সম্প্রতি একজন আলোচিত মাওলানাকে নিয়ে অনেক খবর প্রকাশিত হচ্ছে। তিনি ধর্ম-কর্ম নিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য সুপরিচিত। তবে তিনি এবং তার দল কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে আছেন। মাওলানা সাহেব একজন নারীকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন ঢাকার অদূরে এক রিসোর্টে। সেখানে কিছু মানুষ তাকে ঘেরাও করে এবং তিনি তার সঙ্গের নারীকে তার স্ত্রী বলে পরিচয় দেন এবং তারপর অনেক ঘটনা। তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন বলে দাবি করে বলেছেন : 'আমি একাধিক বিয়ে করেছি। ইসলামী শরিয়তে একজন পুরুষকে চারটি বিয়ের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে।' (দৈনিক সমকাল, ৯ এপ্রিল ২০২১)।

আমাদের সমাজে শুধু এই মাওলানাই নন, লাখ লাখ এমন মাওলানা অনেক বছর ধরে দেশের মুসলমানদের বুঝিয়ে এসেছেন যে, ইসলাম ধর্মে একজন পুরুষ চারজন নারীকে বিয়ে করতে পারবেন। মনে রাখতে হবে, ব্যাপারটি কিন্তু এমন নয় যে, একজন স্ত্রী মারা গেলে বা পুরুষটিকে ছেড়ে চলে গেলে আরেকজন নারীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ বা বিয়ে করা যাবে। তা নয়। এই বিষয়টি একই সঙ্গে চারজন স্ত্রীর সঙ্গে বসবাস।

বিষয়টি আমাদের দেশে খুব আলোচনা হয় না। কারণ, সবাই কোরআন শরিফের অর্থ ও ব্যাখ্যা জানানোর ভার মাওলানাদের হাতে ছেড়ে দেন। কিন্তু এর অনুপযুক্ত ব্যাখ্যা আমাদের সমাজে অনেক গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করেছে। আমাদের এই মাওলানা তার সর্বশেষ উদাহরণ।

কোরআনে অক্ষর আছে, শব্দ আছে এবং বাক্য আছে, কিন্তু সব অর্থ আক্ষরিক নয়। অনেক ব্যাখ্যা আছে। প্রেক্ষাপট আছে। সেই ব্যাখ্যাগুলো দিতে পারেন তেমন পণ্ডিত ব্যক্তি এ দেশে ক'জন আছেন? থাকলেও তারা সঠিক ব্যাখ্যা দিতে চান কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

হ্যাঁ, কোরআনে একাধিক বিয়ে সম্মত কিন্তু বহুবার বিয়ে করতেই হবে তা হলফ করে বলা নেই। কোরআন একাধিক বিয়ে করার জন্য কোনো আদেশ করছে না। বরং আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। যখন কোরআন আরবের মানুষের কাছে পাঠানো হয়েছিল, তার আগে সেই অঞ্চলের নারীকুলের অবস্থা কী ছিল বা নর-নারীর সম্পর্ক কেমন ছিল? খুব প্রশংসা করার মতো কিছু ছিল না। সেখানকার পুরুষরা অতিমাত্রায় উচ্ছৃঙ্খল ছিলেন।

বহুগামিতা দু'রকম। ইংরেজিতে বলে 'পলিজিনি' এবং পলিয়ান্দড্রি'। পলিজিনি হচ্ছে একজন পুরুষের একের অধিক স্ত্রী থাকতে পারে এবং পলিয়ান্দড্রি হচ্ছে একজন নারীর একের অধিক স্বামী থাকতে পারে।

ইসলাম ধর্মে পলিজিনি সম্মত কিন্তু পলিয়ান্দড্রির অনুমোদন নেই। একজন পুরুষের একের অধিক স্ত্রী থাকতে পারে কিন্তু একজন নারীর একের অধিক স্বামী থাকতে পারবে না। আসলেই কী একজন পুরুষের একের অধিক স্ত্রী থাকতে পারে?

কোরআনে সুরা আন্‌ নিসাতে নারী-পুরুষের সম্পর্ক এবং বিয়ে নিয়ে আয়াত আছে। শুধু বিয়ে নয়, নারীদের নিয়ে অনেক বিস্তর বর্ণনা, আদেশ ও পরামর্শ আছে। এই লেখায় যেই আয়াতগুলো উদ্ৃব্দতি করছি তার উৎস হচ্ছে 'কোরআন শরিফ :সহজ সরল বাংলা অনুবাদ', হাফেজ মুনির উদ্দিন আহমদ, আল কোরআন একাডেমি, লন্ডন।

সুরা নিসার তৃতীয় আয়াতে বলা হচ্ছে : 'আর যদি তোমাদের এ আশঙ্কা থাকে, তোমরা এতিম (মহিলা)-দের মাঝে ন্যায়বিচার করতে পারবে না, তাহলে (সাধারণ) নারীদের মাঝে থেকে তোমাদের যাদের ভালো লাগে তাদের দুইজন, তিনজন কিংবা চারজনকে বিয়ে করে নাও, কিন্তু যদি তোমাদের এই ভয় হয় যে তোমরা (একের অধিক হলে তাদের মাঝে) ইনসাফ করতে পারবে না, তাহলে (তোমাদের জন্যে) একজনই যথেষ্ট, কিংবা যে তোমাদের অধিকারভুক্ত (তাদেরই যথেষ্ট মনে করে নাও। মনে রেখো, সব ধরনের) সীমালঙ্ঘন থেকে বেঁচে থাকার জন্যে এটাই (উত্তম ও) সহজতর (পন্থা)।'

এই ৩ নম্বর আয়াতটিই মুসলমান (পুরুষ) সমাজে বা ইসলামিক পরিবেশে সবচেয়ে বেশি 'বাজারজাতকরণ' হয়েছে। কোরআনে অনেকবার 'সীমালঙ্ঘন' শব্দটি আছে। এই তৃতীয় আয়াতে 'সীমালঙ্ঘন' শব্দটি কেন এলো? আমরা কি ধরে নিতে পারি যে, একাধিক বিয়ে এক ধরনের সীমালঙ্ঘন?

এই সুরার ১২৯ নম্বর আয়াতে বলা হচ্ছে : 'তোমরা কখনও (একাধিক) স্ত্রীর মাঝে ইনসাফ করতে পারবে না, যদিও (মনেপ্রাণে) তোমরা তা চাইবে, তাই তাদের একজনের দিকে তুমি (বাহ্যিকভাবে) এমনভাবে ঝুঁকে পড়ো না, (মনে হবে) আরেকজনকে ঝুলন্ত অবস্থায় (রেখে দিয়েছো)।'

এই আয়াতটি পড়ে কী মনে হচ্ছে? এই ১২৯ নম্বর আয়াতটিই আমাদের এ অঞ্চলের মাওলানা এবং একই সঙ্গে সুবিধাগামী পুরুষরা উচ্চারণ করেন না, কাউকে জানতেও দিতে চান না। দেশের কোনো মসজিদের খুৎবাতেও এই আয়াতটি বাংলা ভাষায় উচ্চারিত হয় বলে আমার জানা নেই। সাধারণ মানুষের কাছে ১২৯ নম্বর আয়াতটি অজানাই রয়ে যায়।

আয়াতটিই মুসলমান পুরুষদের কাছে আনন্দদায়ক মনে হয়েছে। তারা এই আয়াতকে চারদিকে ছড়িয়ে দিতে বেশি আগ্রহী হয়েছেন। ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে ছিলেন সুযোগ-সন্ধানী, আরাম ও আনন্দগ্রাহী এবং স্বার্থান্বেষীরা। আমরা ১২৯ নম্বর আয়াত নিয়ে কোনো কথা বলি না এবং হয়তো বলতেও চাই না।

পবিত্র কোরআন আসলে কী বার্তা দিচ্ছে? এই-ই বোঝানো হচ্ছে যে, পুরুষরা একের অধিক বিয়ে করতে পারেন, কিন্তু শর্ত সাপেক্ষে। সব ক'জন স্ত্রীর সঙ্গে সমান ব্যবহার করতে হবে এবং এটিও বোঝানো হচ্ছে যে, সবার সঙ্গে সমান ব্যবহার করা সম্ভব নয়। এখন আমি যদি একাধিক বিয়ে করার পর আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলি : 'কই আমার স্ত্রীরা তো কেউ অসন্তুষ্ট নন বা অভিযোগ করছেন না', তাহলে কোরআনের সঠিক শিক্ষা আমি বুঝতে পারছি না। সবার আগে প্রয়োজন কোরআনের শিক্ষা হৃদয়ঙ্গম করা। কোরআন 'আমি' ব্যক্তিটির ভেতরে তাকানোর শিক্ষা দিচ্ছে। আমার নিজেকেই প্রশ্ন করা প্রয়োজন যে, আমি আমার সব ক'জন স্ত্রীর সঙ্গে সমান 'ইনসাফ' করতে পারছি কিনা।

বুঝতে হবে যে, 'ইনসাফ' শব্দটি সামগ্রিক অর্থে বোঝানো হয়েছে। শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক- সব। সবগুলো গুণক একসঙ্গে কাজ করবে। সে কারণেই 'ঝুঁকে পড়া' এবং 'ঝুলন্ত' শব্দগুলো এসেছে। বুঝে রাখা ভালো যে, কোরআনে 'পলিজিনি' আদেশ হিসেবে আসেনি, ব্যতিক্রম হিসেবে এসেছে। 'একের অধিক বিয়ে করতেই হবে'- তা যদি বুঝে থাকেন, তাহলে কোরআনের শিক্ষায় আপনাকে আরও পরিণত হতে হবে। আবারও বলি, কোরআন যেমন করে আপনাকে নামাজ পড়তে আদেশ করে, তেমন করে আপনাকে বিয়ে করতে আদেশ করে না।

কোরআন যখন নাজিল হয়েছিল, তখন পলিজিনি'র অন্ত ছিল না। একজন পুরুষ কতজন নারীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবেন তার কোনো সীমা ছিল না। কোরআন একটি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করেছে, যা পবিত্র গ্রন্থটি পড়লেই বোঝা যায়। পুরুষের আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার জন্য একাধিক বিয়ের কথা বলা হয়নি।

গল্পকার; যোগাযোগ পেশায় নিয়োজিত



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews