ব্রিটিশরা ভারতে প্রবেশ করেছিল বাংলা হয়ে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার স্বাধীন নরপতি সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে। অনেক ইংরেজের কাছে সে সময় মুর্শিদাবাদকে নাকি ইংল্যান্ডের চেয়ে সুন্দর মনে হয়েছিল। সে সময় বাংলার রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ। কিন্তু ইংরেজরা মুর্শিদাবাদকে তাদের রাজধানী রাখেনি। জব চার্নক সুতানুটিকে ‘কলকাতা’ নাম দিয়ে যে শহরের পত্তন করেছিলেন, তাতেই তারা রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন।
১৯১১ সাল পর্যন্ত ইংরেজরা ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী ১৫৪ বছর রেখেছিলেন কলকাতায়। তাই দেখা যায় ব্রিটিশরা রাজধানীর উন্নয়ন করতে গিয়ে কলকাতা কেন্দ্রিক সবকিছু গড়ে তুলেছিলেন। শিল্পও গড়ে উঠেছিল হুগলি নদীর উভয় তীরে। আর বন্দরও গড়ে উঠেছিল কলকাতায়। অথচ কলকাতা কখনও বন্দর তৈরির জন্য উপযুক্ত জায়গা নয়। সমুদ্র থেকে ৮৫ মাইল ভেতরে কলকাতা বন্দরের অবস্থান।

অবশ্য বালীগঞ্জ ঘাটে তখনও পাইকারি বিক্রির একটা বিপণন কেন্দ্র ছিল। বাংলার সওদাগরেরা সে কেন্দ্র থেকে মালামাল কিনতে বালিগঞ্জ ঘাটে যেতো। আমার জেলা চট্টগ্রামের পাল তোলা জাহাজের প্রাচীন মাঝি মাল্লাদের মুখে শুনেছি চট্টগ্রাম থেকে কলকাতা যেতে ‘বাইশ  জোয়ার তেইশ ভাটা তারপরে বাইল্যা ঘাটা’—এই সময়টুকু লাগতো। যাহা হোক, পাটকল, সুতাকল সবই গড়ে উঠেছিল হুগলির উভয় তীরে। ইংল্যান্ডের ডান্ডির পাটকলগুলোতে যেমন কাঁচাপাট সরবরাহ করতো পূর্ব বাংলার পাটচাষিরা তেমনি কলকাতার পাটকলগুলোতেও পাট যেতো পূর্ব বাংলা থেকে। পূর্ব বাংলায় কোনও পাটকল ব্রিটিশের সময় গড়ে উঠেনি। সিরাজগঞ্জে একটা জুট মিল হয়েছিল সত্য, কিন্তু তা আসামের ভূমিকম্পের সময় ধ্বংস হয়ে যায়।

ভারত বিভক্তির এক দশক আগে নারায়ণগঞ্জে চিত্তরঞ্জন কটন মিলস আর লক্ষ্মীনারায়ণ টেক্সটাইল মিলস হয়েছিল। কুষ্টিয়ার মোহিনী টেক্সটাইলও সে সময়ে প্রতিষ্ঠিত। এছাড়া কোনও উল্লেখযোগ্য মিল কারখানা পূর্ববাংলায় ছিল না। ভারত বিভক্তির সময় বাংলাদেশের গভর্নর ছিলেন স্যার ফ্রেডরিক বুরোস তিনি বাংলার বিভক্তির সিদ্ধান্তের কথা জেনে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন আরও বহু দশক পূর্ব বাংলা কৃষকের বস্তি হিসেবে বিরাজ করবে। বিভক্তির সময় বাংলার সমৃদ্ধ অংশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। জওহর লাল নেহরু বলেছিলেন দারিদ্র্যের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে পূর্ববাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ১৫/১৬ বছরের মাঝে ভারতে যোগদানের জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠবে। এটা তিনি বলেছিলেন ভারতীয় লোকসভায় শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর লোক বিনিময় প্রস্তাবের জবাবে। শ্যামা প্রসাদ এখানকার হিন্দুদের ভারতে নিয়ে সমসংখ্যক মুসলমানকে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

এদেশে ব্রিটিশেরা ১৯০ বছর শাসন করেছিল। ১৭৫৭ সাল থেকে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ১১৩ বছর, মুসলমানেরা সহজে ব্রিটিশ শাসন মেনে নেয়নি। অসংখ্যবার বিদ্রোহ করেছে মুসলমানেরা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে, তখন হিন্দুদের বৃহৎ অংশ ব্রিটিশের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে গিয়ে মুসলমানেরা সর্বহারা হয়ে গিয়েছিল। মুসলমানদের ওয়াকফ সম্পত্তি পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করেছিল ইংরেজরা। অর্ধনগ্ন একতারা হাতে ফকিরেরাও বিদ্রোহ করেছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে। ইতিহাসে তাকে ফকির বিদ্রোহ বলে। মজনুশাহ, দুন্দুশাহ ফকির বিদ্রোহের নেতা ছিলেন। পরে কিছু সন্ন্যাসীও এতে যোগদান করেছিল। ১৮৭০ সাল হতে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত (ওহাবী আন্দোলনের পর) সৈয়দ আমির আলী, আব্দুল লতিফ, সৈয়দ হাসান ইমাম, মীর মোশাররফ হোসেন, সৈয়দ আমির হোসেন, মওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী প্রমুখের প্রচেষ্টায় মুসলমানেরা ব্রিটিশের সঙ্গে সমঝোতা করে শান্তিপূর্ণ অবস্থান শুরু করে। দীর্ঘ ৭৭ বছর (১৮৭০ সাল থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত) আর কোনও বৈরিতার দিকে মুসলমানেরা পা বাড়ায়নি।

১৯০৫ সালে পূর্ব বাংলা এবং আসামের পশ্চাৎপদতার কথা চিন্তা করে ইংরেজরা একটা স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন করেছিল আসাম এবং পূর্ব বাংলাকে নিয়ে। পূর্ব বাংলার এ পৃথকীকরণকে পশ্চিম বাংলার বুদ্ধিজীবী সমাজ মেনে নেননি। তারা দীর্ঘ ৬ বছর পৃথকীকরণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন, আর ১৯১১ সালে পঞ্চম জজ দিল্লির দরবারে বাংলার বিভক্তি রহিত করে দিয়েছিলেন। রহিতের পক্ষে এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ছিলেন। বাংলার বিভক্তি রহিত হওয়ায় মুসলমানেরা খুবই বিরক্ত বোধ করেছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে তারা স্থায়ী বিভক্তির পক্ষে অবস্থান নেয়।

১৯৪৭ সালে বাংলা বিভক্ত হয়ে একাংশ পূর্ব পাকিস্তান নামে পাকিস্তানের অংশ হয়ে গেলো, অন্য অংশ পশ্চিমবঙ্গ হিসেবে ভারতেই থাকলো। লোকসভায় প্রদত্ত নেহরুর পূর্বাভাস সত্য হলো না যে ১৫-১৬ বছর পর পূর্ব বাংলার মানুষ দারিদ্র‌্যের চাপে ভারতে একত্রিত হয়ে যাবে। বরং ১৫-১৬ বছরের মাঝে পূর্ব পাকিস্তানে যে মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠেছিল তারা অবাস্তব ১২ মাইল দূরের দেশের আরেক অংশকে ছুড়ে ফেলে নিজের অংশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হলো এবং পূর্ব বাংলার মানুষ দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করলো।

বাংলাদেশ এখন স্বাধীন দেশ। স্বাধীন হওয়ার ফলে বাংলাদেশের শিক্ষা, সমাজ, অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নতি হয় অপ্রতিহত গতিতে। বাংলাদেশের উন্নতি ফেলে আসা পশ্চিমবঙ্গ কিংবা পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নতির চেয়ে বেশি। এখন দেখা যাচ্ছে কোনও কোনও ক্ষেত্রে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে ভারতকেও বাংলাদেশ অতিক্রম করছে। বিশেষ করে গত এক দশক ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ চোখে পড়ার মতো অগ্রগতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

সর্বশেষ আইএমএফ-এর হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সালে বাংলাদেশের সম্ভাব্য মাথাপিছু জিডিপি তিন দশমিক আট শতাংশ বেড়ে হতে পারে এক হাজার ৮৮৮ ডলার। অন্যদিকে ভারতের সম্ভাব্য মাথাপিছু জিডিপি ১০ দশমিক তিন শতাংশ কমে হতে পারে এক হাজার ৮৭৭ ডলার। অর্থাৎ, এই প্রথম মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ ভারতের থেকে ১১ ডলার এগিয়ে যেতে পারে। আইএমএফের এই পূর্বাভাস ঠিক থাকলে মাথাপিছু জিডিপিতে দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপের পরে বাংলাদেশের অবস্থান হবে।

ভারত বিশ্ব অর্থনীতিতে পঞ্চম শক্তি কিন্তু সাম্প্রতিক আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং সিআইএ’র নানান অর্থনৈতিক র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আর ভারত-পাকিস্তান তাদের পূর্ব অবস্থান থেকে পিছাচ্ছে। এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের চার্টে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ১৯-২০ করে দেখানো হলেও ভারত-পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের জীবনমানের চেয়ে বাংলাদেশিদের জীবনমান এখন উন্নত।

বাংলা হচ্ছে ব-দ্বীপ। ব-দ্বীপের মানুষ সংগ্রাম করে বেঁচে থাকে। এ সংগ্রাম চলমান এবং সর্বত্র। সুতরাং সংগ্রামী মানুষের উন্নতি ছাড়া পতন নেই। বাংলাদেশ যদি কোনও বড় রাষ্ট্রের অনুকূল্য পায় তবে বাংলাদেশ ইসরায়েলের মতো চমক দেখাবে, যারা ছোট্ট একটি রাষ্ট্র কিন্তু পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে তার অর্থনৈতিক-সামরিক সব শক্তি দিয়ে তটস্থ করে রেখেছে।

এমনকি বাংলাদেশ হতে পারে মালয় উপদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তের দ্বীপরাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের সমকক্ষ। সিঙ্গাপুর এশিয়ার অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র। আর্থিক ব্যবসা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা এবং জাহাজ ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র সিঙ্গাপুর। পশ্চিমে মালাক্কা প্রণালী, পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত নৌপথ। মাত্র ৭২৫.৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ছোট্ট রাষ্ট্রটি এখন পৃথিবীর অন্যতম ধনী রাষ্ট্র। ১৯৬৫ সালে স্বাধীনতার পর সিঙ্গাপুরবাসীর জিডিপি অনুসারে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ১৩৩ গুণ বেড়েছে। জীবনযাত্রার মান যেমন উন্নত, তেমনি খরচটাও একেবারে কম নয়। আইএমএফ-এর ২০২০ সালের সম্ভাব্য মাথাপিছু আয়ের যে তালিকা যেখানে সিঙ্গাপুরের অবস্থান বিশ্বে ছয় নম্বরে। আর বাংলাদেশ ১৪০, ভারত ১৪১।

শুনে আশ্চর্য হবেন, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বেতনপ্রাপ্ত সরকার প্রধান সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি শিয়েন লুং। তার পেছনে আছেন যথাক্রমে হংকং, সুইজারল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রের সরকার প্রধানরা। করোনা হানা দেওয়ার আগে তার আনুষ্ঠানিক বেতন ছিল প্রায় ২২ লাখ মার্কিন ডলার। মহামারির প্রেক্ষিতে নিজের বেতন কমিয়েছেন শিয়েন। এরপরও বার্ষিক ১৬ লাখ মার্কিন ডলার বেতন নিয়ে তিনিই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আয়কারী রাষ্ট্রনেতা।

সঠিক নেতৃত্ব, জনশক্তিকে জনবলে রূপান্তর আর দুর্নীতিকে রোধ করতে পারলে বাংলাদেশের অগ্রগতি ঠেকানো কঠিন।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews