ছবির উৎস, ABRAR FAHAD/FACEBOOK
ছবির ক্যাপশান,
বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতের দেয়া ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রেখে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট।
১১ মিনিট আগে
বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতের দেয়া ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রেখে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে আবরারের পরিবার ও রাষ্ট্রপক্ষ।
রোববার এ রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন নিহত আবরারের বাবা ও ভাই।
এছাড়া দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের পরিবারের স্বজনরাও আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
রায়ের পরে এক সংবাদ সম্মেলনে আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ বলেন, " যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের র্যাগিং আছে সেটা অবশ্যই আমরা পরিবর্তন চাই। যাতে ছাত্ররা ভালোভাবে বসবাস করতে পারে। ভবিষ্যতে যাতে আর এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সেটা সবার কাছে আবেদন জানাই।"
এ রায় দ্রুত বাস্তবায়ন করে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য অনুরোধ করেছেন নিহত আবরারের ভাই আবরার ফাইয়াজ।
অপরদিকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামির আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু এ রায়ে সংক্ষুব্ধ বলে জানিয়েছেন।
রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন মি. দুলু।
এদিকে, আবরার ফাহাদের মৃত্যু এ জাতির জীবনে 'থাই পাহাড়ের মতো ভারী' হয়ে আছে বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
২০১৯ সালের ৬ই অক্টোবর দিবাগত রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মীর নির্যাতনে নিহত হন আবরার ফাহাদ।
বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন নিহত ফাহাদ।
ছবির ক্যাপশান,
২০১৯ সালের ৬ই অক্টোবর দিবাগত রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মীর নির্যাতনে নিহত হন আবরার ফাহাদ।
প্রায় চার বছর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বিচারিক আদালতের রায়ে এ মামলায় ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।
বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন), জেল আপিল ও আপিলের ওপর শুনানি নিয়ে গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রেখেছিলেন মামলাটি।
রোববার সকালে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ বিচারিক আদালতের দেয়া দণ্ড বহাল রেখে রায় ঘোষণা করে।
বিচারিক আদালতে যেসব আসামি দণ্ড পেয়েছেন তারা সবাই বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত নেতা-কর্মী। হাইকোর্টেও সকলে মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে।
মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা আসামিরা হলেন মেহেদী হাসান রাসেল, মো. অনিক সরকার, মেহেদী হাসান রবিন, ইফতি মোশাররফ সকাল, মো. মনিরুজ্জামান মনির, মো. মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মো. মাজেদুর রহমান মাজেদ, মো. মুজাহিদুর রহমান, খন্দকার তাবাককারুল ইসলাম তানভীর এবং হোসাইন মোহাম্মদ তোহা।
এছাড়া মো. শামীম বিল্লাহ, এ এস এম নাজমুস সাদাত, মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম, মুনতাসির আল জেমি, মো. শামসুল আরেফিন রাফাত, মো. মিজানুর রহমান, এস এম মাহমুদ সেতু, মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল জিসান, এহতেশামুল রাব্বি তানিম এবং মুজতবা রাফিদেরও মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে।
আর যে পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রয়েছে তারা হলেন মুহতাসিম ফুয়াদ হোসেন, মো. আকাশ হোসেন, মুয়াজ আবু হুরায়রা, অমিত সাহা এবং ইশতিয়াক আহমেদ মুন্না।
এ মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের সময় তিন জন আসামি পলাতক ছিলেন।
তারা হলেন মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল জিসান, এহতেশামুল রাব্বি তানিম এবং মুজতবা রাফিদ।
তবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরেক আসামি মুনতাসির আল জেমি গত ছয়ই অগাস্ট গাজীপুরের হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের দেয়াল ভেঙে পালান।
এ বছরের ২৫শে ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কারা কর্তৃপক্ষ এ তথ্য জানিয়েছে।
বিচারিক আদালত আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় যেসব পর্যবেক্ষণ ও ভিত্তি স্থাপন করেছিলো সেগুলো বহাল রেখেছে হাইকোর্ট।
বিচারিক আদালতের রায়ে পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিলো, 'দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা একজনও ঘটনার সময় ফাহাদকে আঘাত করতে বাধা দেয়নি। তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি।"
ছবির ক্যাপশান,
আবরার ফাহাদের মৃত্যুর ঘটনায় বুয়েট জুড়ে তীব্র আন্দোলন হয়েছিল
রায়ের পর নিহত আবরারের ভাই আবরার ফাইয়াজ এতো দ্রুত একটি বড় রায় হওয়াতে কৃতজ্ঞতা জানান।
সাড়ে পাঁচ বছর ধরে এ হত্যা মামলার বিচার চাওয়া নিয়ে পড়ে আছেন জানিয়ে মি. ফাইয়াজ দ্রুত রায়ের বাস্তবায়ন হবে বলে আশাপ্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, "এটা যত দ্রুত শেষ হবে, এটা একটা দৃষ্টান্ত হিসেবেই উপস্থাপন হবে যাতে ভবিষ্যতে আর কারো যাতে এ ধরনের পরিণতি না হয়। সেজন্য বাকি স্টেপগুলো যাতে দ্রুত শেষ হয় সেটাই আমার চাওয়া।"
সরকার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে মি. ফাইয়াজ বলেন, "আর কোন শিক্ষার্থীর যাতে ক্যাম্পাসে আবরার ফাহাদের মতো পরিণতি না হয়।"
এ হত্যা মামলার একজন আসামী পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় হতাশা প্রকাশ করেন মি. ফাইয়াজ।
তিনি বলেন, "এ বিষয়টা সম্পূর্ণই আমাদের জন্য হতাশার। কারণ আমরা আসলে অপেক্ষায় আছি কবে এদের রায় কার্যকর হবে। এর মধ্যে হঠাৎ করে জানতে পারতেছি একজন পালিয়ে চলে গেছে"।
"সে এমন একজন যে আবরারকে রুমে ডেকে নিয়ে গেছে এবং মারার সময় উপস্থিত ছিল। ওই সময়ে অনেকেই পালিয়ে চলে গেছে, কিন্তু সেই জিনিসটা কেন লুকিয়ে রাখা হলো, ইভেন কেন ছয় মাস পরে জানানো হলো এ বিষয়ে পরিষ্কার উত্তর এখনো পাইনি" বলেন মি. ফাইয়াজ।
আবরার ফাহাদকে স্বাধীনতা পদক দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান দেয়ার ঘোষণায় অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন আবরাহ ফাহাদের পিতা বরকত উল্লাহ।
শিক্ষার্থীরা যাতে খারাপ রাজনীতির সাথে না জড়ায় সে আহ্বান জানিয়ে বরকত উল্লাহ বলেন, "কারো বাবা - মা সন্তানকে খারাপ শেখায় না। কষ্ট করে পড়ালেখা শেখানোর জন্য পাঠিয়েছে।শিক্ষার্থীদের কাছে আবেদন করবো তারা যাতে খারাপ রাজনীতির সাথে না জড়ায়।"
ছবির ক্যাপশান,
আবরার ফাহাদের মৃত্যুর ঘটনায় বুয়েটের বাইরেও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ হয়েছে
অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান হাইকোর্টের এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
রায়ের পর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, " আমরা মনে করি আবরার ফাহাদের বাবা ন্যায়বিচার পেয়েছেন। গোটা জাতি ন্যায়বিচার পেয়েছে। এ ধরনের রায়ের মধ্য দিয়ে একটি রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনার জন্য, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য বিচার বিভাগের যে ধারণা, সে ধারণাটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আবারও।"
এ রায়ের মধ্যে দিয়ে সমাজের কাছে একটা বার্তা দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
তিনি বলেন, " আপনি যত শক্তিশালীই হন না কেন, আপনার পেছনে যত শক্তিই থাকুক না কেন, সত্য ও ন্যায়বিচার একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে।"
"এ রায়ের বার্তা হলো আইনের গণ্ডির মধ্যে থেকেই মানুষকে চলতে হবে, মনুষ্যত্ব জাগরণ করতে হবে " বলেন মি. আসাদুজ্জামান।
আবরার ফাহাদের এ মৃত্যু গোটা জাতির মূল্যবোধের শেকড়ে নাড়া দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
তিনি বলেন, "এ মৃত্যু এক্সপোজ করেছে রাজনৈতিক ফ্যাসিজম কিভাবে দিনে দিনে বাড়তে পারে।"
ফ্যাসিজমের প্রতি সাধারণ জনগণের প্রতিক্রিয়ার কারণেই এ হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এই আইন কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, "আবরার ফাহাদ জীবন দিয়ে অসংখ্য, অগণিত আবরার ফাহাদের জীবন রক্ষা করে গেছে। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ একটা নতুন জীবন পেয়েছে।"
ছবির উৎস, Getty Images
ছবির ক্যাপশান,
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট
হাইকোর্টের এ রায়ের পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামির আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু এ রায়ে সংক্ষুব্ধ বলে জানিয়েছেন।
রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন মি. দুলু।
এ মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ইশতিয়াক আহমেদ মুন্নার আইনজীবী সৈয়দ মিজানুর রহমান জানান, রাতে ফাহাদকে যখন নির্যাতন করা হয় তখন তার মক্কেল ঢাকায় ছিলেন না।
ঘটনার পরদিন ভোরে সিলেট থেকে তিনি বুয়েটের শেরেবাংলা হলে পৌঁছান। এ বিষয়টি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং আরেকজন অভিযুক্তের সাক্ষীতে রয়েছে বলে জানান এই আইনজীবী।
রায়ে সংক্ষুব্ধ হওয়ায় আপিল করবেন বলে তিনি জানিয়েছেন।