'মাহাতো' মূলত পদবি। বাংলাদেশে বসবাসরত 'বেদিয়া' ও 'কুর্মী' জাতিসত্তার মানুষ মাহাতো পদবি ব্যবহার করে। পদবি একই হলেও দুটি আলাদা জাতিসত্তা। রাষ্ট্রের তালিকায় দুটি জাতিসত্তাকে একত্রিত করে 'মাহাতো' জাতিসত্তা নামে পরিচিত ও উপস্থাপন করা হচ্ছে। দুই জাতিসত্তাকে একত্রে গেজেটভুক্ত করার ফলে বেদিয়া ও কুর্মী জাতিসত্তার মানুষ তাদের জাতিসত্তার প্রকৃত আত্মপরিচয় সংকটে ভুগছে।

'মাহাতো' পদবি প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মানুষ ব্যবহার করে আসছে। ১৮৯১ সালে বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েট প্রেস, কলকাতা থেকে প্রকাশিত হার্বার্ট হোপ রিজলি 'দ্য ট্রাইবস্‌ অ্যান্ড কাস্টস্‌ অব বেঙ্গল' শীর্ষক এথনোগ্রাফিক গবেষণায় দেখিয়েছেন- বেদিয়া, কুর্মী, মুসহর, নুনিয়া, খেড়ওয়ার, মুন্ডা, ওরাওঁ, রাজোয়ার, চিক, পাতর, থারু, বিন্দ, ধোবি, কৈরী, তাঁতি, দুসাত, কাহার, পাসি, গোয়ালা, কুমহার, ধানুক প্রভৃতি আদিবাসী জাতিসত্তা ও তপশিলি সম্প্রদায়ের মানুষ মাহাতো পদবি ব্যবহার করে থাকে। রিজলি তাঁর এথনোগ্রাফিক গবেষণায় আরও উল্লেখ করেন, মুন্ডা সমাজ কাঠামোয় 'মাহাতো' নামে দাপ্তরিক পদবি রয়েছে। মাহাতো সেখানে গ্রাম্য হিসাবরক্ষক বা গ্রাম্য সেটেলমেন্ট অফিসার হিসেবে কাজ করত (পৃ. ১০৫)। তিনি 'ড. ডেভিডসন্স রিপোর্ট-১৮৩৯'-এর উদ্ধৃতি দিয়ে মাহাতোর কার্যক্রম তুলে ধরে দেখান, মাহাতো গ্রামের বিভিন্ন রায়তের চাষাবাদের হিসাব সংক্রান্ত যেমন- কৃষককে জমি চাষ করতে দেওয়া, কৃষকের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা, রায়তে নতুন জমি যুক্ত হওয়া ইত্যাদি কাজ করেন (পৃ. ১০৬)। মুন্ডা সমাজের মতোই ওরাওঁ সমাজ পরিচালনায় 'মাহাতো' নামে প্রশাসনিক অফিসারের উল্লেখ পাওয়া যায়। ওরাওঁদের গ্রামপ্রধানকে মাহাতো নামে ডাকা হয়। রিজলির আগে এডওয়ার্ড টুইট ডাল্টন তাঁর 'ডেসক্রিপটিভ এথনোলজি অব বেঙ্গল' (১৮৭২) গ্রন্থেও মাহাতো সম্পর্কে একই কথা তুলে ধরেছেন। ১৮৭২ সালে বাংলার রেজিস্ট্রেশন ইন্সপেক্টর-জেনারেল এইচ বেভারলে কর্তৃক প্রকাশিত 'রিপোর্ট অন দ্য সেন্সাস অব বেঙ্গল ১৮৭২'-এ 'মাহাতো' নামে কোনো জাতিসত্তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। বৃহত্তর বাংলার অন্তর্ভুক্ত পাঁচ প্রদেশ যেমন- বাংলা, ছোটনাগপুর, উড়িষ্যা, বিহার, আসামের শুমারির রিপোর্টে প্রাচীন ভারতের জনগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়কে তিন ভাগে যেমন- (১) আদিবাসী; (২) হিন্দু-মিশ্রিত আদিবাসী; এবং (৩) হিন্দু সম্প্রদায়ে বিভক্ত করে গণনায় দেখানো হয়েছে। আদিবাসী অংশে আদিবাসী জাতিসত্তাগুলো; হিন্দু-মিশ্রিত আদিবাসী অংশে হালকা হিন্দু ধর্মীয় প্রভাবযুক্ত আদিবাসী জাতিসত্তাগুলো; এবং হিন্দু সম্প্রদায় অংশে পেশার ভিত্তিতে হিন্দু সম্প্রদায়গুলোকে ১২টি পেশায় ভাগ করে আদমশুমারিতে অন্তর্ভুক্ত করে গণনা করা হয়েছে। শুমারির রিপোর্টে উল্লিখিত বিভিন্ন জাতিসত্তা ও সম্প্রদায়ের তালিকায় 'মাহাতো' নামে কোনো জাতিসত্তা বা সম্প্রদায়ের নাম নেই। রিপোর্টে বৃহত্তর বেঙ্গলের পাঁচ প্রদেশ- বেঙ্গল, ছোটনাগপুর, উড়িষ্যা, বিহার ও আসামে তৎকালীন 'মাহাতো' পদবি ব্যবহারকারী বেদিয়া, ভূমিজ, ভূঁইয়া, ওরাওঁ, মুন্ডা, দুসাদ, খাড়োয়ার, রাজোয়ার, চিক, পাসি, কুর্মী, কৈরী, নুনিয়া, কুমহার, ধোবি, গোয়ালা, তাঁতি প্রভৃতি আদিবাসী জাতিসত্তা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের তালিকা রয়েছে। ১৮৮১ সালেও 'রিপোর্ট অন দ্য সেন্সাস অব বেঙ্গল ১৮৮১'-এ মাহাতো জাতিগোষ্ঠীর কোনো তথ্য উল্লেখ নেই। ১৮৭২ সালের বেঙ্গল শুমারিতে ছোটনাগপুর প্রদেশে আদিবাসী খাড়োয়ার জাতিসত্তার চারটি উপগোত্রের মধ্যে একটি মাহাতো নামে পাওয়া যায়। তবে ১৮৮১ সালের বেঙ্গল শুমারিতে খাড়োয়ার জাতিসত্তার কোনো উপগোত্রেরই খোঁজ পাওয়া যায় না। ভারতে বর্তমানেও মাহাতো নামে কোনো জাতিসত্তার অস্তিত্ব নেই। তবে মাহাতো পদবি ব্যবহারকারী বিভিন্ন জাতিসত্তার অস্তিত্ব রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত।

