ভূমিকা
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আইনসভা গঠনের জন্য আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (Proportional Representation-PR) এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার (Majoritarian Government) — এই দুটি প্রধান পদ্ধতি প্রচলিত। আনুপাতিক পদ্ধতিতে দলগুলি তাদের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সংসদে প্রতিনিধিত্ব পায়, অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ পদ্ধতিতে একটি দল বা জোট এককভাবে সরকার গঠন করে। উভয় পদ্ধতিরই সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে। তবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দুটি দলের মধ্যে পুনরায় ভোট (Runoff Election)-এর মাধ্যমে সরকার গঠনের একটি বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে এ নিবন্ধে আলোচনা করা হবে।
সুবিধা:
১. ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব: ছোট দলগুলোরও সংসদে আসন পাওয়ার সুযোগ থাকে, ফলে সমাজের বিভিন্ন মতাদর্শ ও গোষ্ঠী প্রতিনিধিত্ব পায়।
২. গণতান্ত্রিক সমতা: ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন হলে ভোটারদের রায় সরাসরি সংসদে প্রতিফলিত হয়।
৩. বৈচিত্র্য বৃদ্ধি: সংখ্যালঘু, নারী ও প্রান্তিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়।
৪. একদলীয় আধিপত্য হ্রাস: কোনো দল পূর্ণ ক্ষমতা পায় না বলে স্বৈরাচারী প্রবণতা কমে।
অসুবিধা:
১. অস্থিতিশীল সরকার: বহুদলীয় কোয়ালিশন সরকার দুর্বল ও ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকে।
২. সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব: বিভিন্ন দলের সমন্বয় প্রয়োজন হলে নীতি বাস্তবায়ন ধীরগতির হয়।
৩. ক্ষুদ্র দলগুলোর অযৌক্তিক প্রভাব: কোয়ালিশনে ছোট দলগুলি বড় দলকে নিজেদের স্বার্থে চাপ দিতে পারে।
সুবিধা:
১. স্থিতিশীল সরকার: একক দলীয় সরকার দ্রুত ও দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
২. স্পষ্ট জবাবদিহিতা: সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার দায় সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের ওপর বর্তায়।
৩. দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা: বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন সহজ হয়, কারণ বিরোধী বাধা কম থাকে।
অসুবিধা:
১. ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন: নেতৃত্বের হাতে অত্যধিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে পারে।
২. সংখ্যালঘুদের উপেক্ষা: ছোট দল বা সম্প্রদায়ের স্বার্থ বিবেচনায় নাও আসতে পারে।
৩. অগণতান্ত্রিক প্রবণতা: নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে সরকার গণমাধ্যম ও বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করতে পারে।
সমাধান: সংখ্যাগরিষ্ঠ দুটি দলের মধ্যে পুনরায় ভোট (Runoff Election)
প্রস্তাবিত মডেল:
- প্রথম দফার নির্বাচনে যদি কোনো দল ৫০%+১ আসন বা ভোট না পায়, তবে শীর্ষ দুটি দলের মধ্যে দ্বিতীয় দফার ভোট অনুষ্ঠিত হবে।
- দ্বিতীয় দফায় যে দল অধিকাংশ ভোট পাবে, তারা সরকার গঠন করবে।
এই পদ্ধতির সুবিধা:
১. স্থিতিশীল সরকার: একটি দল স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে, ফলে কোয়ালিশনের অস্থিরতা কমবে।
২. জনমতের সঠিক প্রতিফলন: দ্বিতীয় দফায় ভোটাররা সরাসরি তাদের পছন্দের দলকে সমর্থন করতে পারবে।
৩. ক্ষমতার ভারসাম্য: সংখ্যালঘু দলগুলোর প্রভাব কমলেও, শীর্ষ দুটি দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা ন্যায্যতা বজায় রাখে।
৪. স্বচ্ছতা বৃদ্ধি: ভোটাররা আরও সচেতনভাবে তাদের পছন্দ প্রকাশ করতে পারবে।
সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ:
১. নির্বাচন ব্যয় বৃদ্ধি: দ্বিতীয় দফার ভোটে অতিরিক্ত অর্থ ও সময় ব্যয় হতে পারে।
২. রাজনৈতিক বিভাজন: দুই দলের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে।
৩. ছোট দলগুলোর বাদ পড়া: আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের তুলনায় তৃতীয় বা চতুর্থ দলগুলি প্রান্তিক হতে পারে।
উপসংহার:
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ও সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার—উভয় পদ্ধতিরই সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দুটি দলের মধ্যে পুনরায় ভোট-এর প্রস্তাবটি একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান হতে পারে, যা স্থিতিশীল সরকার গঠনের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক ন্যায্যতা নিশ্চিত করে। তবে, এই পদ্ধতি বাস্তবায়নের আগে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও প্রশাসনিক প্রস্তুতি বিবেচনা করা প্রয়োজন। ভারসাম্যপূর্ণ শাসনব্যবস্থার জন্য আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সাথে রানঅফ নির্বাচনের সমন্বয়ও একটি কার্যকর বিকল্প হতে পারে।
৩০ জুন ২০২৫, লন্ডন
লেখক : রাষ্ট্রচিন্তক।
এইচআর/এমএস