বাংলাদেশ নামের এই সবুজ সোনার দেশটি যতবারই বিপদে পড়েছে, ততবারই এ দেশের তরুণসমাজ দেশকে রক্ষায় দুই বাহু প্রসারিত করে বুক পেতে দিয়েছে। ৪৭, ৫২, ৬৯, ৭১, ৯০ কিংবা ২০২৪— ইতিহাসের পথপরিক্রমায় তরুণরাই পথ দেখিয়েছে এই সবুজ-শ্যামল দেশটিকে।



বৈষম্য ও শোষণের শিকল ছিঁড়ে বারবার গণমানুষকে মুক্তি দিয়েছে দেশের তরুণরাই। এবারো এই তরুণরা রাজপথে ঢেলে দিল তাজাপ্রাণ।







তাদেরই রক্তঋণে ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়েছে দেশ। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে। দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকার রাষ্ট্রের নানা ক্ষেত্রে মরচে ধরা সিস্টেমকে ঘষেমেজে সংস্কারের মহাযজ্ঞ শুরু করেছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ পার করছে এ মুহূর্তে।

চব্বিশের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান ও সেই সূত্র ধরে রাজনৈতিক পালা বদলে দেশের তরুণরা আবারো প্রমাণ করেছে, পরিবর্তনকে অবরুদ্ধ করে রাখা শুধু মুশকিলই নয়, অসম্ভবও বটে! মূলত সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের মাধ্যমে গড়ে ওঠা আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ দ্রুত দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ন্যায়বিচার, জবাবদিহিতা এবং কাঠামোগত সংস্কারের লক্ষ্যকে সামনে রেখে। রক্তক্ষয়ী দুর্বার আন্দোলনে তরুণদের অন্যতম ও প্রধানতম দাবি হয়ে উঠে সমাজের প্রতিটি স্তরে জেঁকে বসা বৈষম্যের দেয়াল গুঁড়িয়ে দেওয়া। এখন সরকার সেই লক্ষ্যেই কাজ করছে। নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশন গঠন করে দেওয়া হয়েছে।  

সরকারের এমন উদ্যোগের মধ্যে মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য তোড়জোড় শুরু করেছেন। খুব দ্রুতই তারা জাতীয় নির্বাচন চাচ্ছেন। তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, জুলাইয়ের সহস্র শহীদের প্রাণদান যেন শুধু একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতেই হয়েছে! বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন কথা বলে। শুধু একটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য এই অভ্যূত্থান হয়নি। ছাত্রদের মুখর স্লোগানে কখনোই নির্বাচনের দাবি করা হয়নি। শহর কিংবা মফস্বলের অলিতে গলিতে আঁকানো দেয়াল চিত্রের কোথাও নির্বাচনের জন্যই যে এই আন্দোলন, তা বলা হয়নি। মূলত, দেশের প্রতিটি স্তরে যে ব্যাড সিস্টেমগুলো সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো দূর করে নতুন এক রাষ্ট্রকাঠামো বিনির্মাণের জন্যই ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছে।  

৫৪ বছর আগে আমাদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণ ছিল সীমাহীন। যে কারণে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এ দেশের তরুণরা। পরে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে জন্ম নেয় সম্ভাবনার বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছরেও দেশের মানুষ মুক্তি পায়নি। সেই মুক্তির জন্য বারবার এ দেশের তরুণরা রক্ত দিয়েছে। চব্বিশেও আজকের তরুণরা প্রাণ দিয়েছে। তারা আবারো গণমানুষের সেই মুক্তির জন্য লড়াই করছে। এই মুক্তি তখনই মিলবে যখন রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘূণে ধরা ব্যবস্থাকে সংস্কার তথা মেরামত করে ঢেলে সাজানো যাবে। ড. ইউনূসের সরকার সেই রাষ্ট্র মেরামতের কাজটিই করছে।

তবে আশার কথা হলো, দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল প্রধান প্রধান খাতগুলোতে সংস্কারের জন্য সরকারকে সময় দেওয়ার জন্য রাজি। বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীকে সংস্কারের আগে তারা কোনোভাবেই ভোট আয়োজন করতে চায় না। কারণ নির্বাচনের মাঠে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের বিরাট ভূমিকা থাকে। কিন্তু বর্তমান পুলিশ বাহিনীর সিংহভাগ সদস্যই গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ দেওয়া। গোটা পুলিশ বাহিনীকে শেখ হাসিনার সরকার যেভাবে দলীয় লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করেছে, সেরকম নজির আর এ দেশের ইতিহাসে নেই। ফলে এই বাহিনীর যথাযথ সংস্কার ছাড়া নির্বাচন আয়োজন করলে দেশে গৃহযুদ্ধের মতো কারবালা পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।

পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ একটি ভার্চ্যুয়াল মিটিংয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন, যেখানে তিনি দাবি করেছেন, পুলিশের ও প্রশাসনের ৯০ ভাগই আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। তার এই বক্তব্যে তিনি জানান, সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিকল্পনা চলছে এবং তাড়াতাড়ি নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার জন্য পরিকল্পনা হচ্ছে।

বেনজীর আহমেদ বলেন, “তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে প্ল্যান করা হচ্ছে। আপাতত ডক্টর ইউনূসের সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না, তবে সরকারের অসহযোগিতা করা এবং ব্যর্থ করে তাড়াতাড়ি নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনা হবে। এরপর বিএনপির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বিএনপিকে হটানোর পরিকল্পনা রয়েছে। ”

পুলিশ কর্তা বেনজীরের এই দম্ভমূলক উক্তিই প্রমাণ করে জাতীয় নির্বাচনের আগে পুলিশের সংস্কার কতোটা জরুরি। পুলিশের সংস্কার ছাড়া যেকোনো নির্বাচন আয়োজনই ঝুঁকির সৃষ্টি করবে।

দেশ স্বাধীনের পর থেকে আজ অবধি আমাদের দেশে পুলিশ কখনোই জনগণের বন্ধু হবার চেষ্টা করেনি। বিশেষ করে গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে পুলিশ সরকারি দলের লাঠিয়ালের ভূমিকায় হাজির হয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগের কারণে প্রাণ হারিয়েছে হাজারো মানুষ, গুম হয়েছেন বহু। এ কারণে সরকারের প্রতি জনগণের ক্ষোভ ও অনাস্থাও চরম আকার ধারণ করে। পুলিশের এমন আচরণ নতুন কিছু নয়। বহু বছর ধরেই বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীকে জনগণের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নয়, বরং রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিলো। পুলিশ প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরে জনগণের সঙ্গে সৌহার্দ্য প্রদর্শনের চাইতে তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকেই জরুরি মনে করতো, যে কারণে বাহিনীটি ক্রমেই অকার্যকর হতে থাকে এবং সমাজে বিভাজনের পরিবেশ তরান্বিত হয়। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও নির্বিচারে গ্রেপ্তারের অভিযোগে ক্রমেই পুলিশের ওপর জনগণের আস্থা নিম্নমুখী। সেবা ও সুরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশকে হরহামেশাই মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নটিকে উহ্য রেখে একটি সংকীর্ণ রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকতে দেখা যায়।

এমন বাস্তবতায় স্পর্শকাতর একটি পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভোট আয়োজন শুধু ঝুঁকিপূর্ণই নয়, গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। এ কারণে বিশ্লেষকরা মনে করেন, ঝুঁকি এড়াতে আগে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজন করা উচিৎ। পাশাপাশি রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চালিয়ে যাওয়া। যেমনটা জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত মার্চ মাসের এক সভায় কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মত প্রকাশ করেন যে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেওয়া বেশি যৌক্তিক। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারকাজ শেষ করা এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনার কাজটিও করতে হবে।

‘বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনবিষয়ক সংলাপ’ শীর্ষক ওই অনুষ্ঠানে বক্তারা আরও বলেছেন, দুটি সংস্কার কমিশন জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করার কথা বলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত জনমত জরিপেও দেখা গেছে, প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষ আগে স্থানীয় নির্বাচন চান।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ মূহুর্তে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে জনপ্রতিনিধি না থাকায় মানুষ সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন হলে শিক্ষিত ও যোগ্য ব্যক্তিরা জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য এগিয়ে আসবেন। দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন হলে প্রার্থী কেনা-বেচা হয়, এর বাইরে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা নিজের ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনকে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করান। তাঁদের বিজয়ী করতে দলীয় ও প্রশাসনিক প্রভাব বিস্তার করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্যও আগে স্থানীয় নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন। কারণ, স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা সহজ হয়। আগে স্থানীয় নির্বাচন হলে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা যাচাই করারও সুযোগ হবে। শুধু এবার নয়, সব সময় নির্দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করা এখন সময়ের দাবি।

নির্বাচনে পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এখনো পুলিশ নিষ্ক্রিয়। প্রশাসনেও সমস্যা আছে। প্রশাসন নিরপেক্ষ আচরণ করবে, তা আশা করা যায় না।

নিরাপদ সড়ক চাই–এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চনও বলেছেন, আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে অনেক উপকার হবে। তবে সবার আগে রাজনীতিবিদদের মধ্যে পরিবর্তন প্রয়োজন। তিনি প্রশ্ন রাখেন, রাজনীতিবিদদের মধ্যে কি কোনো পরিবর্তন এসেছে? 

অনেক বিশ্লেষক আবার বলছেন পুলিশ বাহিনী ও আইনের সংস্কারের পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বদল জরুরি। প্রতিটি সংকট একইসঙ্গে কোনো না কোনো সুযোগও আনে। সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন বর্তমান সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক পদক্ষেপ, তবে এখানেই থামলে চলবে না। দীর্ঘস্থায়ী, রূপান্তরমূলক পরিবর্তনের জন্য সামনে আরো পথ পাড়ি দিতে হবে। সেক্ষেত্রে পুলিশিং এ এমন পরিবর্তন তরান্বিত করতে হবে, যাতে করে বাহিনীর সংস্কৃতি, আচরণ, কাঠামো এবং আইনেও বদল আসে।  

বাংলাদেশ সময়: ১০২০ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০২৫



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews