ছবির উৎস, Santosh Kumar/Hindustan Times via Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
বিহারের নির্বাচনের কয়েক মাস আগে শুরু হয়েছে ভোটার তালিকার 'বিশেষ নিবিড় সংশোধন'
এক ঘন্টা আগে
ভারতের নির্বাচন কমিশন বলছে, বিহার রাজ্যের ভোটার তালিকায় তারা এমন অনেক নাম পেয়েছে, যারা বাংলাদেশ, নেপাল আর মিয়ানমারের নাগরিক।
কমিশনের সূত্র উদ্ধৃত করে ভারতের সংবাদ সংস্থা পিটিআই এবং এএনআই এই খবর জানিয়েছে।
বিহারে এবছরের শেষ দিকে বিধানসভার নির্বাচন হওয়ার কথা আর তার আগে ভোটার তালিকায় এখন 'বিশেষ নিবিড় সংশোধন' চলছে। এই প্রক্রিয়াটির বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই বিরোধী দলগুলি সরব হয়েছে এবং ভারতের সুপ্রিম কোর্টে মামলাও চলছে।
তার মধ্যেই নির্বাচন কমিশনের সূত্রগুলি জানিয়েছে যে ভোটার তালিকায় 'বিশেষ নিবিড় সংশোধন'-এর কাজে নিয়োজিত 'বুথ লেভেল অফিসার'রা এমন বহু সংখ্যক ভোটার পেয়েছেন, যারা নেপাল, বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মানুষ।
ওই বুথ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বাড়ি-বাড়ি ঘুরে যে নথি যাচাইয়ের কাজ করছেন, তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ওই সব বিদেশি নাগরিকদের কাছে আধার কার্ড, 'ডোমিসাইল সার্টিফিকেট' এবং রেশন কার্ডও রয়েছে।

ছবির উৎস, Santosh Kumar/Hindustan Times via Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধন নিয়ে বিজেপি-বিরোধী দলগুলি সম্মিলিত প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনের যে সূত্র উদ্ধৃত করে এসব দেশের নাগরিকদের ভোটার তালিকায় থাকার তথ্য সামনে আসে, সেটি কটাক্ষ করে রাজ্যের বিরোধী দল রাষ্ট্রীয় জনতা দলের নেতা তেজস্বী যাদব বলেছেন, "কমিশন বলছে যে তারা সূত্র থেকে এই তথ্য পেয়েছে। এটা সূত্র নয়, মূত্র।"
পুরো 'নিবিড় সংশোধন' প্রক্রিয়া নিয়েই প্রশ্ন তুলে তিনি পাটনায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কমিশন যদিও দাবি করেছে যে ৮০ শতাংশ মানুষের ফর্ম জমা করা হয়ে গেছে, তবে "আমার নিজের ফর্মই এখনও জমা নেয় নি। ফর্ম ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকছে। কিছু জায়গায় তো ওই ফর্মে করে জিলিপি বিক্রি করা হচ্ছে।"
তার কথায়, এই সংশোধন প্রক্রিয়ায় যদি এক শতাংশ মানুষেরও নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ যায়, তার অর্থ প্রায় আট লক্ষ মানুষ ভোটাধিকার হারাবেন।
আবার রাজ্য সভার সদস্য ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রী কপিল সিব্বাল 'নিবিড় সংশোধন' এর পুরো প্রক্রিয়াটিকে অসাংবিধানিক বলে মন্তব্য করেছেন।
সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মি. সিব্বাল বলেছেন যে, নির্বাচন কমিশনের অধিকারই নেই কারও নাগরিকত্ব নির্ধারণ করার।
তার কথায়, "আমার মতে সম্পূর্ণভাবে অসাংবিধানিক একটা প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে। কমিশনের অধিকার নেই নাগরিকত্ব নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার, তার ওপরে ব্লক স্তরের কর্মকর্তাদের দিয়ে করানো হচ্ছে। আমি বলে আসছি যে ওরা (বিজেপি) ভোটে জেতার জন্য যে কোনও পদ্ধতি নিয়ে থাকে। এই বিশেষ নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়া চালানোর উদ্দেশ্যই হল যাতে ভবিষ্যতে সংখ্যাগরিষ্ঠ-বাদী-সরকার গড়া যায়, সেটা নিশ্চিত করা।''
"উদ্দেশ্যটা হচ্ছে গরীব, প্রান্তিক মানুষ, আদিবাসীদের নাম বাদ দিলে সেই দলই জিতবে সবসময়ে, যারা চায় একটা সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী সরকার ক্ষমতায় থাকে," বলছিলেন সুপ্রিম কোর্টের এই প্রবীণ আইনজীবী।
সুপ্রিম কোর্টে এই নিবিড় সংশোধন নিয়ে যেসব মামলা হয়েছে, তার অন্যতম আইনজীবী মি. সিববাল।

ছবির উৎস, Santosh Kumar/Hindustan Times via Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
বিহারে ২০০৩ সালে শেষবার ভোটার তালিকায় 'বিশেষ নিবিড় সংশোধন' হয়েছিল
ভারতের নির্বাচন কমিশন নানা রাজ্যে ভোটার তালিকার স্পেশাল ইন্টেনসিভ রিভিশন বা 'নিবিড় সংশোধন' করে থাকে। বিহারের ক্ষেত্রে ২০০৩ সালে এরকম নিবিড় সংশোধন করা হয়েছিল।
এই প্রক্রিয়ায় বুথ স্তরের কর্মকর্তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নথি যাচাই করছেন। প্রায় ৭৮ হাজার বুথ স্তরের কর্মকর্তা রাজ্য জুড়ে এই প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন বলে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে নথি যাচাইয়ের পরে যেসব ব্যক্তি ভোটার তালিকায় থাকার যোগ্য নন বলে মনে করবেন কমিশন, তাদের ব্যাপারে পুরো অগাস্ট মাস জুড়ে তদন্ত করা হবে এবং তদন্তে যদি দেখা যায় যে কোনও এক ব্যক্তি ভোটার হওয়ার যোগ্য নন, তাহলে তার নাম চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় থাকবে না। ওই তালিকা প্রকাশ করা হবে ৩০শে সেপ্টেম্বর।
ভোটার তালিকায় নাম থাকার জন্য যোগ্যতার যে মাপকাঠি ঠিক করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন, তাতে ১১টি নথির কথা বলা হয়েছে।
জন্মের বছর অনুযায়ী আবার একেক জনকে একেক ধরনের নথি দেখানোর কথা বলা হয়েছে।
তবে সবাইকেই একটি 'এনুমারেশন ফর্ম' ভর্তি করতে হবে।
নির্বাচন কমিশনের সূত্র উদ্ধৃত করে সংবাদ সংস্থা পিটিআই এবং এএনআই জানিয়েছে যে শনিবার, ১২ই জুলাই পর্যন্ত বিহারের ৮০ শতাংশেরও বেশি ভোটার ওই ফর্ম জমা দিয়েছেন।

ছবির উৎস, Santosh Kumar/Hindustan Times via Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
সব ভোটারকেই একটি ফর্ম পূরণ করতে হচ্ছে, জমা দিতে হচ্ছে নথি
জুন মাসে নির্বাচন কমিশন একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলেছিল যে, ২০০৩ সালের ভোটার তালিকায় যাদের নাম ছিল, তাদের শুধু একটি ফর্ম ভর্তি করলেই হবে।
তবে যাদের নাম ওই তালিকায় ছিল না আর পয়লা জুলাই, ১৯৮৭ সালের আগে জন্ম হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে জন্মস্থান এবং জন্মসনদ দিতে হবে।
আবার ১৯৮৭ সালের পয়লা জুলাই থেকে ২০০৪ সালের দোসরা ডিসেম্বরের মধ্যে যাদের জন্ম হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে নিজের নথির সঙ্গেই বাবা-মায়ের কোনও একজনের নথি দিতে হবে। এর পরে যাদের জন্ম হয়েছে, তাদের নিজের নথির সঙ্গেই বাবা এবং মা দুজনের নথিই জমা দিতে হবে।
'ভারত জোড়ো অভিযান'এর জাতীয় সচিব ও সমন্বয়ক কামায়নী সোয়ামী বিবিসিকে বলছিলেন, "যে ১১টি নথি চাওয়া হচ্ছে, সেই সব নথি একটা বড় অংশের মানুষের কাছেই নেই। ছোট পরিসরে একটা সার্ভে করা হয়েছিল আটটি জেলার ১২টি বিধানসভা এলাকা নিয়ে। সেখানে দেখা গেছে যে ৬৩ শতাংশ মানুষের কাছেই ওই সব নথি নেই।
"এছাড়াও প্রান্তিক মানুষ, নারীরা – এদের পক্ষে কী নথি দিয়ে ফর্ম পূরণ করা সম্ভব হবে?" প্রশ্ন করছিলেন মিজ. সোয়ামী।

ছবির উৎস, Santosh Kumar/Hindustan Times via Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
"সরকারের নিজের দেওয়া তথ্য অনুযায়ীই নির্বাচন কমিশন যেসব নথি চাইছে, তা বহু মানুষের কাছেই নেই।"
বিহারে বিবিসির সংবাদদাতা সিটু তিওয়ারী রাজ্যের নানা এলাকায় ঘুরেছেন ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনের প্রক্রিয়া নিজের চোখে দেখতে।
তিনি বিবিসি হিন্দিকে জানিয়েছেন, "পাটনার কমলা নেহরু নগর একটা বড় বস্তি অঞ্চল। আমি সেখানে গিয়ে দেখতে পাই বুথ স্তরের কর্মকর্তারা মানুষের কাছ থেকে আধার কার্ড সংগ্রহ করছেন। আমি তার কাছে জানতে চাই যে আধার কার্ড কেন নেওয়া হচ্ছে, ১১টি নথির তালিকায় তো আধার কার্ড নেই! আমাদের বলা হয় যে যাদের কাছে অন্য কোনও নথি নেই, তাদের থেকে আধার কার্ড নেওয়ার জন্য নির্দেশ আছে।''
"আশ্চর্যের বিষয় হল সরকারের নিজের দেওয়া তথ্য অনুযায়ীই নির্বাচন কমিশন যেসব নথি চাইছে, তা বহু মানুষের কাছেই নেই। বিহারে ২০২২ সালে যে জাতিগত সার্ভে হয়েছিল, সেই তথ্য অনুযায়ী মাত্র ১৪ শতাংশ মানুষ দশম শ্রেণি পাশ করেছেন, ৬০ শতাংশেরও কম মানুষের পাকা বাড়ি রয়েছে," জানাচ্ছিলেন সিটু তিওয়ারী।
তার কথায়, "এখন ফসল রোয়ার সময়। বেশিরভাগ শ্রমিকই পাঞ্জাবে চলে গেছেন বা এখানেই নিজের ক্ষেতে ব্যস্ত। নির্বাচন কমিশনের তথ্যই বলছে যে বিহারের ২১ শতাংশ ভোটার বিহারের বাইরে বসবাস করেন। এরকম মানুষরা কী করে নথি জোগাড় করবেন"?

ছবির উৎস, David Talukdar/NurPhoto via Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
আসামে এনআরসির সময় নানা ধরনের নথি জমা দিতে হয়েছিল মানুষকে - ফাইল ছবি
ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধনের সময়টা নিয়েও বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন। তারা এই অভিযোগও তুলেছেন যে, নির্বাচন কমিশন আসলে বিজেপির চাপেই কাজ করছে।
আবার এরকম ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে যে বিহারের পরে ২০২৬ সালে যেসব রাজ্যে নির্বাচন আছে, সেগুলির ক্ষেত্রেও একইভাবে 'বিশেষ নিবিড় সংশোধন' প্রক্রিয়া চালানো হতে পারে।
ওই সব রাজ্যগুলির মধ্যেই আছে পশ্চিমবঙ্গও।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বলেছেন, "বিজেপির ইশারায় কাজ করছে নির্বাচন কমিশন এবং ঘুরপথে এনআরসি চালু করার চেষ্টা করা হচ্ছে।"
এখনও পর্যন্ত এনআরসি বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জি করা হয়েছে শুধুমাত্র আসামে। যে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতে দেখা গিয়েছিল প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষ সেখানে ভোটাধিকার হারিয়েছেন। এদের মধ্যে সিংহভাগই হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
তবে আসামের সরকার ওই এনআরসির তথ্যকে মান্যতা দেয় নি।
আসামের এনআরসি-র প্রক্রিয়াতেও নানা ধরনের নথি দেখাতে হয়েছিল।

ছবির উৎস, SACHIN KUMAR/AFP via Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
বিহার নির্বাচনের আগে জুন মাসে এক রাজনৈতিক প্রচার সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার (ডানদিক থেকে দ্বিতীয়)
ভোটার তালিকায় 'বিশেষ নিবিড় সংশোধন' প্রক্রিয়া নিয়ে বিরোধী দলগুলির সম্মিলিত আক্রমণের মুখে ভারতীয় জনতা পার্টি বারবারই নির্বাচন কমিশনের পক্ষ নিয়েছে।
ভোটার তালিকায় বড় সংখ্যক বাংলাদেশি, নেপালি ও মিয়ানমারের নাগরিকদের নাম পাওয়ার তথ্য নির্বাচন কমিশন জানানোর পরে বিজেপি বলেছে যে 'শুধু বিহারীরাই আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের ভাগ্য নির্ধারণ করবে, বিদেশি বা অনুপ্রবেশকারীরা নয়।'
বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র শাহনাওয়াজ হুসেইন সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে বলেছেন, "ভোটার তালিকায় সংশোধন নিয়ে বিহারের বাসিন্দা এবং বৈধ ভোটারদের কোনও সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু অবৈধ অনুপ্রবেশকারী এবং যেসব বিদেশিরা নেপাল, মিয়ানমার বা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, তাদের নাম ভোটার তালিকায় থাকতে পারে না।''
"বিহারিরাই ভোট দিয়ে বিহারের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবেন, অন্য দেশের নাগরিকরা নন," মন্তব্য মি. হুসেইনের।
দলটির আরেক জাতীয় মুখপাত্র শেহজাদ পুণাওয়ালা কংগ্রেস এবং রাষ্ট্রীয় জনতা দলকে নিশানা করে মন্তব্য করেছেন যে ওই দলগুলি তাদের শাসনামলে বিভিন্ন দেশের অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের 'নিয়ে এসে বসতি গড়েছিল'।
"এদের বিভিন্ন ধরনের পরিচয় পত্র করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন তাদের খুঁজে বের করে বাদ দেওয়া হচ্ছে। সংবিধান অনুযায়ী শুধুমাত্র ভারতের নাগরিকরাই যাতে ভোটাধিকার পান, সেটাই নিশ্চিত করা হচ্ছে," মন্তব্য মি. পুণাওয়ালার।
বিজেপির সংসদ সদস্য সঞ্জয় জয়সওয়াল বিবিসিকে বলছিলেন, "নাম বাদ পড়ার কথা বলা হচ্ছে। প্রশ্নটা তো এটা যে যারা বাইরের কোনও দেশের নাগরিক, তাদের ভোট দেওয়া উচিত কী না। বিহারের কিষণগঞ্জ, পূর্ণিয়া, কাটিহারের মতো বেশ কিছু জেলায় আধার কার্ডধারীর সংখ্যার থেকেও ভোটারের সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ বেশি।
"যারা বাইরের মানুষ, সমস্যাটা তাদের হচ্ছে। বিহারি আর এখানকার বাসিন্দাদের কোনও সমস্যাই নেই,"বিবিসি হিন্দিকে বলছিলেন মি. জয়সওয়াল।