বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে পরিচালিত কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনে রূপান্তরিত হওয়ার সময় যেসব দল, গ্রুপ এতে যোগ দেয়, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য রয়েছে। ফ্যাসিস্ট রেজিম পতন আন্দোলনে সক্রিয় থাকায় অন্যান্য ইস্যুতেও তারা একমত হবে– এমন প্রত্যাশা স্বাভাবিক নয়। এখন বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মতপার্থক্য বেরিয়ে আসাই স্বাভাবিক। আন্দোলনে কোন পক্ষের কতটা ভূমিকা ছিল, তা নিয়ে বিতর্কও ‘রাজনৈতিক বাস্তবতা’য় অস্বাভাবিক নয়। এরই মধ্যে আশা করা সংগত, আন্দোলনকারী শক্তিগুলোর মতপার্থক্য সংঘাতে গড়াবে না; সংস্কার ও নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রত্যাশা পূরণের পথ সংকটসংকুল হবে না। এ ক্ষেত্রে আমরা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসা অন্তর্বর্তী সরকারের সুস্পষ্ট ভূমিকা দেখতে চাই, যার নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাগরিক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর কারণেও প্রত্যাশা বেশি।
সংস্কারপূর্বক নির্বাচনের এজেন্ডা ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময়েও ছিল। মোটামুটি গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করলেও সংস্কারে তারা সফল হয়নি। পরবর্তী সরকার দেশ চালিয়েছে সংস্কারের সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে। ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার ভোটাধিকারও তারা ধ্বংস করে দেয়। সে ধারায় বিনষ্ট করে বিচার বিভাগ, পুলিশসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। দুর্নীতির ভয়াবহ রূপ প্রত্যক্ষ করে জনগণ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইচ্ছাকে দমন করে শাসন চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও পাকা করে ফেলে তারা। শেষে শিক্ষার্থীদের একটি ন্যায়সংগত আন্দোলন দমনেও আলোচনার বদলে শক্তি প্রয়োগ করতে গিয়ে পরিস্থিতির এত অবনতি ঘটায় যে, তারা এখন অভিযুক্ত গণহত্যার দায়ে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে। তাঁর দলের লোকজন এখন নজিরবিহীন বিপর্যয়ে। সামনের নির্বাচনে দল হিসেবে তাদের অংশগ্রহণ অনিশ্চিত। এমনকি দলটি রয়েছে নিষিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে।
এ অবস্থায় যেটুকু সংস্কার হবে, তাতে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ থাকবে না বলেই ধরে নিতে হবে। সংস্কার করবে ইউনূস সরকার আর তাতে অংশ নেবে আন্দোলনকারী দলগুলো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অবশ্য রাজনৈতিক দল নয়; বরং ‘সাধারণ ছাত্রদের প্ল্যাটফর্ম’। সরকার পতনের স্বপ্ন নিয়েই তারা একত্র হয়েছিল, তা নয়। তবে তাদের নেতৃত্বেই শেষতক একটি প্রায়-অসাধ্য সাধন করেছে ছাত্র-জনতা। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিয়ে ড. ইউনূসও প্রায় সব বক্তৃতায় এটা বলেছেন। সত্য এ-ও যে, নতুন ধারার এ ছাত্রনেতাদের মধ্যেও রয়েছে রাজনৈতিক মতপার্থক্য। তারা সবাই অভিন্ন বাংলাদেশ গড়তে চান– সেটা বলা যাবে না। তাদের অনেকে ‘ইসলামিস্ট’ হলেও সবাই তা নন। গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য এ কারণেও সহজে অনুমেয়। এ জন্য সংস্কারের উদ্যোগ ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা থাকলেও ইতিবাচক দিক হলো, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সবাই সংস্কারের পক্ষে। সংস্কারের আগে নির্বাচনের দাবি কোনো পক্ষ থেকেই ওঠেনি। তবে প্রশ্ন রয়েছে– কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার আর এতে কতদিন লাগবে।
ছয়টি ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন বলে সরকার মনে করে এবং সে লক্ষ্যে সুপারিশ দিতে ছয়টি কমিশন গঠনের ঘোষণা এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগ। বিগত সরকার গোটা নির্বাচন ব্যবস্থাই ধ্বংস করে দিয়েছিল। এমনকি পেশাজীবী সমিতি থেকেও হারিয়ে যায় নির্বাচনের সংস্কৃতি। সুতরাং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হলেও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার করতেই হবে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আশায় আওয়ামী লীগেরও এখন এটা সমর্থন করার কথা!
বিচার বিভাগ, পুলিশসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কারও জরুরি। নইলে নির্বাচিত সরকারও গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথ থেকে বিচ্যুত হতে পারে। সংবিধানেও ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ও ফ্যাসিবাদ গড়ে ওঠার সুযোগ আছে বলে মনে করা হচ্ছে। তাই এসেছে সংবিধান সংস্কারের প্রশ্নও। কেউ কেউ এটা পুনর্লিখনের পক্ষে। এসব ক্ষেত্রে কমিশন গঠনে অবশ্য কিছু জটিলতা হচ্ছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ অবস্থায় আরেক দফা বসতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার, যা নিশ্চিতভাবে ইতিবাচক। এর উদ্দেশ্য কি সংস্কারের আওতা কিছুটা কমিয়ে আনা? চাপের মুখে সিদ্ধান্ত বদলের উদাহরণ আছে। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে এগুলোকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। তবে এ সরকার যে একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সত্তা– তার প্রমাণ দেওয়ার দাবি রয়েছে। রুটিন কাজের পাশাপাশি তার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকাও তাই স্বাভাবিক।
লক্ষ্য যদি হয় কেবল গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন, তাহলে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার করলেই চলবে। তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা লক্ষ্য হলে উল্লিখিত ক্ষেত্রগুলোয়ও করতে হবে সংস্কার। অনেকে তো বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন ও ব্যাংক ব্যবস্থার সংস্কারকেও জরুরি মনে করেন। সংস্কারের চাহিদা এত তীব্র যে, এ ক্ষেত্রে জোরালো সহায়তা জোগানোর কথা বলছে উন্নয়ন সহযোগীরাও। জনগণের একাংশও বলছে– জরুরি সংস্কার করতে যত দিন লাগে লাগুক। কিন্তু মনে হয় না রাজনৈতিক দলগুলো এ প্রশ্নে একমত। আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী ছাত্রনেতারাও পুরো একমত হবেন না। সরকারের ভেতরেও মতপার্থক্য থাকতে পারে। ইতোমধ্যে সেনাপ্রধান এ বিষয়ে মত দিয়েছেন। সেনাবাহিনী শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারকে বিশেষভাবে সহায়তা জুগিয়ে যাচ্ছে। সে কারণে সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে সেনাপ্রধানের মতটি গুরুত্বপূর্ণ।
গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতি তাই জটিল। রাজনীতির সব পক্ষ এখন যার যার মতো সোচ্চার। ক্ষমতাচ্যুতরা মাঠে না থাকলেও তাদের নিষ্ক্রিয় বলা যায় না। এর সমর্থকরা সোচ্চার ফেসবুকে। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কোনো কোনো পক্ষ আবার জবরদস্তিমূলক আচরণ করছে। কারণে-অকারণে ঘটছে আইনশৃঙ্খলার অবনতি। সামনে দুর্গাপূজায় শান্তিশৃঙ্খলা অটুট রাখার প্রশ্ন রয়েছে। সরকার সম্ভবত সে ব্যাপারেও রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তা চাইবে। তবে সংস্কারের প্রশ্নটি যেন গুরুত্ব না হারায়। রাজনৈতিক মতপার্থক্যের মধ্যেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় জরুরি সংস্কারগুলো হতেই হবে। নির্বাচিত সরকারও সংস্কার করতে পারে। তবে তার ওপর সে বিশ্বাস তো নেই। থাকলে অন্তর্বর্তী সরকারকে এত চাপ নিতে হতো না। একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করেই তারা বিদায় নিতে পারত।
সংস্কার প্রশ্নে গণঅভ্যুত্থানে যোগদানকারীদের ঐক্য বজায় থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আর সেনাবাহিনীর অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্বর্তী সরকারেরও সুস্পষ্ট মত থাকা চাই। এ অবস্থায় রাজনৈতিক মতপার্থক্যের ক্ষেত্রগুলোয় ঢোকার কোনো প্রয়োজন নেই। হালে পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল। এমন ইস্যুগুলো নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে দেওয়াই ভালো; যেহেতু বড় মতপার্থক্য এ ক্ষেত্রে রয়ে গেছে খোদ আন্দোলনকারীদের মধ্যে। ফ্যাসিস্ট সরকার তার সব প্রতিপক্ষকে ‘একটি দণ্ডে একাত্ম’ করলেও অন্যান্য প্রশ্নে তাদের মতপার্থক্য তো রয়েই গেছে। তবে রাষ্ট্র ব্যবস্থার কিছু জরুরি সংস্কারে তারা একমত বলেই মনে হয়। সে জায়গাটা ধরেই সরকারকে দ্রুত এগোতে হবে। এর ভেতর দিয়ে সরকারও সংহত হবে বলে ধারণা।
nহাসান মামুন: সাংবাদিক, বিশ্লেষক