সাপের ফণার মতো ফুল। ছবিটি আজিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ থেকে তোলা

সাপের ফণার মতো ফুল। ছবিটি আজিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ থেকে তোলা

নাগলিঙ্গম। দুর্লভ একটি বৃ। এর ফুল বেশ আকর্ষণীয়, মনোরম।
অদ্ভুত সুন্দর এ ফুলের পরাগচক্র দেখতে অনেকটা সাপের ফণার মতো। ধারণা করা হয়, এ কারণেই এ ফুলের নাম নাগলিঙ্গম।
বেশির ভাগ উদ্ভিদের ফুল শাখায় ফুটলেও নাগলিঙ্গমের ফুল ফুটে গাছের গুঁড়িতে। গুঁড়ি ফুঁড়ে বের হয় ছড়া। তারপর শত শত ফুল। ফুলভর্তি গাছ দেখলে মনে করতেই পারেন, কেউ বুঝি গাছের কাণ্ড ছিদ্র করে ফুলগুলোকে গেঁথে দিয়েছেন।
নাগলিঙ্গমের ফুল গাঢ় গোলাপি, সেই সাথে হালকা হলুদ রঙের মিশ্রণ। পাপড়ি ছয়টি, পাপড়ি গোলাকার কুল্লিপাকানো। যেন ফণা তোলা সাপ। ফুলগুলো বেশ বড় বড়। এক কথায় দেখতে অসাধারণ!
নাগলিঙ্গম সৌরভের জন্যও সেরা। কী দিন, কী রাত, নাগলিঙ্গম গাছের পাশ দিয়ে গেলে এর তীব্র ঘ্রাণের মাদকতা আপনাকে কাছে টানবেই। বিরল প্রজাতির এই ফুলের সৌরভে রয়েছে গোলাপ আর পদ্মের সংমিশ্রণ। দ্বিজেন শর্মা তার শ্যামলী নিসর্গ বইয়ে লিখেছেন, ‘আপনি বর্ণে, গন্ধে, বিন্যাসে অবশ্যই মুগ্ধ হবেন। এমন আশ্চর্য ভোরের একটি মনোহর অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই অনেক দিন আপনার মনে থাকবে।’
নাগলিঙ্গম ফুল সারা বছর ফুটলেও গ্রীষ্মকাল হচ্ছে নাগলিঙ্গম ফোটার আসল সময়। শীত এবং শরৎকালে গাছে অপোকৃত কম ফুল ফুটে।
এই গাছে ফুল ধরার পর বেলের মতো গোল গোল বড় আকারের ফল ধরে। এগুলো হাতির খুবই প্রিয় খাবার। এ জন্য আমাদের দেশে এটিকে হাতির জোলাপ গাছ বলা হয়। ফল হুবহু কামানের গোলার মতো হওয়ায় ইংরেজদের কাছে এ গাছের নাম ‘ক্যাননবল’। অর্থাৎ কামানের গোলা!
ফল পরিপক্ব হতে প্রায় এক বছর সময় নেয়। পরিপক্ব ফল মাটিতে পড়লে ফেটে যায়। বাতাসে খানিকটা ঝাঁঝালো গন্ধ সৃষ্টি হয়। ফল মূলত পশু পাখির খাবার। আমাদের জন্য এ ফল অখাদ্য, এমনকি তির কারণও হতে পারে। তবে আমাজান বনের সামান জনগোষ্ঠীর কাছে এটি একটি প্রিয় খাবার! তাদের বিশ্বাস পুরুষত্ব বৃদ্ধিতে নাকি এ ফল বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে!
নাগলিঙ্গমের গাছ ৩৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। কাণ্ডও বেশ মোটা। গুচ্ছ পাতাগুলো খুব লম্বা, সাধারণভাবে ২৮ থেকে ৩১ সেন্টিমিটার, কিন্তু ৫৭ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বায় পৌঁছতে পারে। গাছের বাকলের রং ধূসর এবং অসমান। আমাদের দেশে অনেকেই এই গাছকে নাগেশ্বর বলে জানেন। নাগেশ্বর কিন্তু নাগলিঙ্গম থেকে একটু আলাদা। নাগলিঙ্গমের আরো দুটি ভিন্ন প্রজাতির নাম হলোÑ নাগেশ্বর এবং নাগকেশর। উল্লেখ্য নাগেশ্বর, নাগকেশর ও নাগলিঙ্গম তিনটি ভিন্ন প্রজাতি।
ফ্রান্সের উদ্ভিদবিদ জে. এফ আবলেট ১৭৫৫ সালে এ গাছের বৈজ্ঞানিক নামকরণ করেন ‘ক্যুরুপিটা গুইয়ানেন্সিস’ (ঈড়ঁৎড়ঁঢ়রঃধ এঁরধহবহংরং)।
নাগলিঙ্গমের আদি নিবাস মধ্য ও দণি আমেরিকায়। পৃথিবীতে এ গাছ এখন বিলুপ্তির পথে। নাগলিঙ্গম গাছের রয়েছে ব্যাপক ঔষধি গুণ। এর ফুল, পাতা ও বাকলের নির্যাস থেকে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ তৈরি হয়। এন্টিবায়োটিক, এন্টিফাঙ্গাল, এন্টিসেপটিক হিসেবে ব্যবহার করা হয় এর নির্যাস। এই গাছ থেকে তৈরী ওষুধ পেটের পীড়া দূর করে। পাতার রস ত্বকের নানা সমস্যায় কাজ দেয়। ম্যালেরিয়া রোগ নিরাময়ে নাগলিঙ্গমের পাতার রস ব্যবহার হয়।
আমেরিকার আমাজান অঞ্চল ও ভেনিজুয়েলার আদিবাসীরা নাগলিঙ্গম ফলের খোসাকে এক সময় বাসন হিসেবে ব্যবহার করত বলে জানা যায়। এর কাঠ থেকে আসবাবও তৈরি হয়।
বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে নাগলিঙ্গম যতেœ রোপণ করা হয়। এ কারণে থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমারের বৌদ্ধমন্দির প্রাঙ্গণে নাগলিঙ্গম গাছ বেশি দেখা যায়।
তিন হাজার বছর আগে থেকেই গাছটি ভারত উপমহাদেশে একটি পবিত্র উদ্ভিদ বলে বিবেচিত হয়ে আসছে।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা শিব পূজায় নাগলিঙ্গম ফুল ব্যবহার করে। ভারতে নাগলিঙ্গমকে ‘শিব কামান’ নামে ডাকা হয়।
বাংলাদেশে হাতেগোনা কয়েকটি নাগলিঙ্গম উদ্ভিদ টিকে আছে। রমনা উদ্যান, কার্জন হল, বলধা বাগান, নটরডেম কলেজ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট ও হবিগঞ্জে দু-একটি গাছ এখনো দেখতে পাওয়া যায়। ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলায় একটি পুরনো গাছ রয়েছে। এ ছাড়া লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এবং চন্দ্রিমা উদ্যানে বিভিন্ন বয়সী কয়েকটি নাগলিঙ্গম গাছ আছে। শ্রীমঙ্গলের চা গবেষণা ইনস্টিটিউট ভবনের ঠিক সামনে রয়েছে বিশাল একটি নাগলিঙ্গম গাছ। বান্দরবান এবং কক্সবাজারের কয়েকটি বৌদ্ধমন্দির প্রাঙ্গণেও এ গাছ দেখা যায়।
কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের আজিমউদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় মাঠের পূর্ব প্রান্তে রয়েছে চারটি বড় নাগলিঙ্গম গাছ। এ গাছগুলো এখন ফুলে-ফলে সুশোভিত। শহরবাসীকে সকাল বিকাল সৌরভে মাত করে রাখছে এ গাছগুলো।
গাছে সাঁটানো তথ্য থেকে জানা যায়, সত্তরের দশকে আজিমউদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের বৃক্ষপ্রেমী প্রধান শিক্ষক প্রয়াত মতিউর রহমানকে তার এক ছাত্র বিদেশ থেকে নাগলিঙ্গমের চারা এনে দিয়েছিলেন। মাঠের পূর্ব প্রান্তে চারা রোপণ করলে সেই গাছের ফল থেকে এখন চারটি গাছ হয়েছে। আজিমউদ্দিন স্কুলের পাশের বাসিন্দা জুনাইদ (৩০) এ প্রতিবেদককে জানান, নাগলিঙ্গমের ফলগুলো খাবার যোগ্য কি না, পরীক্ষা করার জন্য তিনি একবার ফলে কামড় দিয়েছিলেন। সাথে সাথে মুখে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। একপর্যায়ে সমস্ত মুখ ফুলে বিকৃত হয়ে যায়। তিনি আরো জানান, পত্রিকায় নাগলিঙ্গমের গুণাগুণের খবর পড়ে একবার এক ব্যক্তি গাছের পাতা দিয়ে দাঁত মাজেন। সাথে সাথে তার মুখে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। অর্থাৎ, গাছের রস বিষাক্ত বলে তাদের মনে হয়েছে।


















Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews