ঢাকা: একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর (না)পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় মুক্তিযুদ্ধ। সেদিনের বিজয়োল্লাসের কথা আমার মতো প্রবীণদের মানসপটে চিরকাল জ্বলজ্বল করবে, এটাই স্বাভাবিক।



তবে একাত্তর বা একাত্তর-পরবর্তী বছরগুলোর সেই উন্মাদনা আর নেই এই দিবস উদযাপনে। এটাও স্বাভাবিক। কেন স্বাভাবিক? যদি বলি, দেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোক এখন মুক্তিযুদ্ধ নয়, অহরহ পর্যুদস্ত হচ্ছে আরেক যুদ্ধে। সেটা কী? সেটা জীবনযুদ্ধ।

এই মানুষগুলোর কাছে খেয়েদেয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকার যে সংগ্রাম—তার কাছে অন্যসব আনন্দ-উল্লাস বৃথা। অথচ একাত্তর-বাহাত্তরের তুলনায় দেশের সব মানুষের আয় বেড়েছে। গ্রামগঞ্জেও এখন আর আগের মতো খালি গায়ে খালি পায়ে চলাফেরা করতে কাউকে বড় একটা দেখা যায় না। এখন যদি গ্রামের রাস্তায় দেখা পাওয়া কোনো চাচা মিয়াকে বলেন, চাচা, ৫০ বছর আগে আপনার যৌবনকালে আপনি ২০-২৫ টাকা নিয়ে চাল-ডাল কিনতে যেতেন, আর এখন তো মাশাআল্লাহ আপনার পকেটে এক শ-দুই শ টাকা সব সময়ই থাকে।

তাহলে মন খারাপ করেন কেন? জবাব শুনবেন : ‘ভাতিজা, তখন চাউলের সের (কেজি) ছিল পাঁচ টাকা-ছয় টাকা, আর এখন? ১০ টাকা দিয়ে একটি ইলিশ মাছ কিনেছি ওই সময়। আর এখন?’...কথা না বাড়িয়ে আপনি তখন রাস্তা মাপবেন।

পারতে আমাদের হবেই এটা হলো মুদ্রার এক পিঠ। আসুন, অন্য পিঠটাও দেখি। একাত্তরের আগে আট আনা রিকশাভাড়া জোগাড় করতে যাদের দম বেরিয়ে যেত, তাদের অনেকেই এখন বিএমডব্লিউ অথবা মার্সিডিজ দৌড়ান।

আর বেগম সাহেবের জন্য একটি, বাচ্চাদের স্কুলকলেজের ডিউটি করার জন্য একটি, বাজার সদাইয়ের জন্য আরেকটি গাড়ি। শহরের অভিজাত এলাকায় আলিশান বাড়ি, বিদেশেও একাধিক বাড়ি, এগুলো তো আছেই। এত কিছু এলো কোত্থেকে? কেন, জীবনধারণের জন্য যাদের নাভিশ্বাস উঠছে প্রতিনিয়ত, দেশের সেই শতকরা ৮০-৯০ ভাগ মানুষের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেয়ে এরাই তো মোটাতাজা হয়েছেন। স্বাধীনতার পর এরা একেকজন যেন আলাদিনের জাদুর চেরাগ পেয়ে গেলেন, জেনে গেলেন দিনকে রাত এবং রাতকে দিন বানানোর কলাকৌশল। এই প্রক্রিয়ায় দেশ ও দেশের সাধারণ মানুষ বাঁচল কি মরল তাতে যেন তাদের কিচ্ছু যায় আসে না। উন্নয়নের হাতসাফাই দ্বারা তারা বিশ্ববাসীকেও তাক লাগিয়ে দিয়ে অনুন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের নাম কেটে লিখিয়ে ফেললেন উন্নয়নশীল দেশের খেরো খাতায়। আর উন্নয়নের যূপকাষ্ঠে বলির পাঁঠা হলো দেশের সাধারণ মানুষ, চিরকাল যাদের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পর দেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ছিল মাত্র এক শ-দেড় শ ডলার। আজ অর্ধশতাব্দী পর মাশাআল্লাহ তা বেড়ে হয়েছে দুই হাজার ৭৮৪ ডলার। এটা নিয়ে নিশ্চয়ই আমরা গর্ব করতে পারি। তবে একটি দেশের মানুষের গড় আয় থেকে কি সেই দেশের মানুষের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়? বোধ হয়, না। অন্তত আমাদের মতো অর্থনৈতিক বৈষম্য জর্জরিত দেশে তো নয়ই। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টিতে যে শুভংকরের ফাঁক আছে, তা বোঝা যাবে। মনে করুন, একটি হতদরিদ্র বস্তি এলাকায় এক শ লোকের বাস। তাদের সবাই দিন এনে দিন খাওয়া মুটেমজুর শ্রেণির মানুষ। তাদের কেউ রিকশাওয়ালা, কেউ সদরঘাটের কুলি, কেউ দিনমজুর। এদের কারো মাসিক আয় ধরা যাক ছয়-সাত হাজার টাকার বেশি নয়। কিন্তু এদেরই একজন এক রাজনৈতিক নেতার মিটিং-মিছিলে চোঙা ফুঁকে, মাস্তানি করে মাসে লাখ পাঁচেক টাকা উপার্জন করে। সেই কালো টাকার ঠাটবাট তার চলনে-বলনে সব সময় দেখা যায়। সে আর কুঁড়েঘরে থাকে না, ওই বস্তিতেই সে নজরকাড়া পাকা ঘর বানিয়ে বউ-বাচ্চা নিয়ে থাকে। এখন যদি ওই বস্তির সব মানুষের মাসিক আয় হিসাব করে বলা হয় এদের মাথাপিছু গড় আয় ১২ হাজার টাকা, তাহলে নিশ্চয়ই সেটা হবে ভুল হিসাব। কারণ ওই মাস্তান সাহেবের একার আয়ের অঙ্ক অন্য সব গরিবের আয়কে টেনে ওপরে তুলে দিয়েছে, যার ফলে মাথাপিছু আয়ের অঙ্কও গেছে বেড়ে। বাংলাদেশের সব সম্পদের মালিক যে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ—কেউ বলেন তাদের সংখ্যা শতকরা পাঁচ, কেউ বলেন আরো কম—তাদের হাজার হাজার কোটি টাকার আয় বাকি সব মানুষের আয়কে টেনে এমন উচ্চতায় নিয়ে যায় যে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয়ের সংখ্যাটা রীতিমতো ভদ্রসম্মত দেখায়। অথচ বাস্তব চিত্রটা হচ্ছে ধনী-গরিবের আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বৈষম্য এত বেশি যে এদের একের আয়-ব্যয়ের পরিসংখ্যান অন্যের পরিসংখ্যানের সঙ্গে মেলাতে গেলেই ভুল তথ্য আসতে বাধ্য।

আসলে আমরা কথাবার্তায়, লেখালেখি, তর্কাতর্কিতে যাদের সাধারণ মানুষ বলি, তারাই এ দেশের বিশাল মেজরিটি। দেশে যদি একটি অবাধ, সুষ্ঠু, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে এই সাধারণ মানুষই নির্ধারণ করবে কে জিতবে আর কে হারবে। এই মানুষগুলো হয়তো রাজনীতিতে তেমন সক্রিয় ভূমিকা পালন করে না, হয়তো কোনো দলের সদস্য, এমনকি সমর্থকও তারা নয়, কিন্তু দিনশেষে ইংরেজিতে যাকে বলে ‘সাইলেন্ট মেজরিটি’ তারা তাই। এদের মধ্যে যারা আবার হতদরিদ্র, অশিক্ষিত, আনপড়, বস্তিতে কিংবা ফুটপাতে-গাছতলায় যাদের জীবন কাটে, তাদের খবরই তো কেউ রাখে না। তবে হ্যাঁ, যেহেতু তাদের একটি ভোট এবং একজন কেউকেটা হুজুরের একটি ভোট মূল্যমানের দিক থেকে সমান, অতএব ভোটটি বাক্সে না পড়া পর্যন্ত ওই মানুষটি ভোটপ্রার্থীর কাছে রীতিমতো ভিআইপি। ভোট শেষ তো খায়খাতিরও শেষ। ভোটের ডামাডোল শেষে ভোটপ্রার্থী ফিরে যাবেন তার নিজস্ব পরিমণ্ডলে, আর সলিমদ্দি তার বস্তিতে বা গাছতলায়। দুটি মানুষের জীবন চলার পথ, তাদের কর্মক্ষেত্র ইত্যাদি ভিন্ন। অথচ তারা এক দেশের, এক শহর বা এক এলাকার বাসিন্দা। এটা শুধু বাংলাদেশ বলে নয়, পৃথিবীর ধনী-গরিব সব দেশেই এই পার্থক্যটা আছে। কোথাও কম, কোথাও বেশি। এটাই সৃষ্টির বৈচিত্র্য। বলা হয়, এই বৈচিত্র্যেই নাকি স্রষ্টার আনন্দ। হতে পারে। কিন্তু তাই বলে কি দুটি মানুষের জীবনধারার মধ্যে এত পার্থক্য থাকবে? একজন প্রাসাদোপম বালাখানায় শুয়ে-বসে দিনরাত ব্যস্ত থাকবে তার অপরিমেয় ঐশ্বর্যের হিসাব মেলাতে, আর আরেকজন একই এলাকায় বস্তির ঝুপড়িতে বিনিদ্র রাত কাটাবে আগামীকাল আণ্ডাগণ্ডাদের কী খাওয়াবে সেই চিন্তায়।

তবে বস্তিবাসী না হয়ে সেই চালচুলাহীন মানুষটি যদি হয় ফুটপাত বা গাছতলাবাসী, ইহজগতে যদি তার আপন বলতে কেউ না থাকে, তবে তার রাত কাটে কীসের চিন্তায়? সে কি সারা রাত আদৌ দুই চোখের পাতা এক করতে পারে? এই যে চারদিকে এত হৈ-হুল্লোড়, এত যে জীবনের জয়গান, এগুলো কি তাকে স্পর্শ করতে পারে এতটুকু?

হঠাৎ এই প্রহেলিকাময় প্রশ্নটি আমাকে বিচলিত করেছিল গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের রাতে। রাত তখন প্রায় ১২টা। আমি উত্তরায় আমার ছোট বোনের বাসায় ভূরিভোজ শেষে ফিরছিলাম ধানমন্ডিতে আপন বিবরে। সচরাচর এই পথটুকু ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পাড়ি দেওয়া যায়। কিন্তু সেদিন ছিল পথে ভীষণ যানজট। পুরো মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ছিল বন্ধ। ওখানে একটি বিরাট কনসার্টের আয়োজন করেছে কিছু উৎসাহী মানুষ। একে তো গান-বাজনা, তার ওপর ফ্রি। অতএব উৎসবপাগল বাঙালিকে আর পায় কে। সেদিন ছিল পৌষের শুরু। এই সময়টাতে একটু শীত শীত ভাব থাকে, তবে ঠিক জাঁকিয়ে শীত আসে না। কিন্তু এবার ছাত্র-জনতার বাঁধভাঙা আনন্দ-উল্লাসে শরিক হতেই যেন শীত এসে পড়েছে একপ্রকার বিনা নোটিশেই। এতে ধনিক শ্রেণির পুরুষ-মহিলারা মনে মনে খুশি। তারা তাদের লেটেস্ট ডিজাইনের শীতের পোশাকগুলো প্রদর্শনের একটি আগাম সুযোগ পেয়ে গেল। কিন্তু ‘ফুটপাতে শুয়ে মোদের রাতি কাটে’ (একটি পুরোনো গানের কলি)—এই যাদের অবস্থা, তারা যেন হঠাৎই ধরা খেয়ে গেল। একে তো জাকাতের কাপড় পাওয়ার এখনো অনেক দেরি, তার ওপর কোনো দালানের নিচে বারান্দা ঘেঁষে শোয়ার ব্যবস্থাও হয়নি। অতএব? অতএব ফুটপাত, না হয় গাছতলাই ভরসা।

ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের এক প্রান্তে লেকের ওপর যে ব্রিজ, সেখানে এসে ছোট্ট একটু যানজটের জন্য গাড়ির গতি কমাতে হলো। গাড়ির জানালার কাচের ভেতর দিয়ে বাইরে তাকাতেই চমকে উঠলাম। ব্রিজের দুই পাশে অপরিসর ফুটপাতে লম্বালম্বি হয়ে ঘুমাচ্ছে কয়েকজন নারী-পুরুষ। তাদের কারো গায়েই চাদর বা ওই জাতীয় কিছু নেই। শীতের আক্রমণ বা রাস্তার কোলাহল কিছুই তাদের নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে বলে মনে হলো না।

অদূরবর্তী মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের কনসার্টের আয়োজনকারী তরুণরা জুলাই-আগস্ট ’২৪-এ জাতিকে একটি নতুন স্বাধীনতা উপহার দিয়েছে। এবারের বিজয় দিবস এসেছে নতুন আঙ্গিকে। দীর্ঘদিনের নির্যাতন-নিপীড়ন, লাঞ্ছনা-বঞ্চনার পর জাতি আবার নতুন করে অনেক আশা-উদ্দীপনা নিয়ে পথ চলতে শুরু করেছে। তাদের এই পথচলায় পৌষের ফুটপাতে রাতযাপনকারী মানুষগুলো কি সঙ্গী হতে পারবে? হয়তো আজই পারবে না, কিন্তু আগামী দিনে কি সেই সুদিন আসবে না? আমরা অবশ্যই আশা করব, আসবে। তা না হলে আগস্টে পাওয়া নতুন স্বাধীনতা, আল্লাহ না করুন, অর্থহীন হয়ে পড়বে।

তবে হ্যাঁ, আগে চাই জাতীয় ঐক্য, যে ঐক্য একাত্তরে সমগ্র জাতিকে ইস্পাতকঠিন বন্ধনে আবদ্ধ করেছিল। আমরা তখন পেরেছি, এখন কেন পারব না? নিশ্চয়ই পারব, ইনশাআল্লাহ।

লেখক : সাবেক সচিব, কবি

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০২৪

এসআইএস



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews