ষোলো শতক থেকে আঠারো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল ভারতবর্ষ। বাবর, হুমায়ুন, আকবর প্রমুখ শাসক তাদের রাজ্যের সীমা যত বাড়িয়েছেন, তাতে একইভাবে হিন্দু-মুসলিমসহ সব সম্প্রদায়ের লোকের জীবন সমৃদ্ধ হয়েছে। অথচ ভারতের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী সাহিত্য, সংস্কৃতিচর্চা ও বইপত্রে মুসলিম শাসনকে বর্বরতা, অন্যায় ও হিংস্রতার সর্বোচ্চ উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেছে।
শুধু ভারত বা পশ্চিমবঙ্গ নয়; বাংলাদেশেও বিভিন্ন অসংগতি চোখে পড়ে। যেমন গোপাল ভাঁড় চরিত্রের কথা বলা যাক। কার্টুনটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেন শিশুরা ‘দেবতুল্য’ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মহানুভবতা এবং অত্যন্ত বুদ্ধিমান গোপালের উপস্থিত বুদ্ধি থেকে শিক্ষা নিতে পারে। পাশাপাশি দেখানো হয় মুসলিম নবাব সিরাজউদ্দৌলার বর্বরতা ও কূটবুদ্ধির বাহার। বারবার এটা দেখানো হয়, ‘শয়তান’ নবাব কীভাবে অসহায় কৃষ্ণচন্দ্রকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করেন। এ ধরনের ইতিহাস গিলিয়ে মুসলিম শাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলে ধরা হয়। অথচ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে যেভাবে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, সেই নবাবের সঙ্গেই অতি মহানুভব রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন।
২০২৪ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি প্রার্থী অমৃতা রায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে এক ফোনালাপে বলেন, ইংরেজ তথা রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্র হাত না মেলালে ধ্বংস হয়ে যেত হিন্দু ধর্ম। মানে বিশ্বাসঘাতকতাকে বৈধতা দিলেন তিনি! (এবিপি আনন্দ, ২৭ মার্চ ২০২৪)
ভারত সরকার এমন ভাষ্য তৈরি করেছে– মুসলিম শাসকরা তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ধ্বংস করে দিয়েছেন। হিন্দি সিনেমা ‘পানিপথ’-এ (অর্জুন কাপুর অভিনীত) আহমদ শাহ আবদালিকে নৃশংসরূপে দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে হিন্দু শাসক সদাশিব রাও ভাউকে একজন অসহায় নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যিনি আসলে মুসলিমদের শয়তানির কাছে হেরে গেলেন! অথচ এই সদাশিব তথা মারাঠা বা বর্গীদের নৃশংসতার কথা আমরা সবাই জানি। মোগল শাসনের ওপর ভারতীয়দের এত রাগ, এত ক্ষোভ যে, বাবরি মসজিদ ভেঙে নান্দনিক তাজমহলের দিকেও এখন তাদের
চোখ পড়েছে।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদনে গবেষক অড্রি ট্রুসক বলেছেন, বর্তমান ভারতে মুসলিমদের প্রতি হিন্দুদের যে বিদ্বেষ বা নেতিবাচক ধারণা, তার বেশির ভাগই উপমহাদেশের সত্যিকারের ইতিহাসের পরিবর্তে শুধু ‘অনুমানভিত্তিক’ বয়ানের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। ষোলো থেকে আঠারো শতক পর্যন্ত ভারতে মুসলিম শাসনকাল ছিল প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব নয়, বরং অসাধারণ আন্তঃসাংস্কৃতিক শ্রদ্ধা ও সাংস্কৃতিক উর্বরতার সময়।
এই গবেষক তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, মোগল শাসনামলে হিন্দু বা অন্য ধর্মানুসারীরা শুধু নিজেদের ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করতেন, তা নয়; মোগল সম্রাটদের দরবারেও ছিল তাদের নিয়মিত যাতায়াত। মোগলদের রাজদরবারে সংস্কৃত, জৈন ইত্যাদি সম্প্রদায় ও পণ্ডিতরা আসতেন।
তারা ধর্মীয় ও দার্শনিক বিতর্কেও
অংশ নিতেন।
অড্রি ট্রুসক তাঁর গবেষণায় এসব তথ্য তুলে ধরার আগে পাকিস্তান ও ভারতে প্রায় দুই বছর কাটিয়েছেন। বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি পড়া ও সেগুলোর অর্থ উদ্ধারের জন্য তিনি দুই ডজনেরও বেশি আর্কাইভে গিয়েছেন। তিনি মুসলিম কিংবা হিন্দু নন। তাঁর গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত যে কারও একপক্ষীয় বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।
বিশ্বের বহু অঞ্চলে মুসলিম বা ইসলামবিদ্বেষ চরম আকার ধারণ করেছে। ভারতেও ক্ষমতাসীনরা ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য মুছে দিতে চায়। সিনেমা, অ্যানিমেশন, বিজ্ঞাপন ইত্যাদিতে মুসলিমবিদ্বেষ প্রচারণায় তারা অর্থলগ্নিও করছে। সম্প্রতি মুসলিমদের সম্পত্তি কবজা করতে বিতর্কিত ওয়াক্ফ আইন সংশোধন বিলেও অনুমোদন দিয়েছে তারা।
আশিকুল মাওলা আদর: সাংবাদিক
ashiqulmawlaadar@gmail.com