ছবির উৎস, CHHAAVA
ছবির ক্যাপশান,
'ছাভা' সিনেমায় আওরঙ্গজেবের ভূমিকায় অক্ষয় খান্না
Author,
শুভজ্যোতি ঘোষ
Role,
বিবিসি নিউজ বাংলা, দিল্লি
এক ঘন্টা আগে
মুহি আল-দীন মুহাম্মদ মুঘল বাদশাহদের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘজীবী ছিলেন। ১৭০৭ সালে মহারাষ্ট্রের আহিল্যা নগরে একটি ছোট তাঁবুর ভেতরে যখন তার মৃত্যু হয় তখন তার বয়স ৮৮ পেরিয়ে গেছে।
তার বাপ-দাদা-প্রপিতামহরা শুধু যে কেউ অতদিন বাঁচেননি বা অত লম্বা সময় ধরে মসনদে বসেননি তাই নয়, ঘটনা হলো তার মৃত্যুর পরেই পুরো মুঘল সাম্রাজ্যই কার্যত ছারখার হতে বসে। মুঘলদের এই শেষ শক্তিশালী বাদশাহকে আমরা অবশ্য 'আওরঙ্গজেব' নামেই বেশি চিনি।
আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর দীর্ঘ আড়াইশো বছর পর আজকের স্বাধীন ভারতের জন্ম, অথচ আজও এই দেশের রাজনীতি ও সমাজজীবনে আওরঙ্গজেবের মতো বিতর্কিত ঐতিহাসিক চরিত্র যে একটিও নেই, তা বলা যায় হলফ করেই।
ভারতে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু'টি রাজ্য, উত্তরপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রে আওরঙ্গজেব যেমন আজও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে।
এই দুটো রাজ্যেই আগাগোড়া তিনি একজন 'ডিপলি ডিভাইসিভ' বা গভীর বিভাজনমূলক চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এসেছেন, কার্যত হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের প্রতীক হিসেবেই তাকে তুলে ধরা হয়েছে।
হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলোর চোখে তিনি শত শত মন্দির ধ্বংসকারী, নিষ্ঠুর নির্যাতনকারী ও হিন্দুবিদ্বেষী একজন শাসক – অন্য দিকে ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মভীরু মুসলিম হিসেবে তার জীবনযাপন, শরিয়া আইনের প্রতি আনুগত্য বা তার প্রশাসনিক দক্ষতার দৃষ্টান্ত দিয়ে তাকে দেশের অন্যতম সফল ইসলামী শাসক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টাও হয়েছে অন্য তরফে।
ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
দোলায় চেপে যাচ্ছেন বাদশাহ আওরঙ্গজেব, মুঘল মিনিয়েচার চিত্র
আওরঙ্গজেবকে ঘিরে বিতর্ক এতটাই যে, আজও দাক্ষিণাত্যের খুলদাবাদে তার সমাধিস্থলে যদি কোনো রাজনীতিবিদ যান তাহলে নিমেষে সেটা চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে। ওই সাইটটির রক্ষণাবেক্ষণ করে ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, তা সত্ত্বেও সেটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার দাবি ওঠে হামেশাই।
এমনকি রাজধানী দিল্লির প্রাণকেন্দ্রে আওরঙ্গেজব রোড নামে যে অভিজাত রাস্তাটি ছিল, বিতর্কের মুখে সেই রাস্তাটির নামও পাল্টে ফেলা হয়েছে কয়েক বছর আগেই। সচেতনভাবে মুছে ফেলা হয়েছে ল্যুটিয়েন্স দিল্লিতে ব্রিটিশ জমানার সেই ইতিহাস।
উত্তরপ্রদেশের দাপুটে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এই মাত্র দিনকয়েক আগেই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ভারতের মুসলিমরা যদি 'সভ্যভব্য' হন তাহলে তারা কখনওই সন্তানের নাম আওরঙ্গজেব রাখবেন না।
মহারাষ্ট্রে এখনও কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলেই অবধারিতভাবে আওরঙ্গজেবের নাম টেনে আনেন রাজনীতিকরা।
'আওরঙ্গজেবের আওলাদ' বা সন্তানরাই যে গন্ডগোলের মূলে, অতি সম্প্রতি এমন কথাও শোনা গেছে রাজ্যের বিজেপি নেতাদের মুখে।
বাদশাহ আওরঙ্গজেবকে নিয়ে বিতর্কের এই ধিকিধিকি আগুনে সদ্য ঘৃতাহুতি দিয়েছে একটি বলিউড মুভি, যার নাম 'ছাভা'।
'ছাভা' একটি মারাঠি শব্দ, যার অর্থ হল সিংহ শাবক। মারাঠা জাতীয়তাবাদের নায়ক ছত্রপতি মহারাজ শিবাজীর পুত্র সম্ভাজী মহারাজকে বন্দি করার পর আওরঙ্গজেব কীভাবে অবর্ণনীয় অত্যাচার করে তাকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন, সিনেমাটির মূল কাহিনি সেটা নিয়েই।
ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদে আওরঙ্গজেবের সমাধিস্থল
সুপারহিট এই ছবিটি মুক্তির পর মাসখানেকও হয়নি, এর মধ্যেই সেটি প্রায় হাজার কোটি রুপির বাণিজ্য করার পথে এগোচ্ছে – আর সেই সঙ্গেই আরও একবার আওরঙ্গজেবকে নিয়ে এসেছে ভারতের রাজনীতির ফোকাল পয়েন্টে!
'ছাভা'তে নামভূমিকায়, অর্থাৎ মহারাজা সম্ভাজীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন বলিউড তারকা ভিকি কৌশল। কিন্তু সম্ভবত তার চেয়েও বেশি আলোচনা হচ্ছে ছবিতে আওরঙ্গজেবের ভূমিকায় অভিনয় করা অক্ষয় খান্নাকে নিয়ে।
এই সিনেমাটি রিভিউ করতে গিয়ে অনেক চিত্র সমালোচক লিখেছেন, ছবিতে সম্ভাজীকে নির্যাতনের দৃশ্যগুলো এতটাই ভয়াবহ ও জীবন্ত ছিল যে হলের ভেতরে বহু বাচ্চা ছেলেমেয়ে ভয়ে কেঁদেই ফেলেছে।
সোশ্যাল মিডিয়াতেও বহু দর্শক তাদের একই অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। 'ছাভা'র একটার পর একটা শো-তে দেখা গেছে সেই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি।
'ইন্ডিয়া টুডে'-তে আরুশি জৈন লিখেছেন, "একজন নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী ও একই সঙ্গে দক্ষ শাসকের ভূমিকায় আওরঙ্গজেবের এমন শিরদাঁড়ায় ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেওয়া, অথচ সংযত চিত্রায়ন আমরা আগে দেখিনি।"
ইতিহাস বলে, আওরঙ্গজেব না কি বন্দি সম্ভাজীর ওপর মৃত্যুর আগে টানা ৪০ দিন ধরে অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছিলেন। সিনেমার প্রয়োজনে সেটাকে ছোট করে তিনদিনে নামিয়ে আনা হয়েছে, কিন্তু তাতে পর্দার আওরঙ্গজেবের নৃশংসতা এতটুকু কমেনি।
ছবির উৎস, CHHAAVA
ছবির ক্যাপশান,
ছাভা সিনেমায় মহারাজ সম্ভাজির ভূমিকায় ভিকি কৌশল
এর আগেও ১৯৮৮ সালে পরিচালক শ্যাম বেনেগাল যখন জওহরলাল নেহেরুর আত্মজীবনীর ভিত্তিতে দূরদর্শনের জন্য 'ভারত এক খোঁজ' নামে টিভি সিরিয়াল বানিয়েছিলেন, সেখানে আওরঙ্গজেবের ভূমিকায় ছিলেন সুপরিচিত অভিনেতা ওম পুরী।
'ছাভা' সিনেমায় একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আছেন বলিউড তারকা আশুতোষ রানা, তিনি নিজেও বছর চারেক আগে 'ছত্রশাল' নামে একটি জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজে আওরঙ্গজেবের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
তবে ভারতের সিনেমা সমালোচকরা প্রায় একবাক্যে বলছেন, ছাভা-তে অক্ষয় খান্নার আওরঙ্গজেবের সঙ্গে একই চরিত্রে তার পূর্বসূরীদের কাজের কোনো তুলনাই চলতে পারে না।
আরুশি জৈনের কথায়, "আওরঙ্গজেব মানে যে বলিউডের একপেশে ও একমাত্রিক একজন ভিলেন শুধু নন, অক্ষয় খান্না সেটা নিশ্চিত করতে পেরেছেন।"
"মুঘল বাদশাহর সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত নৃশংসতা, তাও সেটা আবার খুব পরিমিত তীব্রতার সঙ্গে, তার অভিনয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে আমি তো বলব সিনেমায় তার স্তব্ধতাই ছিল বিস্ফোরক!"
ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
ছাভা ছবির অ্যালবাম লঞ্চে রাশমিকা মানদানা, সুরকার এ আর রহমান ও ভিকি কৌশল
কোনো সংলাপ ছাড়া, শুধু নীরব অভিনয় আর চোখের চাহনিতে যেভাবে 'ছাভা'র আওরঙ্গজেব দর্শকের মনে ভয় আর ঘৃণার উদ্রেক করতে পেরেছেন, সেটা নিয়ে লেখালেখিও হচ্ছে বিস্তর।
ফলে 'ছাভা' কেন আর কীভাবে আবার আওরঙ্গজেবকে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে, তা অনুমান করা শক্ত নয় মোটেই।
প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে মুঘল সাম্রাজ্যের অবিসংবাদিত সম্রাট ছিলেন আওরঙ্গজেব, এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক, বা শেষ ২৫ বছরই তিনি কাটিয়েছেন দাক্ষিণাত্য বা ডেকানের বিভিন্ন জায়গায়। যার প্রায় পুরো এলাকাটাই আজকের মহারাষ্ট্র রাজ্যের মধ্যে পড়ছে।
মারাঠি নায়ক ছত্রপতি মহারাজ শিবাজির সঙ্গে তার সংঘাত, সন্ধির চেষ্টা ও প্রায় আমৃত্যু লড়াইও মারাঠা তথা ভারতের ইতিহাসে একটি অতি চর্চিত বিষয়, যার প্রতিফলন দেখা যায় এযুগের মারাঠা রাজনীতিতেও।
উনিশ শতকের বিখ্যাত মারাঠা সমাজ সংস্কারক জ্যোতিবা ফুলে মহারাজ শিবাজির প্রশস্তিমূলক যে কাব্যগাথা লিখেছিলেন, তাতেও আওরঙ্গজেবের কঠোর সমালোচনা ছিল। ওই ব্যালার্ড বা কাব্য আজও মহারাষ্ট্রের স্কুলপাঠ্য বইতে পড়ানো হয়।
হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অন্যতম পথিকৃৎ ও মারাঠা আইকন বিনায়ক দাস সাভারকরও তার একটি বিখ্যাত বইতে লেখেন, "আওরঙ্গেজেব ছিলেন মানুষের আকারে এক সাক্ষাৎ রাক্ষস, যিনি শপথ নিয়েছিলেন সমগ্র হিন্দু বিশ্বকে উৎপাটন করে ছাড়বেন।"
ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
আওরঙ্গজেবের বিয়ের আগে তাকে উপহার দিচ্ছেন পিতা শাহজাহান
ফলে মহারাষ্ট্রে আওরঙ্গজেব বরাবরই একটি চরম নিন্দিত চরিত্র, মারাঠা রাজনীতির কারবারিরা যার সুযোগ নিয়েছেন পুরো মাত্রায়।
আওরঙ্গজেবের নামে নামকরণ মহারাষ্ট্রের যে আওরঙ্গাবাদ শহরের, সেটির নাম বদলে শিবাজির পুত্রের নামে 'সম্ভাজীনগর' রাখার দাবিও মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে খুব পুরনো একটি আলোচনার বিষয়।
হিন্দুত্ববাদী দল তথা উগ্র মারাঠা জাতীয়তার প্রবক্তা শিবসেনা প্রথমবারের মতো আওরঙ্গাবাদ শহরের পৌরসভা দখল করেছিল আশির দশকের শেষ দিকে।
তখন শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা বালাসাহেব ঠাকরে দলের ম্যাগাজিন 'মার্মিকে' লিখেছিলেন, "আজ তিনশো বছর ধরে আওরঙ্গজেবের ভূত ভারতকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু 'মর্দ মারাঠা'রা সেই আওরঙ্গাবাদের মাটিতেই তাকে অবশেষে দাফন করে ছাড়ল।"
আওরঙ্গাবাদ থেকে ২৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে খুলদাবাদে আজও দাঁড়িয়ে আছে আওরঙ্গজেবের সমাধিস্থল।
মুসলিম সম্প্রদায়ের দল হিসেবে পরিচিত এআইএমআইএমের নেতা আকবরউদ্দিন ওয়াইসি যখন খুলদাবাদের সেই সৌধ পরিদর্শনে যান, তা গুঁড়িয়ে দেওয়ার দাবি তোলেন বিজেপি নেতারা। শিবাজি মহারাজের বংশধর ও সাতারা-র এমপি উদয়নরাজ ভোঁসলেও তাতে গলা মেলান।
ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
আওরঙ্গজেবের প্রশস্তি করে বিপাকে পড়েছেন আবু আজমি
এদিকে 'ছাভা' সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার দিনকয়েক পরেই মহারাষ্ট্রের সমাজবাদী পার্টি প্রধান তথা এমএলএ আবু আসিম আজমি অভিযোগ করেন, ওই সিনেমায় ইতিহাস বিকৃত করে 'ভুল তথ্য' পরিবেশন করা হচ্ছে।
তিনি আরও দাবি করেন, আওরঙ্গজেবকে শুধু মন্দির ধ্বংসকারী হিসেবে দেখলেই হবে না – তিনি বহু হিন্দু মন্দির বানানোর জন্য টাকাকড়িও দিয়েছিলেন।
"এমনকি আমি জানি তিনি শাসক হিসেবেও খুবই দক্ষ ও জনপ্রিয় ছিলেন, মোটেই নিষ্ঠুর ছিলেন না", বলেন আবু আজমি।
এরপরই আবু আজমির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠতে থাকে, মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফাডনবিশ তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেন। রাজ্য বিধানসভা থেকেও তাকে বাজেট অধিবেশনের জন্য বহিষ্কার করা হয়।
'আওরঙ্গজেবের প্রশস্তি ও শিবাজী মহারাজের অপমান' একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে কি না, মহারাষ্ট্রের নেতা-মন্ত্রীরা এখন সে প্রস্তাব নিয়েও আলোচনা করছেন।
অযোধ্যার পরে ভারতে যে দুটি সবচেয়ে বিতর্কিত ধর্মীয় উপাসনালয় রয়েছে, তার দুটির সঙ্গেই আওরঙ্গজেবের নাম জড়িয়ে আছে। আর এই দুটি মন্দির-মসজিদ কাঠামোই উত্তরপ্রদেশে অবস্থিত।
ইতিহাসবিদরা মোটামুটি একমত, ১৬৬৯ সালে বারাণসী বা বেনারসে সুপরিচিত কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ভেঙে সেই জায়গায় জ্ঞানবাপী মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন আওরঙ্গজেব।
ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
বারাণসীর গঙ্গা থেকে জ্ঞানবাপী মসজিদের মিনার, ব্রিটিশ চিত্রশিল্পীর তুলিতে
ঠিক এর পরের বছরই (১৬৭০) মথুরায় হিন্দুদের কেশবদেব মন্দির ভেঙে শাহী ঈদগাহ মসজিদ নির্মাণ করারও নির্দেশ দেন তিনি।
আজ বেনারস ও মথুরা, দুটি জায়গাতেই এই মসজিদ ও মন্দির পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে – কিন্তু সেখানে মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়ে পুরো জায়গাটিই হিন্দুদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন হয়ে থাকে হামেশাই।
অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে এ কারণেই স্লোগান উঠেছিল, "বাবরি তো সির্ফ ঝাঁকি হ্যায়, কাশী-মথুরা বাকি হ্যায়!" যদিও ভারতের ধর্মীয় উপাসনালয় আইন অনুযায়ী এই সব ধর্মস্থানের চরিত্র পাল্টানোর সুযোগ নেই।
এই পটভূমিতে 'ছাভা' মুক্তি পাওয়ার পর আওরঙ্গজেবকে নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হতেই আসরে নেমে পড়েছেন উত্তরপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ।
তিনি একটি জাতীয় স্তরের টিভি চ্যানেলে ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করে জানিয়েছেন, "কাশী-মথুরার ধর্মস্থানে মন্দির তৈরি করা আমার সরকারের অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে না, তবে জনগণের আস্থাকে মর্যাদা দেওয়াটা অবশ্যই আমাদের একটা গুরুদায়িত্ব।"
সেই সঙ্গেই আওরঙ্গজেবকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করে আদিত্যনাথ বলেন, "যে হিন্দু-বিদ্বেষী সম্রাট এত মন্দির মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন, হিন্দু বা কাফিরদের ওপর নিরাপত্তা দেওয়ার নামে জিজিয়া কর চাপিয়েছেন – স্বাধীন ভারতবর্ষে কেউ তার প্রশস্তি করতে পারে ভাবাই যায় না!"
ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
যোগী আদিত্যনাথ (ফাইল ছবি)
কাশী ও মথুরায় আওরঙ্গজেবের 'পাপে'র প্রায়শ্চিত্ত করে হিন্দুদের মন্দির স্থাপন যে রাজ্যের গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের প্রাণের দাবি, সেটাও বলতে কোনো রাখঢাক করেননি তিনি।
ভারতের কোনো 'সভ্য মুসলিম' আওরঙ্গজেবের নামে সন্তানের নামকরণ করার কথা ভাবতে পারবে না বলেও দাবি করেন তিনি।
অন্য দিকে উত্তরপ্রদেশের পাশের রাজ্য বিহারে শাসক দল জেডি(ইউ)-র নেতা খালিদ আনোয়ারও আওরঙ্গজেবকে 'দক্ষ শাসক' বলে দাবি করে বিতর্ক উসকে দিয়েছেন।
এদিকে মারাঠা রাজা সম্ভাজীকেই শুধু নয়, শিখদের নবম গুরু তেগ বাহাদুরকেও হত্যা করেছিলেন আওরঙ্গজেব – যে কারণে শিখ সম্প্রদায়ের কাছেও তিনি ঘৃণিত একটি চরিত্র।
পুরনো দিল্লির চাঁদনি চক এলাকায় শিশগঞ্জ সাহিব গুরদোয়ারাতে গুরু তেগ বাহাদুরের শিরশ্ছেদ করা হয়েছিল আওরঙ্গজেবের নির্দেশে – কারণ তিনি বাদশাহর আধিপত্য মেনে নিতে ও ইসলাম গ্রহণ করতে রাজি হননি।
ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
বাদশাহ আওরঙ্গজেবের একটি প্রাচীন স্কেচ
এখন আওরঙ্গজেবকে নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হতেই বিভিন্ন রাজ্যে এই সব প্রাচীন ইতিহাস খুঁড়ে বের করে তা নিয়ে রাজনীতি চলছে পুরো দমে।
বছর তিনেক আগে যখন বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদে 'সার্ভে' চালাতে আদালতের নির্দেশকে ঘিরে ভারতে রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়, দেশের সোশ্যাল মিডিয়াতে তখনও আওরঙ্গজেব প্রবলভাবে আলোচনায় এসেছিলেন।
সে সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (যিনি আবার বারাণসীর এমপি-ও) তার সংসদীয় কেন্দ্রে একটি ইভেন্টে আওরঙ্গজেবের চালানো 'সন্ত্রাসে'র কঠোর নিন্দা করে বলেছিলেন, "তরবারি দিয়ে তিনি একটি সভ্যতাকে পাল্টে দিতে চেয়েছিলেন। মৌলবাদ দিয়ে একটি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন।।"
এর কিছুদিন পরেই গুরু তেগ বাহাদুরের ৪০০তম জন্মজয়ন্তীতে মি. মোদী আবার বলেন, "আওরঙ্গজেব হয়তো অনেক মাথাই কেটেছেন, কিন্তু তিনি নিজ ধর্মে আমাদের আস্থায় ফাটল ধরাতে পারেননি।"
সে সময় মার্কিন-কানাডিয়ান ইতিহাসবিদ ও লেখক অড্রি ট্রাশ্ক টুইটারে বিস্ময় প্রকাশ করে লিখেছিলেন, "যে মুঘল বাদশাহ ৩০০ বছরেরও বেশি আগে প্রয়াত, তাকে আক্রমণ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এত লম্বা ভাষণ দিচ্ছেন!"
তার যুক্তি ছিল, আওরঙ্গজেবের নামটা আসলে এখানে একটা 'ডগ হুইশলে'র মতো ব্যবহার করা হচ্ছে এই বার্তাটা দিতে - যে এ যুগের মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো বা সহিংসতা গ্রহণযোগ্য।
ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
দিল্লির আওরঙ্গজেব রোডের নাম পাল্টে যখন রাখা হয় এপিজে আবদুল কালামের নামে
অড্রি ট্রাশ্ক আরও বলেছিলেন, "ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা মনে করেন শত শত বছর ধরে সে দেশে মুসলিমরা হিন্দুদের ওপর নির্যাতন করেছেন, তাই ইতিহাসের প্রতিশোধ হিসেবে এখনকার মুসলিমরা অত্যাচারিত হলে কোনো সমস্যা নেই।"
আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির মধ্যযুগীয় ইতিহাসের প্রবীণ অধ্যাপক নাদিম রেজাভিও এই যুক্তির সঙ্গে অনেকটাই একমত।
ড. রেজাভি বিবিসিকে বলেন, "ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের ভিলেন হিসেবে চিত্রিত করতে আওরঙ্গজেবের নামটা টেনে আনা খুব সুবিধাজনক, আর আমাদের এযুগের শাসকরা ঠিক সেটাই করছেন।"
"অথচ বিভিন্ন হিন্দু মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণে তার মতো অর্থ আর কেউ দেননি, রক্তের দিক দিয়েও তিনি ছিলেন দুই-তৃতীয়াংশ হিন্দু কারণ তার প্রপিতামহ আকবর বিয়ে করেছিলেন রাজপুত রমণী যোধাবাঈকে। আওরঙ্গজেবের সভায় যত হিন্দু রাজপুত সভাসদ ছিলেন তত আর কোনো মুঘল বাদশাহর আমলে ছিল না", আরও জানাচ্ছেন অধ্যাপক রেজাভি।
ইতিহাসবিদরা অনেকেই মনে করেন, ব্যক্তিগত জীবনে ও ধর্মাচরণে আওরঙ্গজেব মোটেই 'মৌলবাদী' ছিলেন না। তিনি সুরাপ্রেমী ছিলেন, হিন্দু দেবদেবীদের বাদ্যযন্ত্র বলে পরিচিত 'বীণা'ও খুব ভালো বাজাতেন।
ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব
"কিন্তু এটাও ঠিক নিজের রাজনৈতিক ব্যর্থতাকে ঢাকতে ও সাম্রাজ্যের রাশ শক্ত হাতে ধরতে তিনি ধর্মকে ব্যবহার করেছিলেন, ঠিক যেমন আমাদের আজকের নেতারাও করে থাকেন", বলছিলেন নাদিম রেজাভি।
ভারতের বর্ষীয়ান ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিবও গত সপ্তাহে বিবিসি হিন্দিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে আওরঙ্গজেবের শাসনকালকে 'সেকুলার' বলেই দাবি করেছেন।
৯৪ বছর বয়সী এই বরেণ্য ঐতিহাসিক সেখানে বলেন, "ওই জমানাটা অন্য রকমের ছিল। তবে এটাও ঠিক, শিবাজি কিন্তু তার লেখা এক বিখ্যাত চিঠিতে আওরঙ্গজেবকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তিনিও যেন আকবরের (ধর্মনিরপেক্ষতার) নীতিকেই অনুসরণ করেন।"
"হ্যাঁ, ধর্মের একটা নিজস্ব জায়গা তখনও ছিল। কিন্তু তবু আমি বলব (আওরঙ্গজবের) ওই শাসনকে আজকের ভাষায় সেকুলারই বলা চলে!"
তবে বহু বছর ধরে ভারতে বসবাসকারী ফরাসি সাংবাদিক, গবেষক ও লেখক ফ্রাঁসোয়া গঁতিয়ে আবার সরাসরি অভিযোগ করছেন, এই ইরফান হাবিব বা রোমিলা থাপারের মতো বামপন্থী ঐতিহাসিকরাই সত্যের অপলাপ করে আওরঙ্গজেবের মতো শাসকের 'কুকীর্তি'কে দশকের পর দশক ধরে আড়াল করে গেছেন এবং তাকে শিল্পদরদী, উদার, ধর্মভীরু বলে তুলে ধরতে চেয়েছেন!
ছবির উৎস, F Gautier
ছবির ক্যাপশান,
ইন্দো-ফ্রেঞ্চ গবেষক ও লেখক ফ্রাঁসোয়া গঁতিয়ে
বিবিসি বাংলাকে মি গঁতিয়ে বলেন, "সত্যিকারের ইতিহাস জানলে আজ হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি নষ্ট হবে, এর চেয়ে বাজে কথা আর কিছু হতে পারে না। বরং আমি বলব, নিজের দেশের অতীতের ভালো ও মন্দ, চরম খারাপ ও চরম শুদ্ধ কোনটা সেটা না জানলে একটা জাতি এগোতেই পারে না!"
নিজের দেশ ফ্রান্সের উদাহরণ দিয়ে তিনি আরও জানাচ্ছেন, উত্তর আফ্রিকায় ফরাসি উপনিবেশ স্থাপনের সময় কী ধরনের বর্বরতা করা হয়েছিল – বা নাতসি আমলে ফরাসি ইহুদীদের কীভাবে তাদের হাতে তুলে দিয়ে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল – ফ্রান্স আজ তা নিয়ে খোলাখুলি কথাবার্তা বলতে পারে এবং সেই 'লজ্জার ইতিহাস' থেকে শিক্ষা নেওয়ারও চেষ্টা করে।
"আওরঙ্গজেবের চেয়ে হিন্দুবিদ্বেষী শাসক ভারতে আর কখনও কোনো কালে আসেননি। আজকের ভারতীয় মুসলিমদের ৯০ শতাংশের পূর্বপুরুষকে তার আমলেই জোর করে ধর্মান্তরিত করে হিন্দু থেকে মুসলিম বানানো হয়েছিল, এটাও তাদের কখনও জানতেই দেওয়া হয়নি!"
"পশ্চিমী বিশ্বে যেমন হিটলার, তেমনি ভারতের হলেন আওরঙ্গজেব। সমগ্র পশ্চিমী বিশ্বে আপনি হিটলারের নামে কোথাও কোনো রাস্তা পাবেন না, অথচ ভারতের রাজধানীতে এই সে দিনও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা ছিল আওরঙ্গজেবের নামে, ভাবা যায়?" বিবিসিকে বলছিলেন ফ্রাঁসোয়া গঁতিয়ে।
ফলে 'ছাভা' বক্স অফিসে ঝড় তোলার পর আওরঙ্গজেবকে নিয়ে ভারতে নতুন করে যে তর্কবিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে তিনি তার মধ্যে কোনও অসুবিধা দেখেন না – বরং মি গঁতিয়ের মতে এটা একটা অত্যন্ত ইতিবাচক ও স্বাস্থ্যকর বিতর্ক!