আদিবাসী জাতিসত্তাগুলো গোত্রভিত্তিক। প্রতিটি আদিবাসী জাতিসত্তার নিজস্ব গোত্র প্রথা রয়েছে এবং তা মেনে চলে। অধ্যাপক মেসবাহ কামাল সম্পাদিত 'বাংলাদেশের আদিবাসী' (২০১০) শীর্ষক এথনোগ্রাফিক গবেষণা গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডে 'মাহাতো' নামে জাতিসত্তার বর্ণনা দিলেও সেখানে অধিকাংশই বেদিয়া জাতিসত্তার ঐতিহ্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি, কৃষ্টি তুলে ধরেছেন এবং কুড়মি/কুর্মীদের তথ্যের সঙ্গেও সংমিশ্রণ করেছেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে- বেদিয়া মাহাতোদের সঙ্গে কুড়মি মাহাতোর বিয়ের প্রচলন নেই, এটা সত্য। মাহাতো হিসেবে যে গোত্র বা টোটেমের উল্লেখ করা হয়েছে তা বেদিয়া জাতিসত্তার গোত্র বা টোটেম প্রথা। কুর্মীদের গোত্রের কথা তুলে ধরা হয়নি সেখানে। বেদিয়াদের গোত্র ও কুড়মিদের গোত্র আলাদা। আবার মাহাতোদের ভাষা কুড়মালি বলা হয়েছে, তা ঠিক নয়। কুড়মালি হলো কুড়মি/কুর্মী জাতির ভাষা। বেদিয়া ও কুড়মি জাতিসত্তার আত্মপরিচয়ের সংকট দূর করতে আদিবাসী জাতিসত্তার তালিকা (গেজেট) সংশোধন করা জরুরি। 'মাহাতো' নয়; বেদিয়া ও কুড়মি জাতিসত্তার নামেই দুটি জাতিসত্তা নিজস্ব পরিচয় ফিরে পাক। বেঁচে থাকুক আত্মপরিচয়ে; সগৌরবে।

লেখকবৃন্দ: বাংলাদেশে বসবাসরত বেদিয়া জাতিসত্তার সদস্য





Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews