মক্কা, মদিনা এবং বায়তুল মুকাদ্দাস হচ্ছে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মীয় স্থান। বিশ্বের ৫৬টি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ বহু বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতদ্বৈততা পোষণ করে থাকে। কিন্তু এ তিনটি ধর্মীয় পবিত্র স্থান সম্পর্কে কারো মধ্যে কোনো মতপার্থক্যতা নেই। জেরুসালেমের সেই বায়তুল মুকাদ্দাস বা আল-আকসা আবার বিশ্ব শিরোনাম।
গত ১০ মে ২০২১, জেরুসালেমে আল-আকসা মসজিদ চত্বর এবং অভ্যন্তরে ঢুকে ইসরায়েলি পুলিশের বেধড়ক লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস এবং রাবার বুলেটে তিনশরও বেশি ফিলিস্তিনি আহত হওয়ার পর গাজা ভূখণ্ড থেকে সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েল দিকে রকেট ছোঁড়া শুরু করে।

বদলা নিতে ইসরায়েল গাজায় বিমান হামলা শুরু করেছে, এবং এখন পর্যন্ত পাওয়া খবরে কমপক্ষে ৩০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। সংঘাত যে বিপজ্জনক চেহারা নিয়েছে - তা ২০১৮ সালের পর দেখা যায়নি। ২০১৪ সালের পরে এই প্রথম গাজা থেকে জেরুসালেমকে লক্ষ্য করে রকেট ছোঁড়া হয়েছে। কয়েকটি রকেট শহরের উপকণ্ঠে এসে পড়ে – যদিও ইসরায়েলের দিক থেকে হতাহতের কোনো খবর বলা হয়নি।

এমন পরিস্থিতিতে, দুপক্ষকে শান্ত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার কথা বলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মঙ্গলবার পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র নেড প্রাইস এটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের সংঘর্ষ চালানো বন্ধ করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা 'সীমাবদ্ধ'। তিনি ইসরায়েলে হামাসের রকেট হামলাকে ‘ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার’এক রূপ হিসেবে উল্লেখ করলেও, যুক্তরাষ্ট্র গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলাটিকে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করেছে কিনা সে বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকার করেন। প্রাইস এও বলেছেন ‘ইসরায়েলের নিজেকে রক্ষা করার এবং রকেট হামলার জবাব দেওয়ার অধিকার রয়েছে’ এবং ‘ফিলিস্তিনি জনগণেরও ইসরায়েলিদের মতো তেমন সুরক্ষার অধিকার রয়েছে।’

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত বন্ধে মার্কিনীদের মধ্যস্থতাতে সততার অভাব ছিল বলে এই সমস্যাটার কোনও সমাধান সম্ভব হয়নি বলে মনে করেন বিশ্বের সেরা বিশ্লেষকরা, যদিও সংঘাতের শুরু থেকে মানে ১৯৪৮ সাল থেকে এ সমস্যা সমাধানের বিষয়ে তারা লেগে আছে। আমেরিকার বরং ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর অস্তিত্বই বিপন্ন করে ফেলেছে। ইরাকের আর লিবিয়ার আজকের অবস্থার জন্য শতাংশে আমেরিকাই দায়ী এবং তা করা হয়েছে ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য। ইরানকে পঙ্গু করার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। মিশরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে সরিয়ে তার জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল সিসিকে প্রেসিডেন্ট করা হয়েছে একই কারণে। যুক্তরাষ্ট্রের কলকাঠিতে ইসরায়েলের সঙ্গে ১৩ আগস্ট ২০২০ সংযুক্ত আরব আমিরাত, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ বাহরাইনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক করেছে। অলিখিত সম্পর্ক হয়েছে সৌদি আরবের সঙ্গেও। এর আগে ১৯৭৯ সালে মিশর এবং ১৯৯৪ সালে জর্দানের সঙ্গে চুক্তি করে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে ইসরায়েল।

মোটামুটি প্রেসিডেন্ট জিমি কাটার থেকে আরম্ভ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত সবাই সমস্যাটি নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে গ্রহণযোগ্য সমাধানের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোন রূপরেখার ভিত্তিতে ফিলিস্তিন সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান হবে তার সুস্পষ্ট ধারণা সবার মধ্যে ছিল না—এটি কী দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান হবে নাকি এক রাষ্ট্রের ভিত্তিতে হবে। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মধ্যস্থতায় ১৯৯৮ সালে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। ইয়াসির আরাফাত এবং নেতানিয়াহু ক্লিনটনের উপস্থিতিতে হোয়াইট হাউসে এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তখনই দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের রূপরেখা সুস্পষ্ট রূপ নেয়।

১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কিছু জায়গার অধিকার পায়। ২০০৪ সালে ফিলিস্তিনিদের শক্তিশালী নেতা ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর ফিলিস্তিন আন্দোলনের গতি স্তিমিত হয়ে পড়ে। আরাফাতের মৃত্যুর পর বড় ঘটনা হচ্ছে ৩১ জুলাই ২০১৯ সালে জাতিসংঘের ১৩৮টি সদস্য দেশের ভোটে রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি পাওয়া। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি অগ্রগতিতে সবচেয়ে বাধা হয়ে কাজ করছেন এখন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু খুবই কট্টর ও কঠিন প্রকৃতির লোক। তিনি এক রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পক্ষের লোক, যে কারণে সমাধানের বিষয়ে পূর্বের আলোচনার আর কোনও অগ্রগতি হয়নি।

সাম্প্রতিক হামলার নেপথ্য নায়কও বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এটিকে উৎসাহিত করেছে বলে ধরে নেওয়া যায়। কারণ গত দুই বছর ধরে ইসরায়েলে একের পর এক নির্বাচনে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছেনা। সর্বশেষ মার্চ ২০২০ এর নির্বাচনের পরও নেতানিয়াহু শরীক জোগাড় করে সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হলে প্রেসিডেন্ট বিরোধী ইয়েস আডিট দলের নেতা ইয়ার লাপিডকে সরকার গঠনের সুযোগ দেন। সরকার গড়তে হলে আরব দলগুলোর সমর্থন দরকার লাপিডের।

সেই চেষ্টা চালানোকালেই পূর্ব জেরুসালেমের আরব অধ্যুষিত এলাকা শেখ জারাহ থেকে চারটি ফিলিস্তিনি পরিবারকে বাড়িছাড়া করার এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এরপর আসে আল-আকসায় হামলা এবং গাজায় আক্রমনের ঘটনা। এমন পরিস্থিতে আরব দলগুলোর সঙ্গে সরকার গঠন নিয়ে লাপিডের সমঝোতা অসম্ভব। বরং উল্টো তাকে এবং তার বর্তমান শরিকদেরও এখন সরকার ও সেনাবাহিনীকে সমর্থন দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আর এই সংঘাতের রাজনৈতিক ফায়দা এখন নিশ্চিতভাবেই পাবেন নেতানিয়াহু। লাপিড সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে ব্যর্থ হলে ইসরায়েলে আরেক দফা নির্বাচনের সম্ভাবনা তৈরি হবে। আর ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে চলতি এই বিরোধ কাজে লাগিয়ে নেতানিয়াহু জয়ী হতে পারবেন।

তবে আমার ধারণা বার বার একই খেলায় নেতানিয়াহু জয়ী হবে সত্য নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যার জন্য ইসরায়েলকে ভারী মূল্য দিতে হবে। অধিকৃত জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদের পবিত্রতা লঙ্ঘন করে; নিরস্ত্র ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের হত্যা ও আহত করে এবং অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ইসরায়েল সহজে পার পাবে না। নেতানিয়াহুর বর্ণবাদী নাৎসি-ধরণের নেতৃত্বকে তার নির্মম কৃতকর্মের পরিণতি ভোগ করতে হবে। এবার ইসরায়েলকে তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্র জামিনে ছাড়াতে পারবে না। মার্কিন জনগণও বাইডেনের উপর ক্ষিপ্ত হবে। করোনা এবং রমজানের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের প্রতি এই জুলুমে মধ্যপ্রাচ্যের শেখ-শাসিত রাষ্ট্রগুলোর শাসকরা চুপ করে থাকলেও জনগণের মধ্যেও সুপ্তক্ষোভ দেখা দিবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। [email protected]

এইচআর/জিকেএস



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews