ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন
৯ এপ্রিল, ২০২৫ | ১:১৫ অপরাহ্ণ
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৩৯তম ব্যাচের ডা. শায়লা নাজনীন তানিয়া ছিলেন একজন গাইনী অনকোলজিস্ট। নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন গাইনীকোলজিক্যাল ক্যান্সার যেমন জরায়ু মুখের ক্যানসার, ওভারিয়ান ক্যানসার, জরায়ুর ক্যানসার এবং মহিলাদের প্রজনন অঙ্গের বিবিধ ক্যানসারের সার্জারিতে নিজেকে পারদর্শী করে তুলতে। সেই ধারাবাহিকতায় অর্জন করেছিলেন এফসিপিএস এবং এমএস ডিগ্রী এবং নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন ক্যানসার রোগীর সেবায়। কিন্তু নিয়তির কি নির্মম পরিহাস ডাক্তার শায়লা নিজেই আক্রান্ত হলেন মানব্যাধি ক্যানসারে। উনার ক্যনাসারের চিকিৎসা ঠিকঠাক মতোই চলছিল কিন্তু বিধিবাম, একপর্যায়ে উনার লিভার কার্যকারিতা হারালো। বাংলাদেশের সব বড় বড় ডাক্তারদের বোর্ড বসানো হল এবং সিদ্ধান্ত আসলো লিভার ট্রানসপ্লান্টই একমাত্র ভরসা। বর্তমানে বাংলাদেশে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট রুটিনলি করা হয়না। ২০১০ সালে বাংলাদেশে প্রফেসর মোহাম্মদ আলি বারডেমে প্রথম লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করেছেন বলে জানা যায়। তবে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট রুটিনলি হয়ে থাকে।
লিভার ট্রান্সপ্লান্টের ব্যাপারে ভারতের ডা. মোহাম্মদ রেলার পরিচিতি বিশ্বব্যাপী। ডা. মোহাম্মদ রেলা এই পর্যন্ত ছয় হাজার লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করে গিনেস বুক অফ ওয়ার্লড রেকর্ডে নাম লিখিয়েছেন। ভারত ছাড়া থ্যাইল্যান্ড, সিংগাপুর ও মালেয়শিয়াতে ও লিভার ট্রান্সপ্লান্ট হয়। লিভার ট্রান্সপ্লান্ট অত্যন্ত ব্যয়বহুল যে ডা. শায়লার মতো একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হয়েও তার পরিবারের পক্ষে এই ব্যয়ভার বহন করা কঠিন হয়ে পড়ে। ভারতের রেলা ইন্সটিটিউটে আনুমানিক খরচ হতে পারে ২ কোটি টাকা। ডা. শায়লার চিকিৎসার জন্য তার পরিবার তাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব সেই ফান্ড যোগাড় করেন এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল এর প্রাক্তন ছাত্ররাও ফান্ড কালেকশনের জন্য এগিয়ে আসেন। এরই মাঝে ভিসার জটিলতা এবং অন্যান্য কারণে সময়মতো শায়লাকে বিদেশে পাঠানো বিলম্বিত হয় এবং উনার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হয়ে এই রমজানে ডা. শায়লা পরোলোকগমন করেন। আজকে বাংলাদেশে যদি লিভার ট্রান্সপ্লান্টের ব্যবস্থা থাকতো তাহলে ডা. শায়লার মতো একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে হয়তো আমাদের হারাতে হতো না।
উন্নত বিশ্বসহ আমাদের প্রতিবেশী দেশে অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি রুটিনলি হয়ে থাকে। আমেরিকার ডা. থমাস স্টার্জল ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারির জনক হিসাবে বিবেচিত। আমেরিকায় শুরুটা হয়েছিল ১৯৫৪ সালে প্রথম মানুষের কিডনী ট্রান্সপ্লান্ট দিয়ে। তারপর ১৯৬৬ সালে একই সাথে ট্রান্সপ্লান্ট করা হয় কিডনী ও প্যানক্রিয়াস। ১৯৬৭ সালে সফলভাবে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করেন ডা. থমাস স্টার্জল। ১৯৮৯ সালে প্রথম জীবন্ত মানুষের লিভার ট্রান্সপ্লান্ট শুরু হয়। তারপর শুরু হয় ফুসফুস এর ট্রান্সপ্লান্ট। এইভাবে ধীরে ধীরে লিভিং ডোনারের অঙ্গ ট্রান্সপ্লান্টের হার সময়ের সাথে বাড়তে থাকে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী ট্রান্সপ্লান্ট হয়েছে আমেরিকায়। ২০২২ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় ১০ লক্ষট্রান্সপ্লান্ট সম্পন্ন হয়েছে। এটি একটি হিস্টোরিক মাইলস্টোন।
বাংলাদেশে প্রথম চোখের কর্র্নিয়া ট্রান্সপ্লান্ট হয়েছিল ১৯৮৪ সালে এবং প্রথম কিডনী ট্রান্সপ্লান্ট হয়েছিল ১৯৮২ সালে। বর্তমানে কিডনী রোগীর সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে আনুমানিক ১০ মিলিয়নের চেয়ে বেশী লোক কিডনী রোগে আক্রান্ত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। দেশে ৫টি সেন্টারে নিয়মিত কিডনী ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের একজন শল্যচিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম এক হাজারেরও বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে, এর এক-তৃতীয়াংশ তাঁর হাত দিয়ে হয়েছে বলে জানা যায়।
কিডনী রোগের সাথে সাথে বাংলাদেশে লিভারের রোগও বাড়তির দিকে। আগেই উল্লেখ করেছি যে আমাদের দেশে প্রথম লিভার ট্রান্সপ্লান্ট হয় ২০১০ সালে বারডেম হাসপাতালে এবং লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করেন প্রফেসর মোহাম্মদ আলি। আমাদের দেশের ডাক্তাররা যদিও ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি করতে সক্ষম কিন্ত যথাযথ ট্রান্সপ্লান্ট প্রোগ্রাম ডেভেলপ না করায় তরুণ ডাক্তারদের আগ্রহ ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারির প্রতি তেমন বেশী নাই।
বর্তমানে ঢাকায় বেসরকারীভাবে কিডনী ট্রান্সপ্লান্টের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। আমাদের দেশের বেশীর ভাগ লোক ভারত, থাইল্যান্ড ও সিংগাপুরে কিডনী অথবা লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করার জন্য যেয়ে থাকেন। তবে বিদেশে ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারির খরচ অনেক বেশী। ভারতে কিডনী ট্রান্সপ্লান্ট করতে ৬০ থেকে ৭০ লক্ষ টাকা খরচ হয় এবং লিভার ট্রান্সপ্লান্টে খরচ প্রায় ২ কোটি টাকার কাছাকাছি। এত বড় বিগ বাজেটের খরচ বাংলাদেশে খুবই কম লোক করতে পারবেন বলে আমার ধারণা। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভিসা সংক্রান্ত জটিলতাও বিদেশে যাওয়ার অন্তরায় বলে আমি মনে করি।
বিভিন্ন রক্তের ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ‘বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট’ একটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা। বাংলাদেশে ২০১৪ সাল থেকে বোস্টনের ম্যাচাচুসেট জেনারেল হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের যৌথ উদ্যোগে ‘বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট’ শুরু হয়েছে। বর্তমানে সীমিত আকারে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ‘বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট’ ধীর গতিতে এগিয়ে চলছে বলে জানা যায়। তারপরও প্রায় সময় রক্তের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীরা ভারতে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন। ‘বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট’ একটি ব্যায়বহুল চিকিৎসা। চিকিৎসার প্রকারভেদে খরচ প্রায় ৩৫ হাজার ডলার থেকে ৫৫ হাজার ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
ভারতের ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি প্রোগ্রাম কিছু কিছু প্রদেশে বেশ সুনাম অর্জন করেছে। লিভার ট্রান্সপ্লান্টের ব্যাপারে ডা. মোহাম্মদ রেলার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। ডা. রেলার পরিচিতি বিশ্বব্যাপী। আমাদের নিজেদের ট্রান্সপ্লান্ট প্রোগ্রাম ডেভেলপ করা এখন সময়ের দাবী বলে আমি মনে করি। এ জন্য আমাদের দরকার একটি ডেডিকেটেড ‘জাতীয় ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টার’ স্থাপন করা। ইতিমধ্যে ঢাকায় কোরিয়া সরকারের সহায়তায় পিজি হাসপাতালের পাশে সুপার স্পেশিয়ালাইজ হাসপাতালের নির্মাণ কাজ সম্পূর্র্ণ হয়েছে কিন্তু হাসপাতালটি এখনো পুরাপুরিভাবে চালু হয় নাই।
প্রযুক্তিনির্ভর অত্যাধুনিক চিকিৎসাসেবা দিতে ‘সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল’ উদ্বোধন হয়েছে কিন্তু বিশেষায়িত এই হাসপাতাল পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা তো দূরের কথা, একজন রোগীও ভর্তি করতে পারেনি। দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে উঠেছে রাজধানীর শাহবাগের বিএসএমএমইউর কেবিন ব্লক ও সি ব্লকের উত্তর এবং ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের পশ্চিমদিকে। আমার প্রস্তাব হলো যেহেতু দেশে কিডনী, লিভার এবং বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে সেহেতু আমাদের একটি জাতীয় ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টার চালু করা দরকার। এ ক্ষেত্রে ‘সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল’কে ‘বাংলাদেশ জাতীয় অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টার’ হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। যেহেতু এই হাসপাতালে ৭৫০টি বেড থাকবে, যার মধ্যে থাকবে একশ’টি আইসিইউ বেড এবং একশ’টি ইমার্জেন্সি বেড। তাছাড়াও ইনফেকশন কন্ট্রোলের কথা মাথায় রেখে কোরিয়ান প্রযুক্তিতে এই হাসপাতালের ফ্লোর, অপারেশন থিয়েটার, আইসিইউ রুমসহ সবকিছু নির্মাণ করা হয়েছে, যাতে করে অপারেশনপরবর্তীতে রোগীদের কম ইনফেকশন হয়।
একটি আধুনিক হাসপাতালে ইলেক্ট্রনিক মেডিকেল রেকর্ড থাকা জরুরি, আমার ধারণা ‘সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল’-এ ইএমআর সব সুযোগ সুবিধা বর্তমান। কিডনী, লিভার ও বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট রোগীদের ট্রান্সপ্লান্ট পর আইসিইউতে নিবিড় পরিচর্যায় থাকাটা জরুরি। সেই বিবেচনায় ‘সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল’ হতে পারে শুধুমাত্র দেশের একমাত্র অঙ্গ প্রতিস্থাপন হাসপাতাল। এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই যে এই হাসপাতাল হবে সম্পূর্ণ স্বায়ত্বশাসিত এবং সকল ডাক্তারের নিয়োগ হবে বিশেষজ্ঞ হিসাবে এবং জুনিয়র ডাক্তার থাকবে শুধু শিক্ষানবিশ রেসিডেন্ট। কোন অবস্থাতেই এখানে মেডিকেল অফিসার নিয়োগ দেওয়া যাবে না। তার কারণ হলো অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে ঢাকায় স্থায়ীভাবে থাকার জন্য স্বায়ত্বশাসিত হাসপাতালে মেডিকেল অফিসারের পদটিকে রাজনৈতিক পোস্ট হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং এরা প্রতিষ্ঠানের কোন উপকারেতো আসেনি বরং বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। আমরা যদি একটি ন্যাশনাল ট্রান্সপ্লান্ট প্রোগ্রাম সহসা চালু না করি তাহলে জাতি হিসাবে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়ব।
আমার প্রস্তাব হলো বর্তমানে আমাদের দেশে যে কয়জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কিডনী, লিভার ও বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারির সাথে জড়িত উনাদের সাথে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী জনাব ডা. অধ্যপাক সায়েদুর রহমান মিটিং করে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে অতি সত্ত্বর সুপার স্পেশিয়ালাইজ হাসপাতালটিকে জাতীয় অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টার হিসাবে ঘোষণা করা হোক। আমি মনে করি ‘সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল’কে যদি ‘জাতীয় ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টার’ হিসাবে যথাযথভাবে চালু করা যায় এবং সাথে একটি ‘ন্যাশনাল ট্রান্সপ্লান্ট প্রোগ্রাম’ শুরু করা যায় তাহলে সেটা হবে স্বাস্থ্যবিভাগের পক্ষ থেকে ‘জুলাই বিপ্লব’ এর সবচেয়ে বড় অর্জন।
লেখক: রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, সেইন্ট জন রিজিওনাল হসপিটাল, নিউ ব্রান্সউইক। এসিস্টেন্ট প্রফেসর, ডালহাউসী ইউনিভার্সিটি, কানাডা।
পূর্বকোণ/ইব