বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব এবং নোবেল লরিয়েট। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান এবং একজন অর্থনীতিবিদ। ‘ক্ষুদ্র ঋণ’ নিয়ে রয়েছে তার ব্যাপক গবেষণা এবং সাফল্য। তার এই ক্ষুদ্র ঋণের মডেলটি এখন সারা বিশ্বে অনুকরণীয়। এই বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি এখন ব্যস্ত তার নতুন সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ধারণা ‘থ্রি জিরো’ প্রচার এবং প্রসারে। পৃথিবীর যেখানেই যাচ্ছেন, তিনি তার এই নতুন তত্ত্ব বিনামূল্যে বিলিয়ে দিচ্ছেন।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানে ১৫ বছরের স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পরপর বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর কেটে গেলো আরও ৮টি মাস। স্বাভাবিকভাবেই এত বড় একটি গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা থেকে অর্থনীতি সব কিছুই ভেঙে পড়ে।  তাছাড়া বিগত সরকার আমলের রেখে যাওয়া অনিয়ম, লুটপাট, দুর্নীতি, অত্যাচার অনেকটা দায়ী এই অরাজকতার পেছনে। তবে দেশের মানুষ প্রত্যাশা করেছিল, ড. ইউনূস সরকার সবকিছু দ্রুত মোকাবিলা করে দেশে একটি অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনবে।

কিন্তু দেশে যে পরিমাণ মব জাস্টিস শুরু হলো, তাতে দেশের মানুষ অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েছে।  একদিকে ‘তৌহিদী জনতা’ নামে মৌলবাদীদের উত্থান, অন্যদিকে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে যখন তখন ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ ট্যাগ দিয়ে ভাঙচুর, আক্রমণ। শুধু তাই নয়, ‘নয়া বন্দোবস্ত’ প্রচারের সময় বন্ধ নেই পুরোনো বন্দোবস্ত।

অর্থনৈতিক দুরবস্থা, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, নিরাপত্তার অভাব, সংস্কার নিয়ে ধোঁয়াশা, ফ্যাসিস্টদের বিচারের মন্থর গতি, রাজনৈতিক আস্থার মন্দা ইত্যাদি বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত দেশ। এমন কঠিন সময়েও ড. ইউনূস রাষ্ট্রীয় সফরে যেখানেই যাচ্ছেন, রাষ্ট্রের টাকায় ক্রমাগত তিনি তার ‘থ্রি জিরো’ তত্ত্বের বয়ান দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তার দেশে সত্যিকার অর্থে কী প্রয়োজন তা উপলব্ধি করতে পারছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না।

একটু অন্যভাবে বলি, যে দেশের মানুষের গড় আইকিউ বা বুদ্ধ্যঙ্ক লেভেল ৭০-৭৫, সেই দেশের মানুষ তার এই তিন শূন্য কতটা বুঝতে পারছে, তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তিন শূন্য নিয়ে তাই জনগণের কোনও মাথাব্যথা নেই। আমরা সাধারণ মানুষ বুঝি, তিন বেলা খেতে পারবো কিনা, মাস শেষে বেতনটা পাবো কিনা, অসুস্থ হইলে চিকিৎসা পাবো কিনা, একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে কিনা, সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করতে পারবো কিনা, রাস্তায় বেরুলে নিরাপত্তা পাবো কিনা ইত্যাদি।

গণঅভ্যুত্থানের পর সাধারণ মানুষের আশা ছুঁয়েছিল আকাশ। ভেবেছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের বেঁচে থাকার সামান্যতম উপায় বেরিয়ে আসবে। কিন্তু গত প্রায় ৮ মাসেও গণ-আকাঙ্ক্ষার ছিটেফোঁটা না দেখে ধীরে ধীরে এক হতাশার জন্ম দিচ্ছে। আর এই হতাশা থেকেই মনে হচ্ছে,
আমাদের এখন তিন শূন্য নয়, প্রয়োজন তিন ঐক্যের।

প্রথমত, সংস্কার ঐক্য।

আমাদের সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে প্রয়োজন সংস্কার বিষয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছে যাওয়া। ‘সংস্কার’ আর ‘উন্নয়ন’ শব্দ দুটির চরিত্র একই। কারণ সর্বজন গৃহীত এর কোনও প্যারামিটার নেই। দুটি কাজই একটি চলমান এবং অনন্ত প্রক্রিয়া। যেমন, যদি বলি বাংলাদেশের গণতন্ত্র সংস্কার করবো, তাহলে প্রশ্ন আসে এর মানদণ্ড কী হবে? কোন লেভেল পর্যন্ত সংস্কার করবো?

ভালো কথা, মানদণ্ড যদি হয় ওয়েস্টমিনস্টারের গণতন্ত্র, তাহলে আমাদের প্রয়োজন চার শত বছর। যদি বলি, শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার করবো, মানদণ্ড হবে ফিনল্যান্ডের সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থার মতো। তাহলে আমাদের সময় লাগবে প্রায় একশত বছর। অথচ একদল মানুষ সংস্কার সংস্কার বলে গলা ফাটিয়েই যাচ্ছে। আর আমরা সাধারণ মানুষ, সেই ঘরপোড়া গরু মতো সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পাই, আবার না এই সংস্কারের ভিতরে উন্নয়নের বিদেহী আত্মা ভর করে। তাই এই সংস্কার নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের একটা ঐক্য প্রয়োজন। কী কী সংস্কার হবে? কতটুকু সংস্কার হবে?

দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক ঐক্য।

একটি রাজনৈতিক দলের ধীরে ধীরে ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠা পৃথিবীতে নতুন কিছু নয়। ইতালির বেনিতো মুসোলিনির ‘ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টি’ থেকে শুরু করে বর্তমান যুগে হাঙ্গেরির ‘ফিদেজ পার্টি’, কিংবা রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনের ‘ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টি’ ধীরে ধীরে ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

আওয়ামী লীগের গত ১৫ বছর তার অরাজনৈতিক আচরণ আমাদের রাজনীতি নিয়ে ভিন্নভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। ফ্যাসিস্টের অত্যাচার, নিপীড়ন, খুন, গুম এবং সর্বশেষ সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি করে হত্যা, এসব দাগ মুছতে অনেকটা সময় লাগবে এই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের। রাজনীতির ডান-বাম বুঝে না সাধারণ মানুষ, তারা চায় গণমুখী রাজনীতি। আবার বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিয়ে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে, বাংলাদেশের সংস্কৃতি নিয়ে কিছু অবিশ্বাসী রাজনৈতিক দল বিষয়টিকে আরও জটিল করে গড়ে তুলছে। তাই দল ডান হোক আর বাম হোক, জাতীয় স্বার্থের বিষয়ে এক থাকা এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। প্রয়োজন ‘সবার আগে বাংলাদেশ’ নীতি অনুসরণ করা।

তৃতীয়ত, নির্বাচনি ঐক্য।

আমার যদি গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের শাসন দেখি, তাহলে দেখবো শুধু নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণ করতেই একে একে ধ্বংস করা হয়েছে সরকারের সব বিভাগকে। প্রথমেই আইন বিভাগ, তারপর বিচার বিভাগ, এবং সবশেষে নির্বাহী বিভাগ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে। এসব নির্বাচনকে বৈধতা দিতে তৈরি করা হয়েছিল পোষ্য গণমাধ্যম। আর এই নির্বাচন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই ফ্যাসিজম পাকাপোক্ত করেছিল আওয়ামী লীগ। সুতরাং একটি একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই দিতে পারে একটি সুস্থ গণতন্ত্র।

গণতন্ত্র যত দ্রুত সুস্থ হবে, সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষার জায়গাটি তত মজবুত হবে। আর বন্ধ হয়ে ফ্যাসিস্টের দরজা। এই সাধারণ বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ‘নির্বাচন’ নিয়ে ঐকমত্যের প্রয়োজন রয়েছে।

যে স্বপ্নের বিপুল সম্ভার নিয়ে ৫ আগস্ট সংগঠিত হলো বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, একটি সফল গণঅভ্যুত্থান, সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে তিনটি ঐক্যের কোনও বিকল্প নেই। তাই ‘তিন শূন্যে’র আগে আমাদের এখন পৌঁছাতে হবে ‘তিন ঐক্যে’।

লেখক: নির্মাতা ও ব্রডকাস্টার।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews