সন্তান হত্যার বিচার চাই না— এমন কথা কেন বাবার মুখে উচ্চারিত হয়, রাষ্ট্রশক্তি অতীতে তা অনুধাবন করতে পারেনি। কিন্তু এখন? দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে মানুষ যে পরিবর্তনটুকু বিশেষ করে নিরাপত্তার প্রত্যাশা করেছিল তা কেন বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার দায়ও সরকারেরই।
২০২২ সালের ২৪ মার্চ ঢাকার শাহজাহানপুরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে দু-জন নিহত হওয়ার ঘটনাটি অনেকেরই হয়তো মনে আছে। নিহতদের একজন ছিলেন মতিঝিল থানার একটি রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদক, অন্যজন ছিলেন রিকশারোহী কলেজছাত্রী সামিয়া আফনান প্রীতি। গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন রাজনৈতিক নেতার গাড়িচালকও। ওই নৃশংসতার মূল লক্ষ্য ছিলেন রাজনৈতিক দলের নেতাটি। কিন্তু বলি হলেন নিরীহ সামিয়া আফনান প্রীতিও। প্রীতির শোককাতর বাবা তখন বলেছিলেন, তিনি তার সন্তান হত্যার বিচার চান না।
আমাদের আরও স্মরণে আছে, ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর বিকেলে ঢাকার লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কার্যালয় ও শাহবাগের আজিজ মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে জোড়া হামলা চালানো হয়েছিল। শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে কুপিয়ে আহত করা হয় এর মালিক আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ তিনজনকে। অন্যদিকে জাগৃতির কার্যালয়ে রক্তাক্ত ও নিথর অবস্থায় পড়ে ছিলেন প্রতিষ্ঠানের মালিক ফয়সাল আরেফিন দীপন। দুটি ঘটনার ক্ষেত্রেই হামলার পর দুর্বৃত্তরা কার্যালয়ের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিল। নিহত দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও বিশিষ্ট লেখক আবুল কাসেম ফজলুল হকও তার ছেলে হত্যার প্রতিক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ, হতাশ হয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “আমি কোনো বিচার চাই না। আমি চাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। যারা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নিয়ে রাজনীতি করছেন, যারা রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছেন, উভয় পক্ষ দেশের সর্বনাশ করছেন। উভয় পক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। এটুকুই আমার কামনা। জেল-ফাঁসি দিয়ে কী হবে।” ওই ঘটনায়ও একজন শোককাতর বাবার ক্ষুব্ধ উচ্চারণ আজও জারি আছে।
প্রীতি ও দীপনের বাবা প্রায় অভিন্ন বক্তব্য রেখেছিলেন সন্তান হারানোর পর। সঙ্গতকারণেই আবুল কাসেম ফজলুল হকের বক্তব্যে বুদ্ধিভিত্তিক বিবেচনা রয়েছে। তবে দুজনই বিচারহীনতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের। বিচারহীনতার ওই অপসংস্কৃতি আমাদের সমাজ বাস্তবতায় নতুন কিছু নয়। বিচারের বাণী যেখানে নীরবে নিভৃতে কাঁদে সেখানে দুর্বৃত্তদের চারণভূমি প্রসারিত হবে এটাই তো স্বাভাবিক।
মা-বাবার কাঁধে সন্তানের লাশের চেয়ে ভারি বোঝা আর কিছু হতে পারে না। সন্তানহারা বাবাদের এই উচ্চারণ কি শুধুই ক্ষোভ-বেদনার বহিঃপ্রকাশ ছিল, নাকি জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব যাদের কিংবা অপরাধের আইনি প্রতিকারের দায়িত্ব যাদের হাতে, তাদের ওপর অনাস্থার প্রকাশ? এটা স্পষ্টতই বোঝা যায়, তাদের বেদনাকাতর উচ্চারণ শেষেরটিরই প্রতিফলন। জননিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। অতীতে প্রতিটি ঘটনার পরই নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মুখ্য দায় যাদের, ওই পুলিশের তরফে শোনা গেছে গৎবাঁধা কথা। এখন কি এর ব্যতিক্রম ঘটছে? সচেতন মানুষ মাত্রেই এই প্রশ্নের উত্তর জানেন।
দীপন কিংবা প্রীতির বাবার মতো আগে-পরে আরও ভুক্তভোগী নিদারুণ আক্ষেপে উচ্চারণ করেছেন— বিচার পাই না, তাই বিচার চাই না। হতাশা বুকে চেপে একজন সন্তানহারা বাবা কিংবা স্বজন হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইতে অপারগতা প্রকাশ করে রাষ্ট্রকে যে জিজ্ঞাসার মুখোমুখি করেছিলেন, তারপরও রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলরা এটা স্বীকার করেননি যে, কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক সমাজে এমনটা হওয়ার কথা নয়। কিছুদিন আগেও সরকারে ছিলেন এবং বর্তমানে নতুন রাজনৈতিক দলের নেতা নাহিদ ইসলামও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, বিচার ও সংস্কার কতটুকু হলো ‘কড়ায় গণ্ডায়’ জবাব নেব। একজন রাজনীতিক হিসাবে জনকল্যাণের নিরিখে তার এমন উচ্চারণ অমূলক কিছু নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি সরকারে থাকাকালে এর গুরুত্ব কতটা অনুভব করেছিলেন?
যে দেশে জননিরাপত্তা ভঙ্গুর, সেখানে যতই উন্নয়ন হোক, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হিসাব করা হোক বা পরিবর্তনের কথা বলা হোক না কেন, মানবাধিকার, জীবনযাত্রার মান ও জননিরাপত্তার বিচারে এগুলো খুবই তুচ্ছ। এ সমাজ মানুষরূপী দানবদের অভয়ারণ্য হয়ে ওঠার পেছনের কারণ অনেক। এর অন্যতম কারণ হলো সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা ও অনেক রকম সমীকরণের প্রতিফল– এ নিয়ে সন্দেহ কি? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ব্যর্থতার কথা তো এমন প্রেক্ষাপটে সর্বাগ্রে আসবেই; যেহেতু এই বাহিনীগুলো রাষ্ট্র ব্যবস্থার অনুষঙ্গ এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত। দায়ভারটা প্রথমত বর্তায় সরকারের ওপরই। ধর্ষণের শিকার মাগুরার ছোট্ট শিশুটির মর্মান্তিক মৃত্যুর মত বীভৎস অনেক ঘটনাই ঘটেছে, ঘটছে এবং এরপর আইনি সংস্থা তো বটেই, সরকারের নীতিনির্ধারকদের মুখেও আমরা শুনেছি, অপরাধী যে-ই হোক, তার ছাড় নেই। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতার সঙ্গে এসব অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতির মিল-অমিল কতটা? এ প্রশ্নের জবাবও সচেতন মানুষের কাছে অস্পষ্ট নয়।
শুনতে অপ্রীতিকর হলেও সত্য, আমাদের সমাজে অনেক ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তরা নীতি-আদর্শহীন এক শ্রেণির তথাকথিত রাজনীতিবিদের ছত্রছায়াতেই বেড়ে ওঠে। তারা নিজেদের লাভের হিসাব করে ভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত হয়। প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার আশীর্বাদের হাতও বলবান ও সমাজবিরোধীদের মাথায় থাকে এর অনেক নজিরও আমাদের সামনে আছে। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে দুর্বৃত্তদের প্রতিরোধ করার জন্য ব্যক্তির মূল্যবোধ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তবে একইসঙ্গে এ প্রশ্নও রাখি, পরিপার্শ্বে এত গলদ জিইয়ে রেখে অবস্থার পরিবর্তন কতটা সম্ভব? শুধুই মূল্যবোধের অবক্ষয়ের বিরূপ ফল, এটুকু বলে দায় শেষ করার অবকাশ কতটা আছে?
আমাদের সমাজে অপরাধীরা নৃশংসতার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, যা অনেক সময় পরিমাপ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা দেখেছি, অপরাধীরা ঠান্ডা মাথায় প্রমাণ মুছে ফেলার চেষ্টা করে। এমন বাস্তবতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ন্যায়দণ্ড' কবিতার পঙ্ক্তিগুলো আরও বেশি গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। একের পর এক বর্বর ঘটনা শান্তিপ্রিয় মানুষকে শুধু ভীত-সন্ত্রস্তই করছে না, একই সঙ্গে এ প্রশ্নও সামনে নিয়ে আসছে— এর শেষ কোথায়? দুর্বৃত্ত কিংবা সমাজবিরোধীর সংখ্যা নগণ্য; জননিরাপত্তার দায়িত্ব পালনকারীর সংখ্যা নিশ্চয়ই এর চেয়ে অনেক বেশি। তাহলে দুর্বৃত্তদের দুর্বৃত্তপনায় সমাজ থরথর করছে কেন? নারী-শিশুর নিরাপত্তার বিষয়টি আরও নাজুক হয়ে পড়েছে। সমাজে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের দাবি নতুন নয়। এ ব্যাপারে সরকারের অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতিতেও কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু তারপরও কেন বর্বরতা-নৃশংসতার ছায়া সরে না, উপরন্তু আরও প্রসারিত হয়? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্র, জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকা সংস্থা এবং রাজনীতির নীতি নির্ধারকদের।
বিদ্যমান বাস্তবতায় আমাদের মনে পড়ে রাজনীতিক ও সাংবাদিক নির্মল সেনের স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাওয়ার কথা। কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা পেতে হলে ব্যবস্থা ও রাজনীতির শুদ্ধিকরণ জরুরি— এ সত্য কি এড়ানো যাবে? যতক্ষণ তা না করা যাবে, ততক্ষণ দুর্বৃত্ত কিংবা সমাজবিরোধী অপশক্তির আঁতুড়ঘর টিকে থাকবেই। যে ভূতল অপরাধীচক্র অদৃশ্য শক্তির আশীর্বাদ নিয়ে বারবার চেহারা বদলায়, এর উৎসেও নজর দিতে হবে। সন্তান হত্যার বিচার চাই না— এমন কথা কেন বাবার মুখে উচ্চারিত হয়, রাষ্ট্রশক্তি অতীতে তা অনুধাবন করতে পারেনি। কিন্তু এখন? দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে মানুষ যে পরিবর্তনটুকু বিশেষ করে নিরাপত্তার প্রত্যাশা করেছিল তা কেন বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার দায়ও সরকারেরই।
রাষ্ট্র পরিচালক বা শাসকদের আত্মজিজ্ঞাসা, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। জনপরিসরে যে সব আলোচনা হয় তা সরকারের অজ্ঞাত থাকার কথা নয়। ঈদে নগরবাসীর উল্লেখযোগ্য অংশ নাড়ির টানে ঘরমুখো হবেন এটা খুব স্বাভাবিক চিত্র। এখন খণ্ডকালীন নগরত্যাগীদের ফেলে যাওয়া বাসাবাড়ির নিরাপত্তাও যদি তাদেরই নিশ্চিত করতে হয় তাহলে তো উচ্চারণ করতেই হয়, হা হতোস্মি!