পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য আনা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বড় চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের স্বার্থে সাংঘর্ষিক অবস্থার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করায় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এছাড়া ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খানিকটা রিভিজিট করতে হচ্ছে। উপদেষ্টা মনে করেন, বিদেশে পাচার করা অর্থের পুরোটা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে পাচারের অর্থ আংশিক ফেরত আনা সম্ভব হবে। অর্থ পাচারকারীদের এ বার্তা দেওয়া হবে যে, অর্থ পাচার করলেই তা ভোগ করা সম্ভব নয়। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ে তার দপ্তরে যুগান্তরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি এ সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্রনীতির নানা দিক নিয়ে খোলামেলা অভিমত তুলে ধরেন। যুগান্তরের সঙ্গে তার সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত প্রশ্নোত্তর আকারে তুলে ধরা হলো-
যুগান্তর : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসাবে আপনার অগ্রাধিকার কী কী?
মো. তৌহিদ হোসেন : দেখুন, আমি পররাষ্ট্র উপদেষ্টাবিষয়ক উপদেষ্টা বটে; তবে আমি কিন্তু একটি টিমের সদস্য। এ টিমের যা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, সেই টিমের অংশ হিসাবে আমাকে সেভাবে কাজ করতে হবে। আপনারা খুব ভালো করেই জানেন, একটা বিপ্লবের মাধ্যমে এ সরকার এসেছে। ছাত্র ও তরুণ সমাজ এ বিপ্লব সম্পন্ন করেছেন। তারা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অনুরোধ করেছেন দায়িত্ব নিতে। তিনি অনুরোধ গ্রহণ করে দায়িত্ব নিয়েছেন এবং আমাদের তার সঙ্গে থাকতে বলেছেন। দেশে প্রচুর সংস্কারের প্রয়োজন। সেই সংস্কারগুলো করতে হবে। এ সংস্কার সাধনের জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং আমরা তার সঙ্গে কাজ করছি। সংস্কার রাজনীতির ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষেত্রে এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে-সব ক্ষেত্রে করতে হবে। সবাই উপলব্ধি করছেন এবং সবাই চান সেটা। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বৈদেশিক সম্পর্কের দৈনন্দিন যেসব কাজ হচ্ছে, সেটা আমরা করছি। এছাড়া আরও কিছু বিষয় আছে। আন্তর্জাতিক অনেক সংগঠন আছে, যারা আমাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ সরকারের যেসব লক্ষ্য নির্ধারিত করা হয়েছে, এর সঙ্গেও তাদের প্রচুর সম্পর্ক আছে। লক্ষ করে দেখবেন, সরকারের যে উপদেষ্টামণ্ডলী রয়েছে, তার মধ্যে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন এবং করছেন-এমন একাধিক ব্যক্তি রয়েছেন। এ সরকারের লক্ষ্য মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা। আমাদের এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। অনেককে বিচারবহির্ভূত হত্যা করা হয়েছে। প্রায় নির্বিচারে এসব কর্মকাণ্ড হয়েছে। এ লঙ্ঘন যাতে সামনে আর হতে না পারে। প্রচুর মানুষ গুম হয়েছে। সামনে যাতে এটাও হতে না পারে। এ সরকারের প্রথমদিকের কাজগুলোর একটি হলো গুমবিষয়ক কনভেনশনে পার্টি হওয়া। সেই ইনস্ট্র–মেন্ট এরই মধ্যে জমা দেওয়া হয়ে গেছে। এটা আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের খুবই প্রশংসিত হয়েছে। তবে শুধু আন্তর্জাতিক প্রশংসার জন্য নয়; আমাদের নিজেদের দায়বদ্ধতার ‘পয়েন্ট অব ভিউ’ থেকেও এটা এসেছে। আমাদের দেশের মানুষ চায় না যে, মানুষ এভাবে গুম হয়ে যাক, মানুষের অস্তিত্বের কোনো ঠিকানা না থাকুক। আমাদের সংবিধানও এটার বিরোধী। মানুষের স্বাভাবিক জীবন ও মৃত্যুর অধিকার রয়েছে। এরপরও সেটা পালিত হচ্ছিল না। সেটা পালন করতে সরকার বাধ্য। সরকার মানে আজকের সরকার নয়; বাংলাদেশের সব সরকারই সেটা পালন করতে বাধ্য। এসব লক্ষ্য পূরণে কাজ করে যাচ্ছি। পাশাপাশি আমাদের একটা আপ্তবাক্য আছে-সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। এটা একটা আইডিয়াল; কিন্তু এটা সব সময়ই পালিত হবে, এমন নয়। তবে আমরা সব সময় সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে চেষ্টা করব। প্রথমত, অবশ্যই আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক। ভারত, চীন আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে গুরুত্ব বেশি। তাদের সঙ্গে খুবই কার্যকর এবং পারস্পরিক লাভজনক সম্পর্ক বজায় রাখতে চাই। আমাদের অন্য পার্টনার যারা আছে, বিশেষ করে পশ্চিমে, যেখানে আমাদের রপ্তানির বড় অংশ যায়; তাদের সঙ্গেও আমাদের মসৃণ সম্পর্ক রাখার প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, এর বাইরেও জাপান আছে, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকার সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছি। ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছে। আমার টিমকে সঙ্গে নিয়ে এ জিনিসগুলো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আমার দায়িত্ব। আমি সেই কাজ করে যাচ্ছি।
যুগান্তর : এখন পর্যন্ত সাধারণ মানুষের ধারণা-ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন যে সরকার বিদায় নিয়েছে, তাদের পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্য হলো-ওনারা ভারতকেন্দ্রিক তথা ভারতকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করেছেন। আমরা শুনতে পাচ্ছি, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সেক্ষেত্রে একটা ভারসাম্য আনয়ন করার চেষ্টা করছে। পশ্চিমের সঙ্গে রিব্যালেন্সিং করার চেষ্টা করছে। এ ধারণা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী এবং এই ধরনের রিব্যালেন্সিংয়ের সুবিধা ও অসুবিধাগুলো কি আপনারা চিন্তা করেছেন?
মো. তৌহিদ হোসেন : দেখুন, আমি তো দায়িত্ব নিলাম মাত্র এক মাস। এর আগে আমি একজন সাধারণ নাগরিক ছিলাম। তখনও আমি এটা বলেছি এবং দেখেছি যে, পারসেপশনটা কিন্তু আছে। পূর্ববর্তী সরকার সব সময় বলার চেষ্টা করেছে যে, ভারতের সঙ্গে সোনালি অধ্যায় চলছে। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু সেটা সব সময় যে মানুষের প্রত্যাশা এবং মানুষের যে অনুভূতি, সেটার প্রতিফলন ঘটেনি-সাধারণ নাগরিক হিসাবে সেটা আমার মনে হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাকে আমার ভুলে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মানুষের মধ্যে এমন পারসেপশন আছে। বিগত সরকার খুব বেশি ভারতকেন্দ্রিক ছিল। আমরা অবশ্যই ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চাই। এতে কোনো সন্দেহ নেই। রোববার প্রধান উপদেষ্টাও বলেছেন, ভালো সম্পর্ক চাই, সেটা পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে হতে হবে। আমরা অবশ্যই ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চাই; বাকি সবার সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক চাই। আপনি যেটা ব্যালেন্সের কথা বলেছেন, একধরনের ব্যালেন্স কিন্তু ভারত ও চীনের মধ্যে ছিল সব সময়ই। চীনের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল। পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় ছিল অনেকদিন ধরে। আমি সব সময়ই বলি, একটা সমস্যার সমাধান করতে গেলে প্রথমেই মেনে নিতে হবে যে, সমস্যাটা আছে। এটা সত্য যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের একধরনের টানাপোড়েন চলছিল। সেটা আমরা চাই না। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পার্টনার। আমাদের রপ্তানির সবচেয়ে বড় গন্তব্য। কাজেই আমরা চাই, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্ক একইভাবে ভারসাম্যপূর্ণ থাকুক এবং আমরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি। ইউরোপের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা চলে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে টানাপোড়েন ছিল, ঠিক ততটা ইউরোপের সঙ্গে ছিল না। আমরা চেষ্টা করে যাব যাতে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন-সবার সঙ্গে একটা ভারসাম্যপূর্ণ ও সুসম্পর্ক বজায় থাকে।
যুগান্তর : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে আশ্রিত আছেন। এ ব্যাপারে আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী?
মো. তৌহিদ হোসেন : তারা তাকে প্রথমে যেতে দিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, স্বল্পসময়ের নোটিশে ভারত তাকে যেতে দিয়েছে। এটা সত্য আমরা ধরে নেব। অবশ্য দেখতেও পাচ্ছি যে, যেতে দিয়েছে। আমাদের অবস্থান হচ্ছে, তিনি সেখানে আশ্রয়ে আছেন। তিনি এই সরকারের জন্য বিব্রতকর কিংবা বিরুদ্ধাচরণ করে এমন স্ট্যাটমেন্ট যদি দেন তবে আমাদের জন্য তা অস্বস্তির কারণ হয়। আমরা চাই না, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের মধ্যে কোনো অস্বস্তি থাকুক। আমরা চাইব এবং চেয়েছিও যে, ভারত যেন এ বিষয়টা মাথায় রাখে। তার লিগ্যাল স্ট্যাটাস কী, আইন-আদালত কী বলবে, সেটা হলো পরের ব্যাপার। কিন্তু যতদিন উনি সেখানে আছেন, আমি চাইব তিনি যেন রাজনৈতিক বক্তব্য না দেন।
যুগান্তর : যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ সরকারের সম্পর্কের ধরন কেমন হবে?
মো. তৌহিদ হোসেন : যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। যেমন ভারতের সঙ্গে আমাদের বহুমাত্রিক সম্পর্ক। এক দেশ হিসাবে সবচেয়ে বড় বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপের সঙ্গে জোট হিসাবে বড়। এটার গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের সবচেয়ে বড় ইন্ডাস্ট্রি গার্মেন্টসের বিভিন্ন দিক মিলিয়ে পোশাকশিল্প এবং সেখানে বিপুলসংখ্যক ছেলেমেয়ে চাকরি করেন। অনেক মানুষের জীবন-জীবিকা কাজ করে। একটা মেয়ে যখন কাজ করেন, তখন তিনি একা না। তিনি একটা সংসারকে এগিয়ে নেন। এ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্ব অপরিসীম। সেটাকে মাথায় রেখেই আমাদের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে কাজ করতে হবে। আমি মনে করি, এটা কঠিন হবে না এ জন্য যে, আমরা খোলামনে কাজ করে যাচ্ছি। এটা তো একটা দিক। আমাদের রেমিট্যান্সেরও অন্যতম সোর্স যুক্তরাষ্ট্র। প্রথমে মধ্যপ্রাচ্যের কথা চিন্তা করি। সেখানে অনেক লোক কাজ করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে কর্মীর সংখ্যা কম, রেমিট্যান্স কিন্তু কম না। কোনো এক মুহূর্তে সৌদি আরবকে ছাড়িয়ে এক নম্বরও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ২/৩ নম্বরে সব সময়েই আছে। সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে আমাদের একটা বড় কমিউনিটি আছে। মধ্যপ্রাচ্যে যেমন কর্মীরা স্বল্পসময়ের জন্য গেছেন আবার ফিরে আসবেন। তাদের স্ট্যাটাস অন্যরকম মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার হিসাবে। যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বেশি স্থায়ীভাবে গেছেন। সেটা কিন্তু গুরুত্ব বহন করে। তার পরিবার-পরিজন যেতে পারছে এর পরে। কাজেই সেই কমিউনিটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। তারা কালক্রমে ভালো ভূমিকা নিচ্ছেন সেখানে। এমনকি স্থানীয় রাজনীতিতেও যুক্ত হচ্ছেন ধীরে ধীরে। এসবই পজিটিভ। কাজেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক যে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ, সেটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। একটা পজিটিভ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা সেটার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছি।
যুগান্তর : যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু বাংলাদেশে আসছেন। ওনার এজেন্ডা সম্পর্কে আপনাদের ধারণা ও প্রস্তুতি কী?
মো. তৌহিদ হোসেন : আমি সার্বিকভাবে শুধু বলতে পারি যে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সব বিষয় নিয়েই তার সঙ্গে কথা হবে। তিনি স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিনিধি হিসাবে আসছেন। তিনি বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার বিষয়ে দেখেন। সব বিষয় নিয়েই আলোচনা করব। স্প্যাসিফিক এজেন্ডা আমার কাছে নেই। মিটিং শুরুর আগে দেখব। এটা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগও চলছে। তাদের এমন কিছু বিষয় থাকবে, সেটা তো আর আমাদের বলবে না। আমরা তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চাই। ভালো সম্পর্কের বিভিন্ন দিক কীভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে, সেটা নিয়ে আমরা লুর সঙ্গে কথা বলব। তিনি তুলনামূলক কম সময়ের জন্য আসছেন। তার সঙ্গে ট্রেজারির প্রতিনিধিও আসছেন। তারাও মিটিং করবেন। অনেক বিষয় আছে। অর্থনৈতিক বিষয়াদিও আছে। আমরা সবকিছু নিয়েই আলাপ করব। একটা মসৃণ সম্পর্ক যাতে প্রতিটি ক্ষেত্রে হতে পারে, সেই চেষ্টা করব।
যুগান্তর : কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ভারী সমরাস্ত্র বাংলাদেশে বিক্রয়ে আগ্রহী। এমনও শোনা যাচ্ছে, বঙ্গোপসাগরের ওপর আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বঙ্গোপসাগরে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনা আছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান কী?
মো. তৌহিদ হোসেন : যুক্তরাষ্ট্র ঘাঁটি করছে বলে কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। তারা প্যাসিফিকভিত্তিক স্ট্র্যাটেজি থেকে সরে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে গেছে। ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে শুধু তারাই যায়নি আরও অনেক দেশ গেছে, যা হয়তো একই নয়, তবে কাছাকাছি একটা স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণ করেছে। ভারতও গেছে। ভারতের নিজস্ব কিছু লক্ষ্য এখানে আছে। সেটা যে সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একরকম হবে-এমন কোনো কথা নেই। ভারতমহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরকে ভারত তার ইনফ্লুয়েন্সের এলাকা মনে করে। এক্ষেত্রে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইন্টারফেস করবে, সেটা আমাদের বিষয় নয়, তাদের বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রের অবশ্যই লক্ষ্য আছে যে, ভারতমহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের ওপর তাদের আধিপত্য, আমরা বলব না তাদের ইনফ্লুয়েন্স যেন বজায় থাকে। তাদের স্বার্থ আছে। তাদের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ আছে। যেহেতু চীনেরও স্বার্থ আছে এবং চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একধরনের সাংঘর্ষিক সম্পর্ক আছে বলে আমরা জানি। সেটা যে সব সময় বাস্তব সংঘর্ষে রূপ নেবে, এমন কথা না। পারস্পরিক একটা তো অবিশ্বাসের ব্যাপার আছে। পরস্পরকে নিয়ন্ত্রণে রাখার একটা চেষ্টা তাদের মধ্যে আছে, সেটা জানি। সেই হিসাবে বঙ্গোপসাগরে ভারতের যেমন আগ্রহ আছে, চীনের যেমন আগ্রহ আছে, যুক্তরাষ্ট্রেরও আছে। আমরা দেশ হিসাবে সেই সংঘাতে জড়িত হব না। আমাদের নিজেদের স্বার্থে সবার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হবে। এর বাইরে কারা পারস্পরিক কোন আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে আসবে, তারা কে কতটুকু ইনফ্লুয়েন্স বজায় রাখার চেষ্টা করবে, সেটা তাদের ব্যাপার।
যুগান্তর : জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সাইড লাইনে ড. ইউনূসের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কোনো বৈঠকের সম্ভাবনা আছে কি না।
মো. তৌহিদ হোসেন : জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যোগদান করবেন। সেখানে ওনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক কার কার সঙ্গে হবে, সেটা এখনই বলতে পারছি না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে একটা বৈঠক হোক, সেটা আমরা চাই। কিন্তু সমস্যা যেটা হয়েছে, আমাদের প্রধান উপদেষ্টা সেখানে পৌঁছবেন ২২ সেপ্টেম্বর বিকালে। নরেন্দ্র মোদির সেখানে খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের সফর। যেদিন উনি (মোদি) চলে আসবেন, সেদিন কিছু সময় আছে। আমরা হয়তো আজ-কাল কিংবা পরশু জানতে পারব। সুতরাং দেখা যাক, আরও কাছাকাছি এলে জানতে পারব যে কার কার সঙ্গে বৈঠক হবে।
যুগান্তর : বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মিয়ানমার নীতি কী, বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রশ্নে কী কৌশল?
মো. তৌহিদ হোসেন : আমরা আর কোনো রোহিঙ্গাকে এখানে আশ্রয় দিতে পারব না। আমরা আমাদের অপারগতা জানিয়েছি। যদিও বিভিন্ন মহল থেকে চাপ ছিল যেন আমরা সুযোগ দিই। আমরা বলেছি, আমাদের পক্ষে সম্ভব না। আমাদের যা করণীয় ছিল, এর থেকে অনেক বেশি আমরা করেছি। আমরা ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছি। পৃথিবীতে আরও অনেক দেশ আছে। তারা দায়িত্ব নিক। যারা আমাদের চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করে, তারা দায়িত্ব নিক কিংবা সংঘাতের কারণে বাস্তুচ্যুত হতে না হয়, সেই লক্ষ্যে বিবদমান গ্রুপগুলোর ওপর চাপ দিক। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আছে। বিভিন্ন মাধ্যমে চাপ দিক। তারপরও কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে। আমরা ঠেকানোর চেষ্টা করছি। পুরোপুরি সফল হচ্ছি না, সেটা স্বীকার করছি। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের ডিজি আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করছি। তারপরও বিভিন্ন জায়গা দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে। তাদের এতটা ক্ষমতাও নেই সব ঠেকানো, বিশেষ করে সাগর দিয়ে যারা চলে আসছে। কিছু আসছে। আমরা কাউকে স্বীকৃতি দিচ্ছি না। রেজিস্ট্রেশন করছি না। আমরা আর আসতে দেব না। এখানে তাদের স্থায়ীভাবে থাকা অথবা থেকে যাওয়ার মাধ্যমে আরেকটি ফিলিস্তিনি পরিস্থিতি চাই না এখানে। সমস্যার সমাধান নিহিত মিয়ানমারে। অবশ্যই এ মানুষগুলোকে তাদের বাসস্থানে অধিকার ও নিরাপত্তাসহ ফিরে যেতে দিতে হবে।
যুগান্তর : চীনের সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সম্পর্কের ধরন কেমন?
মো. তৌহিদ হোসেন : চীনের নীতি হলো-অভ্যন্তরীণ কোনো পরিবর্তনের কারণে তারা তাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন করে না। এ সরকারকে যারা অভিনন্দন জানিয়েছে; চীন তাদের প্রথমদিককার একটি দেশ। চীনের রাষ্ট্রদূত আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। চিফ অ্যাডভাইজারের সঙ্গে দেখা করেছেন। তারা চান, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক যেভাবে ছিল, সেভাবেই থাকুক। আমরাও চাই, চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় থাকবে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা চাইব, অর্থনৈতিক যে সমস্যাগুলো আমাদের আছে, সেগুলো সমাধানের জন্য চীন এগিয়ে আসবে। আমরা চাই অর্থনৈতিক সম্পর্ক বহাল থাকুক আগের মতোই, পারলে আরও ইমপ্রুভ করুক। তাদের কতগুলো কনসার্ন আছে যে, তাদের যে প্রকল্পগুলো আছে, সেগুলো এবং যে এমওইউ হয়েছে সেগুলো, আমরা কী করব। আমাদের অবস্থান হলো, সরকার যেসব চুক্তি সই করেছে, সেগুলো যদি আমাদের পছন্দ নাও হয় তবুও তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানাতে হবে। যেগুলো চুক্তি হয়নি বা পাইপলাইনে আছে, সেগুলো আমাদের স্বার্থে হচ্ছে কি না, সেটা শুধু চীনের ক্ষেত্রে না সব ক্ষেত্রে। যে চুক্তিগুলো পাইপলাইনে আছে, সেগুলো আমরা সব সময়ই রিভিজিট করব। দেখব স্বার্থ সেখানে রক্ষিত হচ্ছে কি না। দরকার হলে আমরা নতুন করে নেগোশিয়েশন করব। আমাদের যে প্রতিপক্ষ থাকবে, তাদেরও স্বার্থ রক্ষিত হবে, আমাদেরও স্বার্থ রক্ষিত হবে-এমনভাবে আমরা চুক্তিগুলো সম্পাদন করব।
যুগান্তর : ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে আমরা কতটুকু সম্পৃক্ত হব?
মো. তৌহিদ হোসেন : আমাদের ইন্দো-প্যাসিফিক পজিশন আছে। আমরা সেটাই পালন করে যাওয়ার চেষ্টা করব। আমরা কোনো রাষ্ট্রের বিরোধী কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা কোনো গ্রুপিংয়ে কখনোই যোগ দেব না। আমরা সরাসরি কারও বিরোধিতা করতে রাজি নই। ইন্দো-প্যাসিফিকে চীন জড়িত আছে, ভারত জড়িত আছে, যুক্তরাষ্ট্র জড়িত আছে। এটা ব্যবসা-বাণিজ্য, সি মুভমেন্ট অব গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস-এগুলোর ক্ষেত্রে যতটুকু আমাদের প্রয়োজন, আমরা সেই পরিমাণ সবার সঙ্গে সম্পৃক্ত হব। কিন্তু কারও বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য আমরা কারও সঙ্গে সম্পৃক্ত হব না।
যুগান্তর : পররাষ্ট্রনীতির সামনে কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বহির্বিশ্বে সরকারপ্রধান নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ইমেজকে কতটা কাজে লাগানো সম্ভব হবে?
মো. তৌহিদ হোসেন : চ্যালেঞ্জ অনেক। প্রথমত আমাদের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ আছে। সেটার সঙ্গে যে বৈদেশিক নীতির সম্পর্ক থাকবে না-এমন কোনো কথা নেই। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খানিকটা তো রিভিজিট করতে হচ্ছে কিছু ক্ষেত্রে। সেটা একটা চ্যালেঞ্জ অবশ্যই। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখায় ব্যালেন্স করতে হচ্ছে। তিনটা দেশের সঙ্গে সম্পর্কে ব্যালেন্স করতে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে। সেই চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবিলা করতেই হবে। আমরা কারও বিরুদ্ধে নই। এর বাইরেও যে চ্যালেঞ্জ নেই তা নয়। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা দরকার। ড. ইউনূসের যে ইমেজের কথা বলেছেন, সেটা কিন্তু আমরা ইতোমধ্যেই ব্যবহার করেছি। ইউএই থেকে আমরা যে লোকগুলোকে মুক্ত করে নিয়ে আসতে পারছি; সেটা ড. ইউনূসের ইমেজ ব্যবহার করা ছাড়া অন্য কোনোভাবে এটা আমরা করতে পারতাম বলে মনে করি না।
যুগান্তর : পাচার করা টাকা ফেরাতে ড. ইউনূসের ইমেজ ব্যবহারে কোনো কাজে লাগানো যাবে কিনা?
মো. তৌহিদ হোসেন : এটা অনেক আইনকানুনের ব্যাপার। এটার বড় দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার ওপর। একজন বড় মানুষকে আইন রিলাক্স করে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষ এটা ওয়েলকাম করেছে। আমাদের ব্যাংকিং সেক্টর যে কি দুরবস্থায় রয়েছে, সেটা আপনারা প্রত্যেকে জানেন। সেটা বলার কিছু নেই। উনি সেটাকে আবার রেললাইনের ওপর নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। এরই অংশ হলো টাকা ফেরত আনার প্রসঙ্গ। টাকা ফেরত আনা খুব সহজ নয়। টাকা যেখানে যায়, সেই দেশের স্বার্থও জড়িত হয়ে যায়। কাজেই আমি মনে করি না যে, যত অর্থ বাইরে পাচার হয়েছে তার সব ফেরত আনতে পারব। আমি আশাবাদী, অন্তত আংশিক ফেরত আনা যাবে। এটা বার্তা দেওয়া যাবে যে টাকা পাচার করলেই সেটা ভোগ করতে পারব-এ নিশ্চয়তা নেই।