প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে পৃথিবী। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাব, অন্যদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গতিশীলতা, সবকিছু মিলে খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে বিশ্বকৃষির প্রতিরূপ। খাদ্য উৎপাদন এবং বিশ্বকৃষি বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হলে প্রতিনিয়ত কৃষিচর্চায় আনতে হবে সময়োপযোগী পরিবর্তন। সূচনা থেকে কৃষি ছিল পরম্পরার, পারিবারিক শিক্ষার অংশ। বাবা-দাদার সঙ্গে কাজ করতে করতে কৃষি সম্পর্কে জানা-বোঝা হয়ে যেত কৃষকের। সেই সঙ্গে প্রকৃতির কাছ থেকে পেত প্রাথমিক পাঠ। বাতাসের গতি, আকাশের সূর্যের অবস্থান, মাটির গঠন দেখেই কৃষক বলে দিতে পারত পরিবেশ-পরিস্থিতি। কিন্তু আজকের কৃষি ঠিক গত দিনের কৃষি নয়, তেমনি আগামীর কৃষিও আজকের কৃষির মতো থাকবে এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে কৃষককে হতে হবে আধুনিক, প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ এবং পরিবর্তন সম্পর্কে সম্যক ধারণা।
বিশ্ব কৃষির দিকে তাকালে বোঝা যায়, কৃষি উন্নয়ন ও প্রযুক্তির বিকাশে অনেক দেশ থেকে আমরা পিছিয়ে আছি। মনে পড়ে ২০০৭-০৮ সালের দিকে চীনের চাংসায় এক গ্রামে কৃষি মাঠে কাজ করতে করতে লক্ষ করলাম মাঠে কোনো কৃষক নেই। অদূরের এক মাঠে একটা ট্রাক্টর জমি চাষ দিচ্ছে। অপেক্ষা করছিলাম ট্রাক্টরটি আমাদের দিকে ঘুরে আসার জন্য। যখন ট্রাক্টরটি কাছে এলো দেখি, সেখানে কোনো চালক নেই। অবাক হলাম। একটু এগোতেই চোখে পড়ল এক তরুণ তার বাড়ির আঙিনায় বসে চা খেতে খেতে রিমোট কন্ট্রোলে সেই ট্রাক্টরটিকে পরিচালনা করছে। এ সময় কৃষিতে তাদের প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বহু দূর এগিয়ে গেছে।
আজকের কৃষিতে আমাদের যতটুকু অগ্রগতি, সেখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন আমাদের বিজ্ঞানী এবং কৃষক। বিশেষ করে আমাদের কৃষক নতুন কৃষিপদ্ধতি সম্পর্কে জানার এবং সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে গিয়ে সীমাবদ্ধতাকে উতরে গেছেন। ফলে আজ আমরা মাঠে মাঠে যে বৈচিত্র্যপূর্ণ কৃষি দেখছি, তা রচনা করেছেন আমাদের কৃষকই তাদের নিজের কৌতূহলে এবং চেষ্টায়। যেমন ধরুন ফেনীর কৃষক সোলায়মান গাজী নিজের অদম্য ইচ্ছা থেকে মালয়েশিয়া থেকে সংগ্রহ করেছিলেন বারোমাসি আমের সায়ন। যা থেকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট পরবর্তী সময়ে বারোমাসি আমের জাত বারি ১১ উদ্ভাবন করে। বিদেশি প্রযুক্তি হাইড্রোপনিক ব্যবহার করে ঘরের ভিতর ঘাস চাষের প্রতিবেদন দেখে নারায়ণগঞ্জের হারুন-অর-রশিদ নিজের মতো করেই দেশীয় পদ্ধতিতে অবকাঠামো তৈরি করে নিয়েছিলেন। কিংবা সাতক্ষীরার সাইফুল্লাহ গাজীর কথাই বলি, ভারতে ঘুরতে গিয়ে শিখে এসেছিলেন রঙিন মাছের ব্রুডিং কৌশল। এখন দেশেই উৎপাদন হচ্ছে নানা রকমের রঙিন মাছ। আমদানির বিশাল বাজারে দেশি পণ্য হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে দেশে উৎপাদিত মাছ। এমন অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশের কৃষির রূপান্তরে আমাদের গবেষকদের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। তবে কৃষক ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের গবেষকদের চেয়ে এগিয়ে আছেন। এক সেমিনারে এ কথা অবশ্য স্বীকার করে নিয়েছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন। যা হোক, বলছিলাম আমাদের কৃষক যতটা আগ্রহী ও কৌতূহলী আমরা যদি সব কৃষককে একটা কাঠামোর ভিতর নিয়ে এসে কৃষির হালনাগাদ তথ্য সম্পর্কে জানিয়ে দিতে পারতাম, প্রশিক্ষিত করতে পারতাম তাহলে আমাদের কৃষি আরও গতিশীল হতো। কৃষকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কৃষি সমস্যাগুলো সমাধান করা যেত খুব সহজেই।
আমার কাছে এখনো কৃষকের প্রচুর চিঠি, টেলিফোন কল ও ইমেইল আসে। নতুন কৃষি আর প্রযুক্তি নিয়ে তাদের আগ্রহের শেষ নেই। ‘কোথায় মাল্টা চাষের প্রশিক্ষণ নেওয়া যায়, জানাবেন স্যার?’ কিংবা ‘স্যার, বাইরের দেশ থেকে যে গাজর আমদানি হয়, সেই গাজরটার সাইজ কত সুন্দর! আমরা যে গাজর চাষ করি সেটার সাইজ এমন ত্যাড়াবাঁকা কেন?’ বা ‘ইউটিউবে দেখেছি জাপানে চার কোনা তরমুজ চাষ হয়, সেগুল পরিবহনে সহজ। আমরা সেগুল কীভাবে উৎপাদন করতে পারি?’ এমন অসংখ্য প্রশ্ন। তার মানে কৃষক জানতে চায়, নতুন কৌশল শিখতে চায়। কিন্তু হাতেকলমে শেখানোর কেউ নেই। এমনকি কৃষক জানেও না কোথায় গেলে তার প্রশ্নের উত্তর মিলবে। অনেকেই ছাদকৃষি করছেন। শহরে দারুণভাবে ছড়িয়ে গেছে ছাদকৃষি। সেই উদ্যোক্তারাও জানতে চান ফসল উৎপাদনের নানান কিছু। বিশেষ করে পরিবর্তনের এই সময়ে যখন শিক্ষিত তরুণরা আগ্রহী হয়ে উঠছে কৃষি উদ্যোগে। সেসব উদ্যোক্তার প্রশিক্ষণের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। ইউটিউব দেখে কিংবা সফল কারও গল্প শুনে শুনে উদ্যোগী হচ্ছেন তারা। না জেনে, না বোঝে, প্রশিক্ষণ না নিয়ে বিনিয়োগ করে ব্যর্থ হয়ে বিমুখ হচ্ছেন। সরকারের কৃষি বিভাগের অনেকের সঙ্গেই আমি কথা বলে জেনেছি, কৃষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমগুলো মূলত প্রকল্পনির্ভর। প্রকল্প শেষ হয়ে গেলে সেই প্রশিক্ষণ কৃষক মাঠে কীভাবে কাজে লাগাল তা-ও মূল্যায়ন করা হয় না। ফলত কৃষকের এই প্রশিক্ষণসমূহও অনেকটা কাগজকলমেই হয়।
মনে পড়ছে গত শতাব্দীর আশি-নব্বই দশকের কথা। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তখন ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানটি দর্শকপ্রিয়তার তুঙ্গে। এই অনুষ্ঠানের কল্যাণে তরুণদের মাঝে হাঁস-মুরগি পালন, খাঁচায় মুরগির চাষ, মাছের খামার খুব ব্যাপক প্রসার ঘটে। সে সময় অপরিহার্য হয়ে পড়ে কৃষি জ্ঞানটাকে আরও নিবিড়ভাবে পৌঁছে দেওয়া, অর্থাৎ কৃষি প্রশিক্ষণ। তরুণরা খামার গড়তে আগ্রহী কিন্তু খামার গড়ার প্রায়োগিক কারিগরি কোনো জ্ঞান নেই। মুরগির খামার, মাছের খামার, গরু মোটাতাজাকরণ কিংবা নার্সারি যা-ই হোক। সবখানেই কারিগরি জ্ঞান প্রয়োজন। তখন দেশের যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো উপলব্ধি করল, আগ্রহী তরুণদের প্রশিক্ষণ দরকার। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোয় হাঁস-মুরগি পালন, মাছ চাষ ও বনায়নের নতুন কিছু কোর্স শুরু হলো। তরুণরা তুমুল আগ্রহ নিয়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোয় যাওয়া শুরু করলেন। এই প্রশিক্ষণের প্রসারও দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ল। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তখন প্রতিদিন বিকালে প্রচারিত হতো উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রযোজিত ‘দূরশিক্ষণ’ নামে একটি কার্যক্রম। কোনো দিন ইংরেজি, কোনো দিন গণিত, কোনো দিন ইতিহাস, কোনো দিন বিজ্ঞান, কোনো দিন ভূগোল, কোনো দিন কৃষি সম্পর্কে অনুষ্ঠান। খুব সম্ভবত ১৯৯৩-৯৪ সালের কথা। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময়কার উপাচার্য ড. শমসের আলী আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন কৃষি কোর্সের সঙ্গে যুক্ত ‘কৃষি কৌশল’ নামে একটি অনুষ্ঠান নির্মাণ করার জন্য। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কৃষি কৌশল’ করতে গিয়ে নতুন একটি মডেল তৈরির সুযোগ পেলাম। বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাটি ও মানুষ ছিল মূলত উদ্বুদ্ধকরণ অনুষ্ঠান। কৃষির ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতাম। নতুন চাষব্যবস্থা, নতুন কৌশল, নতুন ফসল, নতুন বীজ- এসব বিষয় দেখে কৃষক দারুণ উদ্বুদ্ধ হতেন। কিন্তু তাঁর কাছে কৌশলটা ছিল না। কীভাবে করবেন তা তিনি জানতেন না। বাউবি দূরশিক্ষণের কৃষি কৌশলটা ছিল সে রকম একটা বিষয়। ‘মাটি ও মানুষ’ প্রচার হতো শনিবার। মাটি ও মানুষের শেষে দর্শকদের আমি বলতাম, এ বিষয়ের বিস্তারিত যদি হাতেকলমে পেতে চান, আগামী বৃহস্পতিবারের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কৃষি কৌশল’ দেখুন। একই টেলিভিশনে ঠিক চার দিন পর দর্শক অপেক্ষা করে অনুষ্ঠানটি দেখতেন। দেখে তিনি আরও সমৃদ্ধ হতেন। কৌশলটা শিখতেন। টেলিভিশনে দেখে যখন তিনি হাতেকলমে করতে যেতেন অনেক সময় হিসাব বা তথ্য ভুলে যেতেন। তখন সেই দর্শককে আমি টেনে নিয়ে এলাম পত্রিকায়। তখন দৈনিক ‘জনকণ্ঠ’ খুব দাপটের সঙ্গে চলছে। সেখানে ‘চাষবাস’ নামে একটা কলাম লিখতাম। ‘চাষবাস’ কলামে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে যা দেখলাম, সেই তথ্যগুলো সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরতাম। এতে প্রথম মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠান দেখে কৃষক উদ্বুদ্ধ হতেন, তিনি হাতেকলমে কৌশল জানার জন্য দেখতেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কৃষি কৌশল’। আর তথ্যগুলো কাগজে নিশ্চিতভাবে পাওয়ার জন্য তাঁরা পড়তে শুরু করলেন জনকণ্ঠের চাষবাস কলাম। এটি হয়ে উঠল তথ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটা ত্রিমুখী মডেল। তখনকার কৃষির উত্তরণে এই ত্রিমুখী কার্যক্রমের বড় একটি অবদান ছিল। দেশে অগণিত সফল খামারি রয়েছেন, যাঁরা সে সময়ের এই ত্রিমুখী সম্প্রসারণ কার্যক্রমের কল্যাণে কৃষিতে আসেন এবং উত্তরোত্তর সাফল্য অর্জন করেন।
বর্তমান সময়ে এসে অনলাইন শিখনপদ্ধতি বেশ সমৃদ্ধ হয়েছে। শুধু সরকারি পর্যায়ে নয়, বেসরকারি পর্যায়ে কৃষি প্রশিক্ষণের পরিধি বাড়ানো যেতে পারে। যে কোনো কৃষি প্রশিক্ষণে সরকারের সম্পৃক্ততার যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি প্রয়োজন আছে সরকারি নীতিমালার। ফেসবুক, ইউটিউবের এই সময়ে নানাভাবেই কৃষকের কাছে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। ভার্চুয়ালি তথ্য প্রদান কিংবা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে যারা কাজ করছেন, তারা চাইলে কৃষি প্রশিক্ষণ বিষয়ে ক্যানভাস, ডোমেস্টিকা বা ইউডেমির মতো অনলাইন প্রশিক্ষণ প্ল্যাটফরম তৈরি করতে পারেন। এ ক্ষেত্রেও সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তবে অবশ্যই তা যেন হয় সরকারের তদারকির মাধ্যমে।
প্রশিক্ষিত দক্ষ জনগোষ্ঠীই দেশের সম্পদ। সব পেশাতেই দক্ষতার বিষয় রয়েছে। শুধু কৃষিই যেন বংশানুক্রমে প্রশিক্ষণ ছাড়াই যে কেউ করতে পারে। অথচ কৃষিতেই প্রয়োজন পূর্ণ মনোযোগ এবং কৌশলগত নানান ধরনের প্রাসঙ্গিক জ্ঞান ও তার প্রয়োগ। তরুণরা আগ্রহী হচ্ছে কৃষিতে। তৈরি হচ্ছে কৃষি উদ্যোক্তা। ঠিক এই সময়ে এসে কৃষি প্রশিক্ষণের গুরুত্ব বেড়ে গেছে অনেক। উদ্যমী তরুণদের কৌতূহলকে অমিত সম্ভাবনায় পরিবর্তন করা গেলে বেকারত্বের অভিশাপ যেমন দূর হবে, দেশ এগিয়ে যাবে সমৃদ্ধির পথে।
লেখক : মিডিয়াব্যক্তিত্ব