আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস যেমন গৌরবের, তেমন শোকের। প্রতিদিন অসংখ্য স্বজন হারিয়েছি আমরা। শত্রুকে পরাজিত করে ক্রমাগত এগিয়েছি বিজয়ের দিকে। একাত্তরের ২৯ নভেম্বর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তেমনই এক শোক ও গৌরবের দিন। দিনটি বক্তাবলী গণহত্যা ও প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পরিচিত।

২৫ মার্চ ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার দুই দিন পর ২৭ মার্চ দুপুরে পাকিস্তানি সেনারা নারায়ণগঞ্জে প্রবেশ করতে গেলে ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে পড়ে। সে রাতে শহরে না ঢুকে নারায়ণগঞ্জ সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে কাটিয়ে ২৮ মার্চ সকালে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শহরে ঢোকে। যুদ্ধকালীন গোটা ৯ মাস তারা নিরীহ মানুষের ওপর চালায় নির্মম নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ। সারাদেশের মতো নারায়ণগঞ্জেও রয়ে গেছে তাদের সে নির্যাতন ও বর্বরতার অসংখ্য চিহ্ন। নারায়ণগঞ্জে সংঘটিত হয়েছে ১০৯টি গণহত্যা; রয়েছে ৩৩টি বধ্যভূমি ও গণকবর এবং ৪৬টি নির্যাতন কেন্দ্র। যেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও নিরপরাধ নিরীহ মানুষকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের পশ্চিমাঞ্চল ধলেশ্বরীর পাড় ধরে বক্তাবলীর ২২টি গ্রাম।

১৯৭১-এর ২৯ নভেম্বর রাতে যখন ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা বক্তাবলী পরগনা, তখন নারায়ণগঞ্জ শহরের কয়েকজন রাজাকারের সহযোগিতায় রাত সাড়ে ৩টায় পাকিস্তানি বাহিনী তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে গোটা বক্তাবলী। প্রথমে তারা গানবোট নিয়ে ধলেশ্বরী নদীর বুকে অবস্থান নেয়। সুবেহসাদেকের সময় বক্তাবলীর চরে গানবোট ভিড়িয়ে নদীর পাড়ে নামতে শুরু করে। সেদিন প্রচণ্ড কুয়াশার কারণে তারা গ্রামে অগ্রসর হতে সাহস করে না। সে সময় মুক্তারকান্দি প্রাইমারি স্কুল ও কানাইনগর হাই স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি ক্যাম্প ছিল। নদীর পাড়সংলগ্ন ডিক্রির চর মসজিদ ও বিভিন্ন বাড়িতে রাত কাটাতেন মুক্তিযোদ্ধারা। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন পাকিস্তানি সেনাদের উপস্থিতি সঙ্গে সঙ্গে টের পেয়ে যান এবং প্রতিরোধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। অন্যদিকে কুয়াশা একটু কাটতে থাকলে কুঁড়েরপাড় অঞ্চলের নদীর কাছ থেকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তখন সকাল প্রায় ৭টা। মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ শুরু করেন। উল্লেখ্য, মাহফুজুর রহমান মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের প্রথম চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। প্রতিরোধের শুরুতেই পাঁচজন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেন মুক্তিযোদ্ধারা এবং আহত হয় বেশ কিছু। পাকিস্তানি সেনারা পাঁচটি লাশ ও আহত দু'জনকে কাঁধে নিয়ে পিছু হটে। এখানে প্রায় দুই ঘণ্টা প্রতিরোধ যুদ্ধ চলে। এ দুই ঘণ্টা প্রতিরোধের কারণে বক্তাবলীর গ্রামগুলো থেকে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ তখন মুন্সীগঞ্জ ও বিভিন্ন অঞ্চলে নিরাপদে সরে যেতে সক্ষম হয়। এর পরপরই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে গ্রামগুলোর ওপর। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা বাধ্য হয়ে পিছু হটেন। তখনই শুরু তাদের তাণ্ডব। তারা ডিক্রির চর নদীর পাড়ে সারিবদ্ধ দাঁড় করিয়ে একসঙ্গে হত্যা করে ৪০ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে। লক্ষ্মীনগর কবরস্থানের কাছে খড়ের পালার ভেতরে আশ্রয় নেওয়া দলবদ্ধ গ্রামবাসীকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে। শীতের সকালে রাজাপুরের হলুদ সরিষা ক্ষেত লাল হয়ে ওঠে।পড়ে থাকে লাশের পর লাশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র শহীদুল্লাহ্‌, মুনীরুজ্জামানসহ বহু ছাত্র আর সাধারণ কৃষককে হত্যা করে তারা। সেদিন বক্তাবলীতে ১৩৯ জনকে হত্যা করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী। বক্তাবলী পরগনার ২২টি গ্রাম গানপাউডার দিয়ে বিকেলের মধ্যে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।
দেশে যে কয়টি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, বক্তাবলী তার মধ্যে অন্যতম। আজ ৫০ বছর পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ছাত্রদের তালিকায় যেমন এ বক্তাবলীর শহীদদের নাম নেই; স্থানীয় জেলা প্রশাসনের শহীদদের তালিকায়ও এই ১৩৯ জনের একজনেরও নাম নেই। অথচ এই একটি মাত্র অঞ্চল, যেখানে একজনও রাজাকার বা স্বাধীনতাবিরোধী ছিল না। এ ২২টি গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই গ্রামবাসী মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস নিজেরা খেয়ে না-খেয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও আশ্রয় নেওয়া মানুষদের খাইয়েছেন। আশ্রয় দিয়েছেন। এ গ্রামগুলোর ছাত্র, যুবক, কৃষক প্রত্যেকেই ছিলেন প্রকৃত অর্থে মুক্তিযোদ্ধা। বক্তাবলীর সন্তানহারা, পিতাহারা, স্বজনহারা শহীদ পরিবারগুলোয় এখনও আহাজারি, বুকফাটা আর্তনাদ। বেঁচে থাকা, টিকে থাকার জন্য প্রাণপণ লড়াই করেও মানবেতর জীবনযাপন করছে অনেক শহীদ পরিবার।

ভুল-ত্রুটি থাকলেও দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা রয়েছে। তাঁরা সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সহায়তা পেয়ে থাকেন। কিন্তু নির্মম হলেও সত্য, ৫০ বছরেও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের কোনো তালিকা এখানে তৈরি করা যায়নি। শহীদ পরিবারগুলো সরকার বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনো সহায়তা পায় না। বিভিন্ন সময় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাষ্ট্র বা সরকারের প্রতিশ্রুতির জোয়ার উঠলেও সে ঢেউ ৫০ বছরেও বুড়িগঙ্গা-ধলেশ্বরীর পাড়ে শহীদদের গ্রাম বক্তাবলীতে এসে আঘাত করেনি। এটি এক নির্মম বাস্তবতা।
রফিউর রাব্বি: লেখক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব





Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews