ইউক্রেনে ভ্লাদিমির পুতিনের আগ্রাসন এবং আটলান্টিক জোটকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অস্থিতিশীল করার পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠনের ভ্রূণ গজিয়ে ওঠার পথে। মার্কিন সামরিক সহায়তা ছাড়া ইউরোপের উদার গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে এবং রাশিয়াকে ঠেকাতে এটি যথেষ্ট শক্তিশালী প্রমাণিত হবে কিনা, তার পরীক্ষা শিগগিরই হতে পারে।
ইউরোপীয় শক্তিগুলোর মধ্যে শতাব্দীপ্রাচীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা বন্ধ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঠেকানোর জন্য মার্কিন নেতৃত্বে ন্যাটো তৈরি করা হয়েছিল। স্নায়ুযুদ্ধকালে জোটটি ঐক্যবদ্ধ ছিল এবং কমিউনিস্ট শাসনের পতনের পর নতুন মধ্য ইউরোপীয় সদস্যদের আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু মার্কিন বিচ্ছিন্নতার ভূত এখন ইউরোপকে তার পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ রক্ষকের ছেড়ে যাওয়ার হুমকি তৈরি করছে।
ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার বিনিময়ে পুতিনের সঙ্গে সমঝোতার জন্য ট্রাম্প যখন প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, তখন ইউরোপীয় নেতারা হতাশ হয়ে পড়ছেন। কেননা, ন্যাটো বা ইইউ; কেউই কিয়েভের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিচ্ছে না। ট্রাম্প ইউক্রেনে ন্যাটোর যে কোনো ভূমিকা বাতিল করেছেন এবং হাঙ্গেরির ভিক্টর অরবান এ নিয়ে ইইউর যে কোনো ঐকমত্যে বাধা দিয়েছেন।
‘আগ্রহীদের একটি জোট’ বিভিন্ন দেশকে একত্র করেছে, যাতে তারা ভলোদিমির জেলেনস্কিকে শক্তিশালী করতে পারে এবং যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে ইউক্রেনের জন্য সম্ভাব্য নিরাপত্তা বাহিনী তৈরি করা যায়। এর মূলে রয়েছে পাঁচটি ইউরোপীয় শক্তির একটি দল– যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড ও ইতালি, যাকে ই৫ বলা হয়। এটিকে অনানুষ্ঠানিক হলেও ইউরোপের টেকসই নিরাপত্তা পরিষদ গঠনের প্রক্রিয়া বলা যায়।
এই পাঁচটি দেশেরই ইউরোপের বেশির ভাগ অর্থনৈতিক উৎপাদন, সামরিক শক্তি ও রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। ব্রিটেন ও ফ্রান্স ইউরোপের একমাত্র পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন রাষ্ট্র এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য। জার্মানি ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতি এবং প্রতিরক্ষা খাতে ব্যাপক ব্যয় বৃদ্ধির কারণে তাদের সাংবিধানিক ঋণ গ্রহণের সুযোগ আরও সহজ করেছে। পোল্যান্ড মোট দেশজ উৎপাদন অনুপাতে ন্যাটোর বৃহত্তম প্রতিরক্ষা ব্যয়কারী দেশ এবং শিগগিরই তারা ইউরোপের বৃহত্তম সেনাবাহিনীর অধিকারী হবে।
ই৫-কে মানদণ্ড ধরা যায় না। ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা ও স্থিতিস্থাপকতার ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় আটটি নর্ডিক ও বাল্টিক রাষ্ট্রের মতামত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে শীর্ষ আলোচনায় ইতালির আসনটি ইইউর দক্ষিণের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে তার উত্তরাধিকারসূত্রে মর্যাদা এবং ইউক্রেনের জন্য যে কোনো সামরিক ঝুঁকি নেওয়া রোমের ইচ্ছার চেয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির রাজনৈতিক সম্পর্কের জন্য বেশি দায়ী।
গত সেপ্টেম্বরে গার্ডিয়ানের এক কলামে উল্লেখ করেছিলাম, ইউরোপ মনে হচ্ছে ইউক্রেনকে শুধু মাথা উঁচু করে রাখতে সহায়তা দেওয়ার একটি উপায় হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে, কিন্তু তা জয়লাভে যথেষ্ট নয়। ন্যাটোর এক কর্মকর্তা আমাকে বলেছিলেন, রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণের ‘দ্বিতীয় ধাক্কা’ ইউরোপীয়দের আত্মতুষ্টি থেকে বের করে আনবে এবং তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা জোরদার করার জন্য আরও মৌলিক সম্মিলিত পদক্ষেপে উৎসাহ জোগাতে পারে।
ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে ফিরে আসায় সেটি জোরালো হয়েছে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি যুদ্ধের উৎপত্তি সম্পর্কে মস্কোর ভাষ্য গ্রহণ করেন। তিনি জেলেনস্কিকে একজন স্বৈরশাসক হিসেবে চিহ্নিত করেন। ওভাল অফিসে তাঁকে অপমানজনকভাবে আক্রমণ করেন এবং কিয়েভের জন্য অস্ত্র ও গোয়েন্দা সংস্থা বন্ধ করে দেন। তিনি মিত্রদের উত্তেজিত করে গ্রিনল্যান্ড দখলে মার্কিনিদের প্ররোচিত করেন, যা ইইউ সদস্য ডেনমার্কের অংশ। এ ছাড়া পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার এবং কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম প্রদেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন।
ট্রাম্প ন্যাটোকে অবমূল্যায়ন করেছেন এই বলে, তিনি প্রতিরক্ষা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না করা দেশগুলোকে রক্ষা করবেন না। তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে শত্রুভাবাপন্ন এক বক্তৃতায় ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সমালোচনা করেছেন। আর প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ ইউরোপীয় মিত্রদের বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক মনোযোগ এশিয়ার দিকে সরিয়ে নিচ্ছে এবং ভবিষ্যতে তাদের নিজেদের নিরাপত্তায় সজাগ থাকতে হবে। ধাক্কাটি গভীর এবং কিছু ইউরোপীয় সরকার এখনও অন্তত প্রকাশ্যে তা অস্বীকার করছে।
এসব ইঙ্গিত দেয়, ট্রাম্পের ভূরাজনৈতিক বিপর্যয়ের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে এবং ইউরোপে নিরাপত্তাশূন্যতা রোধ করার জন্য একটি কার্যত ইউরোপীয় নিরাপত্তা পরিষদ ইতোমধ্যে কাজ করছে। তবে ট্রাম্পের প্রশাসন সুপ্রিম অ্যালায়েড কমান্ডার ইউরোপের শীর্ষ ন্যাটো সামরিক পদটিও খালি করার কথা বিবেচনা করছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যা ১৯৫১ সাল থেকে ট্রান্সআটলান্টিক নিরাপত্তা গ্যারান্টির মূর্ত প্রতীক। ধারণা করা হচ্ছে, এই স্থানান্তর ধীরে ধীরে সম্মতি ও আলোচনার পরিবর্তে হঠাৎ একতরফা ও বিশৃঙ্খল হয়ে উঠতে পারে। এটিই হবে লুণ্ঠনকারী বৃহৎ শক্তির ক্রমবর্ধমান আইনহীন বিশ্বে ইউরোপীয়রা তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা পরিচালনা করতে পারে কিনা, তার একটি সত্যিকারের চাপ প্রয়োগের পরীক্ষা।
পল টেইলর: ইউরোপীয় পলিসি সেন্টারের সিনিয়র ভিজিটিং ফেলো; দ্য গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম