক রেজোয়ানের অভিযোগ হচ্ছে, ভারতে ইলিশ পাচারকারী সিন্ডিকেটের জন্য সবসময় ইলিশের দাম চড়া হয়ে থাকে। এবারো ঢাকা থেকে রফতানি কমে যাওয়ায় ভারতে ইলিশের দাম দ্রুত বেড়েছে। কিন্তু তারপরেও সরকার বাংলাদেশে দাম কমাতে ব্যর্থ হয়েছে।

তবে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিশেষজ্ঞের মতে, অন্তর্বর্তী সরকার সম্ভবত হাসিনার ভারতপন্থী পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে দাঁড়াবে। নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর ভারতে ইলিশ রফতানি ফের শুরু করার বিষয়টিকে সোহিনী বোস ‘সৌভাগ্যের সাথে আপস’ হিসেবে দেখছেন। বাংলাদেশে কিন্তু এবারই প্রথম ভারতে ইলিশ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে বিরোধের কারণে ২০১২ সালে ভারতে ইলিশ রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে বাংলাদেশ। এটি অবশেষে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে একটি শুভেচ্ছা প্রতীক হিসেবে তুলে নেয়া হয়েছিল।
উপরন্তু কয়েক বছর ধরে হাসিনা সরকার প্রায়ই দুর্গাপূজার আগে শত শত টন মাছ ‘উপহার’ দিয়ে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার ব্যতিক্রম করেছে। হাসিনা কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে অন্য সাংস্কৃতিক প্রতীক হিসেবে সীমান্তের ওপারের নেতাদের স্থানীয়ভাবে তৈরি শাড়ি ও আমও উপহার দিয়েছেন। ২০২১ সালে হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কাছে ২,৬০০ কেজি হাড়িভাঙ্গা আম পাঠিয়েছিলেন। ভারত থেকে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের ডোজ সরবরাহে বাংলাদেশ বিলম্বের মুখোমুখি হওয়ায় ওই পদক্ষেপ নেয়া হয়।

কেন ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক টানাপড়েন?
ভারত হাসিনাকে তার ১৫ বছরের শাসনের শেষ পর্যন্ত সমর্থন করেছিল, যা মানবাধিকার লঙ্ঘন, নির্বাচনী কারসাজি এবং বিরোধী দলগুলোর ওপর ক্র্যাকডাউন দ্বারা চিহ্নিত ছিল বলে মানবাধিকার গোষ্ঠী বলেছে। সে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার আগে ৩০০ জনেরও বেশি বিক্ষোভকারীকে হত্যা করলেও নয়া দিল্লি হাসিনার দমন-পীড়নের বিষয়ে নীরবতা পালন করেছে। তাই ভারতে হাসিনার আতিথেয়তা অন্তর্বর্তী সরকার ভালোভাবে নেয়নি। হাসিনার প্রত্যর্পণ চাওয়া হলে এ ধরনের দাবি নয়াদিল্লির পক্ষে মেনে নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে ‘সম্মানিত’ করার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশে অনেকেই হাসিনার প্রতি নয়াদিল্লির সমর্থনকে তার ভারী হাতের দৃষ্টিভঙ্গি সক্ষম বলে মনে করেন। তার ১৫ বছরের শাসনামলে, হাসিনা ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন বিশেষ করে নিরাপত্তা সহযোগিতা চুক্তির মাধ্যমে, সমালোচকরা এবং বিরোধী দলগুলো যেসব চুক্তিকে নয়াদিল্লির পক্ষে পক্ষপাতদুষ্ট ছিল বলে অভিহিত করে।
এখনো ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার বাংলাদেশীদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ এবং তাদের উল্টিয়ে ঝুলিয়ে শাস্তি দেবার মতো বক্তব্য দিয়ে অপমান করাও বাংলাদেশীদের ক্ষুব্ধ করেছে। গত সপ্তাহে ঢাকা ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের এ ধরনের ‘অত্যন্ত অশোভন’ বক্তৃতার নিন্দা করেছে। ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বাংলাদেশের নাগরিকদের হত্যার অভিযোগও করেছে ঢাকা। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো ‘সীমান্তে বাংলাদেশীদের বেআইনি হত্যা ও নির্যাতনের নিন্দা দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে। ক্রমবর্ধমান ইসলামফোবিয়া ও মোদির অধীনে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ বাংলাদেশেও ভারতবিরোধী মনোভাব জাগিয়েছে।
তদুপরি ভারতীয় করপোরেশনগুলোর সাথে হাসিনা সরকারের বাণিজ্য চুক্তিগুলোও তদন্তের আওতায় এসেছে। সমালোচকরা তাকে এমন চুক্তিতে স্বাক্ষর করার জন্য অভিযুক্ত করেছেন যা ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে উপকৃত করেছে। তিস্তা নদীর পানি বণ্টনও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিরোধের একটি প্রধান বিন্দু হিসেবে রয়ে গেছে। কারণ উভয় দেশই কৃষিকাজের জন্য তার পানির ওপর অনেক বেশি নির্ভর করে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে নদীর প্রবাহের একটি ন্যায্য বরাদ্দ চেয়ে আসছে। বর্তমান ব্যবস্থায় তিস্তার পানি ভারত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যা শুষ্ক মৌসুমে পানির ঘাটতি সৃষ্টি করে। আর ভারী বৃষ্টিপাতের সময় হঠাৎ করে পানি ছাড়ার ফলে এই বছরের আগস্টসহ বাংলাদেশে আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা আলজাজিরাকে বলেছেন যে, অতীতের মতো, ভারত গত মাসে পানি ছাড়ার বিষয়ে তার প্রতিবেশীকে সতর্কতা জারি করেনি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য প্রতিবেদনগুলোকে ‘বাস্তবগতভাবে সঠিক নয়’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। ভারত, বিশেষ করে তার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য, তার নিজস্ব কৃষিচাহিদা উল্লেখ করে বিদ্যমান নদী-বণ্টন চুক্তির পরিবর্তনকে প্রতিহত করেছে।
বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক তাই পুনঃস্থাপনের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই মাসের শুরুর দিকে, তিনি ভারতে আশ্রয়স্থল থেকে নির্দেশনা দেয়ার জন্য হাসিনার সমালোচনা করেছিলেন এবং বলেন যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার ক্রমাগত হস্তক্ষেপ উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলতে পারে। একইসাথে ড. ইউনূস আওয়ামী লীগ ছাড়া সব রাজনৈতিক দলগুলোকে ইসলামপন্থী মনে করার ভারতীয় মনোভাবেরও সমালোচনা করেন।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews