একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হলে জনগণ তার সুফল পায়। নির্বাচনে হেরে যাওয়ার ভয়ে জনপ্রতিনিধিকে জনগণের জন্য সত্যিকার কিছু করতে হয়। বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন বিদায় নিয়েছে। এমনকি সামাজিক, পেশাজীবী ও ব্যবসায়িক সংগঠনগুলোতেও নির্বাচনের বদলে মনোনীত ব্যক্তিরা নেতা হচ্ছেন।

 ‘রাজনীতি, উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও প্রবৃদ্ধি: বাংলাদেশ ও পরবর্তী’ শীর্ষক কর্মশালায় গতকাল বৃহস্পতিবার বক্তারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ও যুক্তরাজ্যের সংস্থা ইফেক্টিভ স্টেটস অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (ইএসআইডি) এ কর্মশালার আয়োজন করে।

দিনভর এ কর্মশালায় সুশাসনের ঘাটতি থাকার পরও বাংলাদেশ কীভাবে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে; বাংলাদেশ কি উন্নয়নের ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার মডেল অনুসরণ করছে, এই মডেল কি কার্যকর হবে—এসব তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা। এর মধ্যেই উঠে আসে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রসঙ্গ, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটির শক্তিশালী হয়ে ওঠার প্রসঙ্গ এবং কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রসঙ্গ।

ঘুরেফিরে আসে ‘রেন্ট সিকিং’ নামের একটি শব্দযুগলের কথা, যা বলতে মুনাফা বা ব্যক্তিগতভাবে লাভের জন্য রাষ্ট্রীয় নীতিকে প্রভাবিত করাকে বোঝায়। বক্তারা বলেন, দেশে এখন রেন্ট সিকারের সংখ্যা বেড়েছে। এ তালিকায় আছে নতুন যুক্ত হওয়া রাজনীতিবিদ, আমলা, পুলিশ, নিয়ন্ত্রণকারী এজেন্ট ইত্যাদি।

গতকাল সকালে আলোচনার দিক ঠিক হয় বিআইজিডির ফেলো মির্জা হাসান ও সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানের একটি যৌথ উপস্থাপনার মাধ্যমে। এতে দুই গবেষক প্রশ্ন তোলেন, সুশাসনের ঘাটতি থাকার পরও বাংলাদেশের যে উন্নতি হয়েছে তার পেছনের কারণ কী?
তাঁরা বলেন, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে একটি ধন্দ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এটা মনে করা হয় যে উন্নয়নের জন্য সুশাসন দরকার। তাহলে বাংলাদেশের উন্নয়ন কীভাবে হলো?

এর জবাবও দেওয়ার চেষ্টা করেছেন মির্জা হাসান ও সেলিম রায়হান। অনেকগুলো কারণের মধ্যে মির্জা হাসান একটি কারণ উল্লেখ করে বলেন, একজন রাজনীতিবিদ তাঁকে বলেছিলেন রাজনীতির ক্ষেত্রে দুই প্রধান দল ঝগড়া করে দিন শেষে সমঝোতা করে। তবে এখন সেটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো সংঘাতে লিপ্ত হয় না। এটাই এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে।

কর্মশালার ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পেছনের রাজনীতি অনুধাবন’ শীর্ষক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এতে বাংলাদেশের শাসন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ মোটামুটি সব ধরনের শাসন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পার করে এসেছে। এ নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনার একপর্যায়ে তিনি বলেন, শাসক জানে যে রেন্ট সিকিং সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে তারা হেরে যাবে। রাজনীতিতে এ বিষয়টি খুব দরকার। সাংসদ যখন জানবেন ভবিষ্যতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে, তখন তাঁকে জনগণের জন্য সত্যিকার কিছু করতে হবে, যাতে পরবর্তী নির্বাচনে টিকে থাকা যায়।

জেমকন গ্রুপের পরিচালক কাজী আনিস আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের শাসনকে যতটা খারাপ বলা হয়, ততটা নয়। তারা যেসব সূচকের ভিত্তিতে শাসনকে খারাপ বলে, সেগুলোতে হয়তো খারাপ। এর বাইরেও অনেক কিছু আছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার স্বীকার করুক আর না করুক, তাদের বৈধতা (লেজিটিমেসি) নিয়ে পর্যবেক্ষকসহ অন্যদের মধ্যে উৎকণ্ঠা আছে। এখন সরকার চূড়ান্ত বৈধতা পেতে উন্নয়নকে সামনে আনছে।

অধিবেশনের সমাপনীতে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আগে আমরা দেখেছি সরকার বদল হতো, নীতি বদল হতো, প্রকল্প বাতিল হতো। এরপর একটা সময় আসল যখন সরকার বদল হয়, নীতি বদল হয় না, প্রকল্প বদলে যায়। তারপর এল সরকার বদল হয়, নীতি বদল হয় না, প্রকল্পও বদল হয় না। তারপর আমরা দেখলাম সরকার বদল হলো, নীতি বদল হয় না, প্রকল্পও বদল হয় না, ঠিকাদার বদল হয়। এরপর আবার দেখলাম সরকার বদল হয়, নীতি বদল হয় না, প্রকল্প বদল হয় না, ঠিকাদারও বদল হয় না। কিন্তু ঠিকাদার দলবদল করে।’

এ সময় দর্শক সারিতে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক আসিফ নজরুল বলেন, এখন আর সরকারও বদল হয় না।

দিনের দ্বিতীয় ভাগে ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমঝোতা: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এক অধিবেশনে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারের অধ্যাপক ডেভিড হিউম সভাপতিত্ব করেন। এতে পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারপারসন হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের মাঠপর্যায়ে শাসনতন্ত্রের অঙ্গগুলোর মধ্যে ক্ষমতার একটা ভারসাম্য ছিল। এখন জেলা প্রশাসনের কাঠামোর মধ্যে আমলা ও অন্যান্য সেবা সংস্থার চেয়ে পুলিশ অনেক বেশি রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করেছে। এটা নতুন স্বাভাবিকের (নিউ নরমাল) একটি উদাহরণ।

হোসেন জিল্লুর রহমান মনে করেন, নতুন স্বাভাবিকের আরেকটি দিক হলো ব্যবসায়ী, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোর নির্বাচন থেকে প্রতিযোগিতা বিদায় নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের কথা ভুলে যান। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোতেও এখন নির্বাচন নয়, মনোনয়ন হচ্ছে। একই ঘটনা ঘটছে প্রত্যেকটি পেশাজীবী খাতে।’

এই অধিবেশনে বিআইজিডির মির্জা হাসান বলেন, রেন্ট ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দুটি ধরন আছে। একটি কেন্দ্রীয়, অন্যদিকে বিকেন্দ্রীয়। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, আগে এসপির সঙ্গে তাঁদের চুক্তি করতে হতো, এখন তাঁদের থানার ওসির সঙ্গেও চুক্তি করতে হয়। এখন সবার ঠেকিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এখন আর যথেষ্ট নয়, থানা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে ‘ডিল’ করতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এতে রেন্ট সিকারের সংখ্যা বেড়েছে, যা বিনিয়োগের ব্যয় বাড়াচ্ছে।

কর্মশালার সমাপনী বক্তা ছিলেন সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, মানুষ আদর্শ দ্বারা চালিত হবে, এটা এখন কথার কথা। আদর্শ কেবল জাতীয় দিবসগুলোতে ভাষণ দিতে ব্যবহার করা হয়। এর বদলে ব্যক্তিগত উন্নয়ন শক্তিশালী আদর্শ। যারা খেলা খেলছে তাদের প্রায় সবাই এর দ্বারা চালিত। তিনি বলেন, আদর্শ শক্তিশালী না থাকায় এখন রাজনৈতিক দলগুলোতে নেতা-কর্মীদের একত্র রাখার কোনো উপাদান নেই। এর ফলে কর্মীরা সম্পদ দখলের জন্য অভ্যন্তরীণ কোন্দলে লিপ্ত।

রেহমান সোবহান আরও বলেন, এখন বিপুল পরিমাণ অর্থ বিতরণ হচ্ছে, তার দখল নিতে লড়াই চলছে। ২৫ বছর আগের বাজেটের সঙ্গে এখনকার বাজেটের তুলনা করলে দেখা যাবে, সরকারি ব্যয় অনেক বেশি হচ্ছে।

কর্মশালায় সিপিডির বিশেষ ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহান, যুক্তরাজ্যের ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (আইডিএস) গবেষক নাওমি হোসেন, সোহেলা নাজনীন, বিআইজিডির সিমীন মাহমুদ তাঁদের উপস্থাপনা তুলে ধরেন। মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ও গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী। এ সময় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম, সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews