মন খারাপ হওয়া জীবনের একটি স্বাভাবিক অংশ। জীবনের বিভিন্ন ঘটনা, চাপ বা নির্দিষ্ট পরিস্থিতি থেকে আমরা সবাই কোনো না কোনো সময়ে মন খারাপ অনুভব করি। কিন্তু, মন খারাপ মানেই মানসিক রোগ নয়। এটি একটি খুব সাধারণ আবেগ, যা সময়ের সাথে সাথে দূর হতে পারে। গবেষণা বলছে, আমাদের মনের অবস্থা পরিবর্তনশীল এবং সঠিক যত্ন ও পদক্ষেপের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই লেখায়, আমরা মন খারাপের সাধারণ কারণ এবং তা কাটিয়ে ওঠার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করবো।
মন খারাপ হতে পারে অনেক কারণেই। ব্যক্তিগত জীবনের কোনো সমস্যা, পেশাগত চাপ, স্বাস্থ্যগত অসুবিধা, সম্পর্কের টানাপোড়েন বা জীবনের অন্য সংকটের কারণে মন খারাপ হতে পারে। 'ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন' (WHO) ২০১৭ সালের একটি রিপোর্টে জানায় যে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ২৬৪ মিলিয়ন মানুষ কোনো না কোনো সময়ে মন খারাপের অভিজ্ঞতা লাভ করেন। তবে, এর মানে এই নয় যে তারা মানসিকভাবে অসুস্থ। এটি কেবল একটি মানসিক অবস্থা, যা বিভিন্ন কারণ দ্বারা প্রভাবিত হয়।
মন খারাপ একটি অত্যন্ত সাধারণ আবেগ এবং এটি কোনো মানসিক রোগ নয়। আমরা সবাই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে মন খারাপ অনুভব করি। তবে, সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এটি সহজেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। প্রিয়জনের সাথে সময় কাটানো, পছন্দের গান শোনা, শারীরিক ক্রিয়াকলাপ করা, হাসা এবং প্রকৃতির সান্নিধ্যে যাওয়া এই পদ্ধতিগুলো খুবই কার্যকর।
বিভিন্ন সময়ে আমাদের মন খারাপ হতেই পারে। তবে, এটি মানসিক রোগ নয়। মন খারাপ একটি খুব সাধারণ আবেগ, যা কখনো স্বল্পমেয়াদি এবং কখনো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। আমেরিকান সাইকোলজিকাল অ্যাসোসিয়েশনের (APA) মতে, মন খারাপ হলো এক ধরনের মৃদু মানসিক চাপ যা কিছু সময়ের জন্য আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত করে রাখে। তবে, এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ঠিক হয়ে যায়। ২০২০ সালে 'হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল' প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, মনের যত্ন নেওয়া এবং সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে এই ধরনের আবেগকে দূর করা সম্ভব।
আমাদের মনের ওপর আমাদের পরিবেশ ও অভ্যাসের বিশাল প্রভাব আছে। নিচে কয়েকটি পদ্ধতি দেওয়া হলো, যা মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মন ভালো করতে সাহায্য করতে পারে:
১. প্রিয়জনের সাথে সময় কাটানো: 'ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান'র এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রিয়জনের সাথে সময় কাটানো আমাদের মস্তিষ্কের অক্সিটোসিন নিঃসরণ বৃদ্ধি করে, যা আমাদের মনকে ভালো করতে সাহায্য করে। বন্ধু বা পরিবারের সদস্যের সাথে দেখা করুন, কথা বলুন, বা শুধু একসাথে সময় কাটান। এমনকি তাদের সাথে টেলিফোনে বা ভিডিও কলে কথা বলাও মানসিকভাবে প্রশান্তি দেয়। কোনোভাবেই প্রিয়জনকে এড়িয়ে চলবেন না। তাদের সাথে আপনার মনের অবস্থা শেয়ার করুন।
২. পছন্দের গান শোনা: সংগীত আমাদের মনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। ‘জার্নাল অব নিউরোসায়েন্স’র ২০১৩ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, পছন্দের গান শুনলে মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয়, যা আমাদের মন ভালো করতে সাহায্য করে। আপনি যদি খুব মন খারাপ অনুভব করেন, তবে আপনার পছন্দের গান শুনুন। গানের সুর এবং কথাগুলো আপনার মস্তিষ্কে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আপনার মন ভালো হতে শুরু করবে।
৩. শারীরিক ক্রিয়াকলাপ বা হালকা ব্যায়াম: শারীরিক ক্রিয়াকলাপ শুধু শরীরের জন্যই ভালো নয়, এটি মনের জন্যও অত্যন্ত উপকারী। 'আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন' এর মতে, শারীরিক ব্যায়াম আমাদের শরীরে এন্ডোরফিন নিঃসরণ করে, যা আমাদের মনকে শান্ত এবং আনন্দিত রাখে। যদি আপনার মন খারাপ হয়, তাহলে চোখে-মুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিন বা একটু হাঁটুন। শারীরিকভাবে সক্রিয় হলে আপনার মন তাড়াতাড়ি হালকা হয়ে আসবে।
৪. হাসুন, যতটুকুই সম্ভব: হাসি আমাদের মনের জন্য একটি প্রাকৃতিক ওষুধ। ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ’র (NIH) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, হাসি আমাদের মস্তিষ্কে সেরোটোনিন ও ডোপামিনের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে, যা মনকে প্রশান্তি দেয়। এমন কিছু দেখুন বা শুনুন যা আপনাকে হাসায়। এই হাসি আপনার মন খারাপের মেঘ সরিয়ে এক নতুন অনুভূতি এনে দেবে।
৫. প্রকৃতির সান্নিধ্যে যান: প্রকৃতির সাথে সংযোগ স্থাপন আমাদের মন ভালো করার একটি প্রমাণিত উপায়। ‘ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনা’র একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, খোলা বাতাসে সময় কাটালে এবং প্রকৃতির মাঝে হাঁটাহাঁটি করলে আমাদের মানসিক চাপ কমে যায় এবং মনের প্রশান্তি বৃদ্ধি পায়। যখন আপনি খোলা বাতাসে হাঁটবেন এবং গভীর শ্বাস নেবেন, তখন আপনার মন ভালো হয়ে যাবে।
মন খারাপের ওপর বিভিন্ন গবেষণা ও তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালের ‘মেন্টাল হেলথ ফাউন্ডেশন’ এর গবেষণায় বলা হয়েছে, ৬৪ শতাংশ ব্রিটিশ নাগরিক তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে মন খারাপের অনুভূতি পেয়েছেন। এই গবেষণা থেকে বোঝা যায় যে, মন খারাপ খুবই সাধারণ এবং এটি জীবনযাপনের একটি অংশ। তবে, যেহেতু এটি মানসিক চাপের প্রতিফলন হতে পারে, তাই আমাদের এটি মোকাবিলা করার জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
মন খারাপ একটি অত্যন্ত সাধারণ আবেগ এবং এটি কোনো মানসিক রোগ নয়। আমরা সবাই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে মন খারাপ অনুভব করি। তবে, সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এটি সহজেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। প্রিয়জনের সাথে সময় কাটানো, পছন্দের গান শোনা, শারীরিক ক্রিয়াকলাপ করা, হাসা এবং প্রকৃতির
সান্নিধ্যে যাওয়া এই পদ্ধতিগুলো খুবই কার্যকর। তাই, পরবর্তীতে যখন আপনার মন খারাপ হবে, তখন এই পদ্ধতিগুলোর কোনটি অনুসরণ করুন এবং পাঁচ মিনিটেই মন ভালো হয়ে যাবে।
লেখক: দি আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এএসএম