ফ্যাসিস্টের দোসরদের কবল থেকে এখনো মুক্তি পায়নি জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। পতিত সরকারের আমলে টেলিভিশনটি যারা ‘বোকা বাক্সে’ পরিণত করে লুটপাট চালিয়েছে তাদের অনেকেই এখনো দাপটের সঙ্গে চাকরি করছেন। সম্প্রতি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় পদোন্নতির জন্য প্রস্তাবিত ১২ কর্মকর্তার নামের তালিকা একটি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পাঠায়। ওই তালিকায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও দুর্নীতিবাজ হিসাবে চিহ্নিত ক্ষমতাচ্যুত সরকারের দোসরদের নাম থাকায় তোলপাড় শুরু হয়।

এদিকে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে এক চিঠিতে গত বছরের ১৪ নভেম্বর বিটিভির সাবেক মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর আলম ও তার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই নির্দেশ না মেনে উলটো মোটা টাকার বিনিময়ে জাহাঙ্গীর সিন্ডিকেটের সদস্যদের পদোন্নতি দিতে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে একটি চক্র। এছাড়া ৫ জানুয়ারি সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বিটিভির ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের (তালিকাসহ) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উকিল নোটিশ পাঠালেও তা আমলে নেওয়া হয়নি।

অভিযোগ আছে, বিতর্কিত এসব কর্মকর্তার পদোন্নতি চূড়ান্ত করতে পাঁয়তারা করছে বিটিভি ও মন্ত্রণালয়ের অসৎ কর্মকর্তাদের একটি চক্র। সোমবার মন্ত্রণালয়ে পদোন্নতি কমিটির সভা হওয়ার কথা রয়েছে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের নতুন উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে ‘অন্ধকারে’ রেখে চিহ্নিত সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়ার কাজ চূড়ান্ত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে উল্লিখিত তথ্য জানা গেছে।

এ ব্যাপারে জানতে রোববার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং পদোন্নতি কমিটির আহ্বায়ক মাহবুবা ফারজানার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। একই নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপে এ প্রতিবেদক পরিচয় উল্লেখ করে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য চেয়ে খুদে বার্তা পাঠালেও রাত ১০টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোনো জবাব দেননি।

জানতে চাইলে পদোন্নতি কমিটির সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো. নূরুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘পদোন্নতির তালিকায় নাম থাকা কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান থাকলে তা কমিটির সভায় উপস্থাপিত হলে আমার যা করণীয় তাই করব।’ সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কিভাবে আপনারা মূল্যায়ন করবেন-এই প্রশ্নের জবাব দিতে অসম্মতি জানান তিনি।

জানা গেছে, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের ৭ মাস পার হলেও পতিত সরকারের দোসর হিসাবে পরিচিত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেটের হাতে এখনো জিম্মি বিটিভি। দোসরদের কর্মকাণ্ড নিয়ে মিডিয়ায় একের পর এক সংবাদ প্রচারিত হলেও রহস্যজনক কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। লোক দেখানো কাজের অংশ হিসাবে শুধু অনুষ্ঠান বিভাগের ২-৩ জনকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে। কিন্তু বার্তা ও ইঞ্জিনিয়ার বিভাগসহ অন্যান্য বিভাগের দুর্নীতিবাজ দোসর চক্র এতটাই শক্তিশালী যে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশও কার্যকর হচ্ছে না। একজন কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রতিষ্ঠানটিতে যেন ‘সবাই রাজা।’ এখানে প্রধান উপদেষ্টার আদেশ কার্যকর করেন না সচিব, মহাপরিচালক মানেন না সচিবের আদেশ, আর কর্তৃপক্ষের তোয়াক্কা করেন না জেনারেল ম্যানেজার। যিনি হরহামেশাই ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও লুটপাটে জড়িত।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বিটিভিতে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। বিশেষ করে বিটিভির সাবেক মহাপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম, উপমহাপরিচালক (বার্তা ও অনুষ্ঠান) সৈয়দা তাসমিনা আহমেদ, ঢাকা কেন্দ্রের সাবেক জেনারেল ম্যানেজার (চলতি দায়িত্ব) মোছা. মাহফুজা আক্তার, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা বিটিভির সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার (চলতি দায়িত্ব) মনিরুল ইসলাম, নিয়ন্ত্রণ ও মুখ্য শিল্প নির্দেশক মোহাম্মদ সেলিম ও তাদের সিন্ডকেট সদস্যদের দুর্নীতি এবং শত শত কোটি টাকা লোপাটের তথ্য বিভিন্ন তদন্তে প্রমাণিত। এই সিন্ডিকেটের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদকের একাধিক টিমের তদন্ত এখনো চলমান।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, বিটিভির সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার (চলতি দায়িত্ব) ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মনিরুল ইসলামের টেন্ডারবাজি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করছেন দুদকের উপসহকারী পরিচালক মো. খায়রুল। দীর্ঘদিন পার হলেও রহস্যজনক কারণে তিনি অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দিচ্ছেন না। কিন্তু এর মধ্যে কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে এসেছে সাপ। পতিত সরকারের সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদের দুর্নীতির অনুসন্ধান করতে গিয়ে মনিরুল ইসলামের যোগসাজশ পেয়েছেন দুদকের উপ-পরিচালক ও অনুসন্ধান টিমের প্রধান মো. মুস্তাফিজুর রহমান। ২৩ জানুয়ারি তিনি জরুরি ভিত্তিতে মহাপরিচালকের কাছে চিঠি দিয়ে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র তলব করেছেন। অথচ এই মনিরুলের নাম বিটিভির পদোন্নতি তালিকার ৫ নম্বরে রয়েছে। তার নামের পাশে পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কন্ট্রোলার/ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজার এবং প্রকল্প পরিচালক-বাংলাদেশ টেলিভিশনের কেন্দ্রীয় সম্প্রচার ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, ডিজিটালাইজেশন ও অটোমেশন শীর্ষক প্রকল্প।’ এসব পদ-পদবি ইঙ্গিত করে এখনো কতটা দাপটের সঙ্গে চাকরি করছেন পতিত সরকারের এই দোসর।

জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। দুদক বিটিভির বিভিন্ন প্রকল্পের দুর্নীতির অনুসন্ধান করছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসাবে আমার কাছে যেসব তথ্য দুদক কর্মকর্তা চেয়েছেন আমি সেগুলো সরবরাহ করেছি। একটি মহল এখন এগুলো নিয়ে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।’

সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদের অতি ‘আপনজন’ হিসাবে পরিচিত বিটিভির বহুল আলোচিত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও বিটিভি ঢাকা কেন্দ্রের সাবেক জিএম মোছা. মাহফুজা আক্তারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মোহাম্মদ সেলিমের নাম রয়েছে পদোন্নতি তালিকার ৩ নম্বরে। পতিত সরকারের আমলে মাহফুজার নেতৃত্বে অনুষ্ঠান বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ লোপাটের আরেক সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন বিটিভির নিয়ন্ত্রক ও মুখ্য নির্দেশক সেলিম। এই সিন্ডিকেটের ২১ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান করছেন দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক নাইমুল ইসলাম। এক বছরের বেশি সময় ধরে অনুসন্ধান চলমান থাকলেও প্রতিবেদন দিচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। এছাড়া ৩ মার্চ থেকে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তও চলমান। এত কিছুর পরও অদৃশ্য ‘জাদুরকাঠি’র বলে পরিবর্তিত সরকারের দায়িত্বশীলদের ‘ম্যানেজ’ করে পদোন্নতি বাগিয়ে নিচ্ছেন সেলিম।

পদোন্নতি তালিকার ৬ নম্বরে আছেন কন্ট্রোলার/ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজার মো. জিল্লুর রশীদের নাম। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করছেন দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক মো. খায়রুল। রহস্যজনক কারণে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান প্রতিবেদন কমিশনে উপস্থাপনে গড়িমসি করছেন তিনি। এই ফাঁকে দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তা পদোন্নতি বাগিয়ে নিচ্ছেন।

বিটিভির সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) আফিফা আফরোজের নাম রয়েছে পদোন্নতি তালিকার ৯ নম্বরে। তার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। একই সঙ্গে তার দুর্নীতির বিভাগীয় তদন্তও চলমান। এরপরও তিনি পদোন্নতি পাচ্ছেন। এছাড়া পদোন্নতি তালিকার ৮ নম্বরে থাকা বিজ্ঞাপন নির্বাহী সোলাইমান খানের বিরুদ্ধেও গোয়েন্দা সংস্থার নেতিবাচক প্রতিবেদন রয়েছে। ১ জানুয়ারি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের টেলিভিশন-১ শাখা থেকে পাঠানো এক চিঠিতে পদোন্নতির জন্য প্রস্তাবিত ১২ জনের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ টেলিভিশনের ১ম শ্রেণির ৪র্থ, ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম গ্রেডভুক্ত শূন্য পদে নিম্নবর্ণিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতির কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের জন্য তাদের এনএসআই প্রতিবেদন প্রয়োজন।’ জানা গেছে, গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইর তালিকায় থাকা ছাত্রলীগ নেতা ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদনে যাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়, দুদক ও বিভাগীয় তদন্ত চলমান আছে সেগুলোও তুলে ধরা হয়েছে। এরপরও সবকিছু উপেক্ষা করে আজ সোমবার কমিটির সভায় ১২ জনের পদোন্নতি চূড়ান্ত করা হবে। এদিকে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ-ক্ষমতাচ্যুত সরকারের দোসররা এক জোট হয়ে বড় অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বিটিভি ও মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেছেন। তারাই সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি পাইয়ে দিতে চালাচ্ছেন নানা তৎপরতা।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews