প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের লাগাম টানতে চলমান কঠোর বিধিনিষেধ বা লকডাউনের মেয়াদ আরও বাড়তে পারে। আগামী ৫ আগস্টের পরও দুই সপ্তাহ কঠোর বিধিনিষেধ অব্যাহত রাখার সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, 'জীবন-জীবিকার সমন্বয় করে' কিছু বিষয় শিথিল করে বিধিনিষেধ অব্যাহত রাখার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে সরকার রপ্তানিমুখী সব শিল্প ও কলকারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামীকাল রোববার সকাল ৬টা থেকে এসব কারখানা বিধিনিষেধের আওতাবহির্ভূত থাকবে। গতকাল শুক্রবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের এই সময়ে বিধিনিষেধ তুলে দিলে পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হতে পারে। এর পরও রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা খুলে দেওয়া হচ্ছে। এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। বিষয়টি কঠোর নজরদারির আওতায় রাখতে হবে। না হলে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

এর আগে গত ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ১৪ দিন জরুরি সেবা ছাড়া সবকিছু বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এতে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাধার মুখে পড়ে। অনেক কোম্পানি ক্রয় আদেশ হারায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর নেতৃত্বে রপ্তানিমুখী বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতারা কয়েক দফা মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সঙ্গে বৈঠক করেন। গত বৃহস্পতিবারও তারা সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে শিল্পকারখানা খুলে দেওয়ার দাবি জানান।

সরকারের এ সিদ্ধান্তের ফলে তৈরি পোশাক, চামড়া, পাট ও পাটজাত পণ্য, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত ও হিমায়িত খাদ্য, প্লাস্টিক পণ্য, বাইসাইকেল, কেমিক্যাল প্রডাক্টস, ওষুধ, প্রকৌশলী যন্ত্রাংশ, কাগজ ও কাগজ পণ্য, হ্যান্ডি ক্রাফটস, রাবার ও কার্পেট খাতের শিল্পকারখানা খোলা থাকবে। পাশাপাশি এসব খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক কারখানা খোলা রাখা যাবে। কঠোর লকডাউন শুরুর আগেই খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, চামড়া প্রক্রিয়াজাত, ওষুধ ও করোনা সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনকারী কারখানা বিধিনিষেধের আওতার বাইরে রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, তা অব্যাহত থাকবে।

শিল্পকারখানা খুলে দেওয়ার ঘোষণার পর গতকালই গ্রাম থেকে মানুষের ঢাকামুখী ঢল নেমেছে। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। সড়ক-মহাসড়কেও যানবাহন চলাচল বেড়েছে। তবে বিধিনিষেধ শিথিলের আগে ঈদে গ্রামে যাওয়া কর্মীদের নিজ নিজ স্থানে থাকতে বলেছে বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ। সংগঠনটির সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম সমকালকে বলেন, শিল্পকারখানা খোলা হলেও কারখানার আশপাশে থাকা কর্মীদের নিয়ে আপাতত কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। ঈদে গ্রামে যাওয়া কর্মীদের প্রতি আহ্বান থাকবে, ছোটাছুটি না করে সরকারিভাবে বিধিনিষেধ শিথিল হলে সবাই কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন।

দোকানপাট ও গণপরিবহন খুলে দেওয়ার দাবি :ক্ষুদ্র ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও দোকান লকডাউনের আওতায় না রাখার দাবিতে আগামীকাল রোববার সংবাদ সম্মেলন করবে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি। এতে বর্তমান পরিস্থিতিতে নানা সমস্যা ও সমাধানের পথ তুলে ধরা হবে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।

দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন সমকালকে বলেন, আর কোনো লকডাউন চান না দোকান মালিকরা। পুঁজি হারিয়ে প্রায় নিঃস্ব হওয়া ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে দোকান খুলে দেওয়া প্রয়োজন।

তিনি বলেন, মরার আগে আর না খেয়ে মরতে চান না ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। গত ২৮ জুন থেকে সারাদেশে দোকান ও শপিংমল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ঈদের সময় পাঁচ দিন চালু রাখার সুযোগ দিলেও তা কাজে আসেনি। টানা প্রায় এক মাস বন্ধ থাকায় অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে শত শত কোটি টাকার পণ্য দোকানে নষ্ট হয়ে গেছে। এর পরও লকডাউনের সুফল দেখতে পাচ্ছেন না। এখন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জীবন চলে না। এ অবস্থায় তারা সব ধরনের নির্দেশনা মেনে দোকান চালু রাখতে চান।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ সমকালকে বলেন, লকডাউনে পরিবহন খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় গণপরিবহনকে বিধিনিষেধের আওতার বাইরে রাখতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই। গণপরিবহন চালু না থাকায় দূরপাল্লার যাত্রীরা মাইক্রোবাসে গাদাগাদি করে ঢাকায় ফিরছেন। আবার ঢাকাসহ বিভিন্ন নগরীতে চলাচলেও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। কিন্তু গণপরিবহন চালু করা হলে এক আসন খালি রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল করা হবে। সুতরাং সরকারের প্রতি আহ্বান থাকবে, শিল্পকারখানার পাশাপাশি গণপরিবহনও বিধিনিষেধের আওতার বাইরে রাখুন।

আরও ১৪ দিন চায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর :চলমান ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধ আগামী ৫ আগস্ট শেষ হচ্ছে। এরপর আরও নূ্যনতম ১৪ দিন কঠোর বিধিনিষেধ অব্যাহত রাখার সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত বৃহস্পতিবার এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এ প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর আগেই রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা খুলে দেওয়ার ঘোষণা এলো।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সমকালকে বলেন, লকডাউন কিংবা কঠোর বিধিনিষেধের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য চলমান কঠোর বিধিনিষেধ অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। এ জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কঠোর বিধিনিষেধ আরও বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। অতি জরুরি সেবা ছাড়া সবকিছু সীমিত রাখতে হবে। একই সঙ্গে নজরদারি জোরালো করতে হবে। সবকিছু খুলে দিলে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাবে।

রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা খুলে দেওয়ার প্রসঙ্গে মহাপরিচালক বলেন, জীবন-জীবিকার সমন্বয় করতে গিয়ে অতীতেও এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। শিল্পকারখানার মালিকরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে তারা শিল্পকারখানা খোলা রাখবেন। আমাদের আহ্বান থাকবে, কর্মীদের বাধ্যতামূলক মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব যেন নিশ্চিত করা হয়।

'স্বাস্থ্যবিধিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে':জরুরি প্রয়োজন ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা খুলে দেওয়া হলেও সেগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করার বিষয়ে সরকারের একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ থাকা প্রয়োজন। কতদিন বিধিনিষেধ আরোপ করে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এবং সে সময়ে জীবনযাত্রা কীভাবে চলবে, তা নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। কিন্তু সেটি করা হয়নি। এ কারণে কঠোর বিধিনিষেধ শেষ পর্যন্ত আর কঠোর রাখা সম্ভব হয় না। মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পকারখানা খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এবার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দোকানপাট খোলার দাবি তুলছেন। পরিবহন মালিকরা গণপরিবহন বিধিনিষেধের আওতার বাইরে রাখতে চান। এভাবে অন্য সেক্টরগুলো দাবি জানাবে। সরকার একে একে সবকিছু খুলে দিলে তখন তো আর বিধিনিষেধ থাকবে না। সুতরাং জরুরি এবং একান্ত প্রয়োজন না হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সুপারিশ আমলে নিয়ে সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। একই সঙ্গে খুলে দেওয়া শিল্পকারখানায় যাতে স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে মেনে চলা হয়, সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, টিকাকরণ করা গেলে সংক্রমণ কমে আসবে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় জোরালোভাবে টিকাদান কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি। প্রতিদিন এক কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার সক্ষমতা স্বাস্থ্য বিভাগের রয়েছে। কিন্তু টিকার সেই পরিমাণ জোগান না থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও মাস্ক ব্যবহারে গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু মানুষের এতে চরম অনীহা রয়েছে। এতে করে সংক্রমণ বাড়ছে।

তিনি বলেন, বিভিন্ন মহল থেকে দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পকারখানা খুলে দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় সবার প্রতি আহ্বান থাকবে, স্বাস্থ্যবিধি মানতে ও মাস্ক ব্যবহারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিন। না হলে পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ হবে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews