প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর অপসারণ বা পদত্যাগ প্রশ্নে বিতর্ক বেশ জমে উঠেছে। তর্কের ডালপালা বিস্তৃত হচ্ছে। রাজনীতিকদের কেউ কেউ বলছেন নতুন নতুন ইস্যু সামনে আনায় সংস্কারের বিষয়টি আড়ালে পড়ে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠান। মূল সেই করণীয়টিই যেন বা পেছনে পড়ে যাচ্ছে। বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো এখনই রাষ্ট্রপতি অপসারণের পক্ষে মত দিচ্ছে না। তারা মনে করছে, এর মাধ্যমে সাংবিধানিক সংকট দেখা দেবে। সেই অবস্থায় ঘোলা পানিতে স্বার্থান্বেষী কোনো মহল মাছ শিকারের চেষ্টা করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ আবার দিচ্ছেন দুধারি ব্যাখ্যা। কেউ আবার এই সরকারকে আধা বিপ্লবী আধা সাংবিধানিক সরকার বলে আখ্যায়িত করছেন।

পক্ষান্তরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি রাষ্ট্রপতির অপসারণের দাবিতে অনড় অবস্থান গ্রহণ করেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্র্ট থেকে জানা যায়, নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের পক্ষ থেকে এমনও বলা হয়েছে যে, ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হলেও তারা এটা করবেনই। প্রয়োজনে আন্দোলন করবেন। তারা জনাব চুপ্পুকে বিপজ্জনক মনে করছেন। ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের জন্যও পতিত সরকারের পার্লামেন্ট কর্তৃক পদাভিষিক্ত রাষ্ট্রপতির বহাল তবিয়তে থাকার বিষয়টি যে স্বস্তিদায়ক নয়, তা সহজেই অনুমেয়।



ছাত্র-জনতার বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতার মূল কেন্দ্র গণভবন ছেড়ে শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরও রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে জনমনে শঙ্কাও সন্দেহ কাজ করছিল। কারণ দেশের মানুষ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু সাহেবকে পূর্বাপর শেখ হাসিনার বশংবদ হিসেবে দেখে আসছিলেন। কিন্তু জাতির উদ্দেশে দেওয়া বিপ্লবোত্তর ভাষণে তিনি যখন স্পষ্ট ভাষায় বললেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন এবং তিনি তা গ্রহণও করেছেন, তখন অস্বস্তি অনেকটাই কেটে যায়। তা সত্ত্বেও সামাজিক মাধ্যমে আত্মগোপনে থেকে বা দেশের বাইরে থেকে পোস্ট দিয়ে কেউ কেউ দাবি করেন যে, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি। তবে সেই সব গুঞ্জনের পালে খুব একটা হাওয়া ধরেনি। গুঞ্জনের কিস্তি এগোতে পারেনি। কিন্তু গত ১৯ অক্টোবর সেই পালে হাওয়া দিলেন মানবজমিন টেবলয়েডের সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। দৈনিকটির বিশেষ ম্যাগাজিন জনতার চোখে ছাপা হলো রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন সম্পাদক নিজেই। সেই সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনার পদত্যাগ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে রাষ্ট্রপতি বলেন যে, তাঁর কাছে শেখ হাসিনার পদত্যাগের কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। এই ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো একটা ব্যাপার ঘটে গেল। অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা তাৎক্ষণিক ব্যক্ত করেন তীব্র প্রতিক্রিয়া। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি মিথ্যাচার করেছেন। তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা অবিলম্বে চুপ্পু সাহেবের পদত্যাগ বা অপসারণ দাবি করে। পালিত হয় বঙ্গভবন ঘেরাও কর্মসূচি। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণের দাবির পাশাপাশি নাগরিক কমিটি সংবিধান বাতিল ও সেকেন্ড রিপাবলিক ঘোষণার আওয়াজ তোলেন। সংবিধান বাতিল ও পুনর্লিখনের দাবি আগে থেকেই ছিল। কিন্তু সেকেন্ড রিপাবলিক প্রক্লেমেশনের দাবিটি নতুন। এই পরিভাষার সঙ্গে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পরিচয় নেই বললেই চলে। এ দেশের মানুষ আইয়ুব খানের সবুজ বিপ্লব, বাকশালীকরণের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় বিপ্লবের স্লোগান শুনেছেন। কিন্তু প্রক্লেমেশন অব সেকেন্ড রিপাবলিক অনেকের কাছেই নতুন টার্ম, যদিও বিশ্ব ইতিহাসে এটা নতুন নয়। বিএনপির মতো বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দলগুলো সেকেন্ড রিপাবলিক ঘোষণার দাবিকে খুব সহজভাবে নিচ্ছে বলে মনে হয় না।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় যে, বহু উত্থান ও পতনের পর ১৮৪৮ সালে ফ্রান্সে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয় সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন লুই নেপোলিয়ান বোনাপার্ট। তিনি নেপোলিয়ানের ভাগ্নে। এই লুই নেপোলিয়ানই আবার ১৮৫২ সালে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের কবর দিয়ে দ্বিতীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার মামা নেপোলিয়ান বোনাপার্টও ফ্রান্সের প্রথম প্রজাতন্ত্র রহিত করে প্রথম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অর্থাৎ প্রজাতন্ত্রই রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছিল।

পলিটিক্যাল সায়েন্সে প্রজাতন্ত্রের সাদামাটা অর্থ হলো জনগণের শাসন। গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্র প্রায় সমার্থক। কিন্তু বাস্তবে তা নাও হতে পারে। চীনকে অমরা চিনি গণপ্রজাতন্ত্রী চীন হিসেবে। কিন্তু সেখানে প্রথাসিদ্ধ গণতন্ত্র নেই। উত্তর কোরিয়ার পোশাকি নাম গণতান্ত্রিক কোরিয়া প্রজাতন্ত্র হলেও সেই রাষ্ট্রে জনগণের কী রকম অধিকার আছে তা কমবেশি আমরা সবাই জানি! এগুলো ইতিহাসের কথা। আবার প্রজাতান্ত্রিক বহু দেশে গণতন্ত্রও আছে যথারীতি। কোরিয়া প্রজাতন্ত্র, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র- এমনই আরও অনেক প্রজাতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্র ঠিকঠাক কাজ করছে।

এগুলো আসলে খুব বড় বিষয় নয়। আজকে রাষ্ট্রপতির অপসারণ ইস্যুতে রাজনৈতিক চিন্তার যে বিভিন্নতা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে তাকে আর বেশি বড় হতে দেওয়া উচিত নয়। কেতাবি তত্ত্ব আর বাস্তবতা সব সময় সমান্তরাল হয় না। জনগণের চাওয়া আর বইয়ে লেখা শাসনতন্ত্রের চাওয়ার মধ্যে বৈপরীত্য দেখা দেওয়া অসম্ভব নয়। বাংলাদেশের ঝুলে থাকা সংবিধান অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থা সমর্থন করে না। অথচ জনগণ জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এটাই চেয়েছেন। বস্তুত সংবিধানের জন্য জনগণ নয়, জনগণের জন্য সংবিধান। কাজেই জনগণ কী চান, তার বাস্তবায়নই এখন অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।

রাষ্ট্র সংস্কারের দায় একা অন্তর্বর্তী সরকারের নয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটির বিচ্ছিন্ন কোনো দাবিও এটা নয়। দেশে সক্রিয় প্রতিটি রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্র মেরামত চায়। সংস্কার চায়। রাষ্ট্র মেরামতের তিরিশ দফা ঘোষণা রয়েছে বিএনপির। তুলনামূলকভাবে ছোট দলগুলোও সংস্কার অপরিহার্য মনে করে। তবে একটি ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন নিশ্চিত করার জন্য এখনই কোন কোন সংস্কার প্রয়োজন আলোচনার মাধ্যমে সেগুলো চিহ্নিত করা উচিত। সেভাবে কাজের অগ্রাধিকার স্থির করা অপরিহার্য।

সাধারণ মানুষের মনে বহাল রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে নানান প্রশ্ন রয়েছে। তিনি জনগণের প্রত্যাশার অনুগামী কি না তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন অনেকেই। তারপরও দেখতে হবে রাষ্ট্রপতি অপসারণের সুবিধা ও অসুবিধাগুলো কী কী! প্রজ অ্যান্ড কনস বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, প্রেশার গ্রুপ ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধিদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা। আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যা সমাধানের পথ বেরিয়ে আসবে নিশ্চয়ই। আলোচনার মাধ্যমে একটা ঐকমত্যে পৌঁছা অসম্ভব নয়। পারস্পরিক সন্দেহ-সংশয় ও অবিশ্বাসের জায়গাটা যাতে কোনোমতেই আর প্রসারিত হতে না পারে, সে দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন এখনই।

লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews