দম ফেলার ফুরসত নেই। একের পর এক সংবর্ধনার সঙ্গে বাফুফে ভবনে এসেও সাফজয়ী মেয়েদের অভিনন্দন জানাচ্ছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। সবার ভালোবাসা এবং অভিনন্দনে সিক্ত সাবিনা খাতুনরাই এখন দেশের ফুটবলের আলোর দিশারি। হিমালয়ের দেশে বাংলাদেশের বিজয়ের কেতন ওড়াতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাবিনা। মাঠের বাইরেও তিনি সত্যিকার নেতা। নারী সাফে নেপালকে হারিয়ে ইতিহাস গড়ার গল্পের সঙ্গে মেয়েদের ফুটবল নিয়ে সমকালের সঙ্গে কথা বলেছেন সাবিনা। তা তুলে ধরেছেন সাখাওয়াত হোসেন জয়

সমকাল :সাফ জেতার পর দেশের মেয়েদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে একটা জাগরণ। এটা শুধু ক্রীড়াঙ্গন নয়, সমাজের সব ক্ষেত্রে। এটা ভেবে আপনার কেমন লাগছে?

সাবিনা :দেশের মানুষ যেভাবে উচ্ছ্বসিত; দেখে মনে হচ্ছে, তাঁরা দীর্ঘদিন পরে একটু প্রাণ খুলে হাসতে পারছেন। এটা তো অবশ্যই আমাদের জন্য ভালো দিক। দেশের মানুষ যেভাবে উপভোগ করছে এবং আমাদের নিয়ে উল্লাস করছে, তা দেখে আমরাও অনেক খুশি। এই জিনিসটা যেন ধরে রাখতে পারি, সেটাই মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে চাওয়া।

সমকাল :মেয়েরা ওই রকমভাবে খেলাধুলায় আসে না। বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে দেখা গেলে, বড় কোনো তারকা নেই। সাফ জয়ের পর এই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে বলে মনে করেন?

সাবিনা :যদি তারা (বিজ্ঞাপন সংস্থা) চায়। যেহেতু মেয়েরা সাফল্য এনে দিয়েছে, তাঁদের নিয়ে উচ্ছ্বাস চলছে, আছে এবং সবারই মেয়েদের নিয়ে প্রত্যাশাও বাড়ছে। আমি মনে করি, এটা একটা মোক্ষম সময়। আশা করি, এই মেয়েদের প্রতি বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলো আগ্রহ দেখাবে। কারণ, এখন তো তাঁদের পুরো বাংলাদেশ চেনে।
সমকাল :অনেক প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে এই জায়গায় এসেছেন। পেছন ফিরে তাকালে এমন কষ্টের কোনো স্মৃতি মনে পড়ে?

সাবিনা :আমার বাবা ছিলেন দিনমজুর। সাধারণত দিনমজুরের মেয়ের বেড়ে ওঠাটা অবশ্যই কষ্টকর ছিল। তবে আমার সবচেয়ে বড় জিনিস হলো, আমার বড় আপুর (সালমা খাতুন) অনেক সাপোর্ট ছিল। তিনি একটা ক্লিনিকের নার্স ছিলেন। তিনি আমার জন্য অনেক ফাইট করেছেন। ওই সময়টাতে তাঁর বেতন ছিল খুব স্বল্প। সবকিছুর মধ্যেও তিনি আমার প্রয়োজনগুলো পূরণ করতেন। আমার খেলাধুলার সরঞ্জাম, বাইরে এলে টাকাপয়সা- তিনি সব সময় এগুলো ম্যানেজ করতেন এবং বিশেষ করে আমার কোচ আকবর স্যার অনুপ্রেরণার জায়গা। যেটাই বলেন, সব মিলিয়ে তাঁদের অনেক সাপোর্ট ছিল।

সমকাল : চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর বোন কী বলেছেন?

সাবিনা :বোন তো অবশ্যই খুশি হয়েছেন। বিশেষ করে আমরা পাঁচ বোন। সবার মধ্যে সম্পর্কটা অনেক ভালো। সবাই অনেক খুশি, মাও খুশি। বাবা বেঁচে থাকলে তিনিও খুশি হতেন। গ্রামবাসী, বন্ধুবান্ধব সবাই খুশি। এর চেয়ে আর বড় কী হতে পারে।

সমকাল :এক দশক ধরে খেলছেন। একজন নারী ফুটবলারের ফিটনেস ধরে রাখা কতটা চ্যালেঞ্জিং?

সাবিনা :এটা অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং। কারণ, আমার সঙ্গে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা এখন কেউই খেলছেন না। আমার জন্য এটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এবং আমি ফুটবলটাকে অনেক এনজয় করতাম। আমি চাইতাম, ফুটবলটাকে নিজের ক্যারিয়ার হিসেবে নেওয়া। তো সেখান থেকেই আসলে ফুটবলই আমার ধ্যান-জ্ঞান।
সমকাল :সাফ জয়ের আগের আর পরের পার্থক্যটা কোথায়?

সাবিনা :সাফ জয়ের আগে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে খেলার পরে মেয়েদের নিয়ে ইতিবাচক ছিল সবাই। তবে সাফের পরে পরিস্থিতি পুরো বদলে গেছে। মানুষের কাছে এখন একটা নির্ভর জায়গা মেয়েদের ফুটবল। মানুষ এখন ফুটবলের প্রতি ভরসা বলতে নারী ফুটবলকেই বুঝছে।
সমকাল :আপনাদের সাফল্য দেখে একটা মেয়ে যদি ফুটবল খেলতে আসে, তাঁকে কী উপদেশ দেবেন?

সাবিনা :যুগ বদলে গেছে। ফুটবলকে এখন মেয়েরা পেশা হিসেবেই নিচ্ছেন। আমার মনে হয়, এর চেয়ে বড় কিছু আর হতে পারে না। যেমন আপনি তহুরা খাতুনের কথায়ই দেখেন, সে যদি বছরে ১০ লাখ টাকা আয় করে পরিবারকে দেয়, এর চেয়ে বড় সাপোর্ট তো আর হতে পারে না। সে ১৬-১৭ বয়সে এত টাকা আয় করছে, সেখানে তার নিজের ভবিষ্যৎ গড়ছে এখানে। আমার মনে হয়, বাবা-মাই চান মেয়েরা ফুটবল খেলুক।

সমকাল :পড়াশোনা আর খেলাধুলা একসঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছেন?

সাবিনা : আমি গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে পড়ছি। সত্যি কথা বলতে কি, আমার পড়াশোনার প্রতি অতটা আগ্রহ ছিল না। খেলাধুলার জন্য পড়াশোনার চার-পাঁচ বছর গ্যাপ চলে গেছে। তবে আমি মনে করি, একটা মেয়ে চাইলে খেলাধুলা এবং পড়াশোনা একসঙ্গে চালিয়ে যেতে পারেন। আমাদের মেয়েদের অনেকেই আছেন, যাঁরা কিনা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। এটা আসলে নির্ভর করছে তাঁর ওপর। তবে আমি মনে করি, একসঙ্গে দুটি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব।

সমকাল :সাবিনা মাঠে নামলেই গোল হয়ে যায়! ৮ গোল করে সাফে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন। অন্যান্য দেশের কোচ-খেলোয়াড়দের সঙ্গে দেখা হলে কী বলেন?

সাবিনা :এবারের সাফে আমি আলাদা মার্কিংয়ে ছিলাম। পাকিস্তানের কোচ তাঁদের ম্যাচের দিন বলেছিলেন, সাবিনাকে নিয়ে আমাদের আলাদা কৌশল ছিল; কিন্তু সেটা কাজে লাগেনি। আমি চেষ্টা করি। এজন্য আল্লাহ পাকের কাছে শুকরিয়া। ভারত, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা- এসব দেশের প্লেয়ারদের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক আছে।

সমকাল :আপনি বিদেশে লিগে খেলেছেন। সেখানকার মেয়েরা কী সুবিধা পান, আমরা কোথায় পিছিয়ে?

সাবিনা :মালদ্বীপের ক্ষেত্রে বলতে গেলে, সমান অবস্থায় আছি আমরা। তবে ভারত সবার চেয়ে এগিয়ে। এ দুটি দেশের লিগে খেলেছি বলে তাদের সম্পর্কে ধারণা আছে। অন্যদের সম্পর্কে ধারণা নেই। আমার মনে হয়, বাংলাদেশে মেয়েদের ফুটবল এখন বেটার হচ্ছে। বিশেষ করে ক্লাব লেভেলের পারিশ্রমিক ভালো। তবে আমরা পিছিয়ে আছি ম্যাচ খেলার দিক দিয়ে। এটা একটু বাড়ানো দরকার।

সমকাল :সাফ জিতেছেন, সেরা প্লেয়ার এবং সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন। সাবিনা তো এখন কিংবদন্তি।

সাবিনা :আমি আসলে নিজেকে ওইভাবে ভাবি না। নিজেকে তৈরি করার আরও অনেক কিছু বাকি আছে। দেশকে আরও ভালো কিছু দিতে চাই।

সমকাল :ফুটবলে মেয়েদের বদলে যাওয়ার কারণ কী?

সাবিনা :তিন বছর আগে বিরাটনগর সাফে আমরা সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। সেই সময় নেপাল ও ভারতের কাছে হেরেছিলাম। আপনি যদি সেই সময় আর বর্তমান সময় চিন্তা করেন, তাহলে দেখবেন অনেক বড় পার্থক্য। মেয়েরা একসঙ্গে ক্যাম্পে আছে, একসঙ্গে টুর্নামেন্ট খেলছে। ক্লাবেও যখন যাচ্ছে, একসঙ্গে যাচ্ছে। এটা আসলে একটা বন্ডিং হয়ে গেছে।
সমকাল :যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে। সবকিছুর পরও পারিবারিক পরিকল্পনা থাকে।

সাবিনা :এই বিষয়টি এখন ভাবছি না। কারণ, আমার বড় আরও দুই বোন আছেন, যাঁদের এখনও বিয়ে হয়নি (হাসি)।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews