এ দেশে ‘উন্নয়ন’ শব্দটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে বহু মানুষের মানসপটে ভেসে ওঠে কতগুলো বিশাল ভৌত অবকাঠামো। প্রশস্ত মহাসড়ক, বিরাট সেতু, দীর্ঘ ফ্লাইওভার, রেলপথ, মেট্রোরেল কিংবা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।

আসলে উন্নয়নের ন্যারেটিভ এভাবেই আমাদের সামনে তৈরি করা হয়েছে দীর্ঘকাল থেকে। কিন্তু ‘উন্নয়ন’ সম্পর্কে প্রথাগত এ ধারণা পৃথিবীতে নেই বহুকাল, সেটি জানি না আমরা অনেকেই। উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভৌত অবকাঠামো কিংবা জিডিপি প্রবৃদ্ধি বা মাথাপিছু আয়ই শুধু নয়, বিবেচিত হয় আরও অনেক কিছু।

উন্নয়নের আলোচনা এলেই আলোচনায় আসে আরেকটি শব্দ-দারিদ্র্য। একটু আগেই যেমন বললাম উন্নয়ন বলতে যা বোঝানো হয় বর্তমান পৃথিবীতে সেটির খবর রাখি না আমরা অনেকেই। ঠিক একই কথা প্রযোজ্য দারিদ্র্যের ক্ষেত্রেও। পৃথিবীতে দারিদ্র্যের ধারণা কোথায় চলে গেছে সেই খোঁজ আমরা রাখি না অনেকেই। আমরা এখনো মনে করি টাকার ভীষণ অভাবই হচ্ছে দারিদ্র্য।

২০১০ সাল থেকে জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনডিপি এবং অক্সফোর্ড পভার্টি অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ দারিদ্র্যকে নতুনভাবে দেখার চেষ্টা শুরু করেছে। এ সংস্থাগুলো নানারকম গবেষণা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সিদ্ধান্তে এসেছে দারিদ্র্য শুধু টাকার অভাবজনিত একমাত্রিক ব্যাপার না, এটি বহুমাত্রিক; তাই তারা এটিকে বলছে ‘মাল্টিডায়মেনশনাল পভার্টি’। এখন বিভিন্ন দেশকে এ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের এদিক থেকে দেখার চেষ্টা করে সূচকও তৈরি হচ্ছে।

এটি নিয়ে বিস্তারিত আলাপের জায়গা এটি না, কিন্তু অল্প কয়েকটি কথা বলে রাখা যাক। বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের ক্ষেত্রে অর্থের অভাবের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার অভাব, খারাপ স্বাস্থ্য, সঠিক মানের কাজের অপ্রাপ্যতা, কাজের সঠিক পরিবেশের অভাব, সঠিক বাসস্থানের অভাব কিংবা অস্বাস্থ্যকর বা বিপজ্জনক এলাকায় বাসস্থান, সমাজে ক্ষমতায়িত হতে না পারা, এমন নানা বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয়।

অর্থাৎ আয়ের দিক থেকে কেউ দারিদ্র্যসীমার নিচে না থাকলেও বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের বিবেচনায় সে যথেষ্ট দরিদ্র হতেই পারে।

মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ নয়। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের আগেই বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে।

মাথাপিছু আয়ে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হলেও চরম বৈষম্যের কারণে এ দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়নি তেমন একটা। তবুও সেই আলোচনা দূরে সরিয়ে রেখে দেখা যাক করোনা মোকাবিলায় এ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের পরিস্থিতি কোথায়।

গত বছর ১০২তম রাষ্ট্র হিসাবে দেশে করোনার অস্তিত্ব ঘোষিত হয়। বিশ্বের প্রথম করোনা শনাক্তের দুই মাস এক সপ্তাহ আর ভারতে শনাক্ত হওয়ার এক মাসেরও বেশি সময় পর বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হয়। অর্থাৎ একটা নতুন মহামারিতে কোন দেশ কোন ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে কোন ধরনের ফল পেয়েছে সেটি আমরা দেখার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেটির খুব ভালো বাস্তবায়ন আমরা দেখিনি।

সারা পৃথিবীতেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হেনেছে। দ্বিতীয় ধাপে মানুষের আক্রান্ত হওয়া এবং মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেশগুলো দ্বিতীয় ঢেউয়ের ক্ষেত্রে আগের ঢেউয়ের তুলনায় ভালো ব্যবস্থাপনা দেখিয়েছে।

এটাই হওয়ার কথা-প্রথমবারের করা ভুলগুলো দ্বিতীয়বার ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে হলো ঠিক উলটো। এ বছরের শুরু থেকে নানারকম অদক্ষতা এবং সমন্বয়হীনতা দেখানোর কারণে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আজ এ পরিস্থিতিতে এসে পৌঁছেছে।

তারপর যখন করোনা তার বীভৎস চেহারা দেখাতে শুরু করল, তারপরও সরকার কি নাগরিকদের জন্য সঠিক ব্যবস্থা নিতে পেরেছে? এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে এক সপ্তাহের জন্য ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ আরোপ করা হয়েছিল। কলকারখানা এবং অফিস-আদালত খোলা রেখে শহরের মধ্যকার এবং দূরপাল্লার গণপরিবহণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল সব অফিসকে তাদের নিজ দায়িত্বে কর্মীদের অফিসে আনতে হবে।

এরপর এক বিপর্যয় নেমে এলো চাকরিজীবীদের জীবনে এবং গণপরিবহণ আবার চালু হলো। ক্ষমতাসীন সরকারটি কি জানে না, এ দেশের অফিসগুলোর এক অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশই শুধু তার কর্মীদের পরিবহণের ব্যবস্থা করে?

এরপর ব্যবসায়ীদের চাপে মার্কেট খুলে দেওয়া হয়। সেই মার্কেটও আবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল সরকার। একটি সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান বলে, মার্কেট খোলা থাকার ব্যাপ্তি যত কম হবে, সেখানে ভিড় বাড়ার আশঙ্কা তত বেশি হবে।

ঘটেছিল ঠিক সেটিই-তথাকথিত ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে’ খোলা মার্কেটে বিকালের দিকে মানুষের ভিড় একেবারে উপচে পড়ছিল। আগের কঠোর বিধিনিষেধটিকে শুরুতে লকডাউন বলা হয়েছিল।

শব্দটি অভিধানে খোঁজ করলেই দেখা যাবে এটি একটি অ্যাবসোলিউট শব্দ-একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে এটা মানুষকে ঘরবন্দি করে রাখার নাম। এর সঙ্গে কোনো বিশেষণের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু কিছুদিন আগেই অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতার ফলে এখন গুরুত্ব বোঝানোর জন্য এ শব্দটির সঙ্গে কঠোর কিংবা সর্বাত্মক ধরনের বিশেষণ যুক্ত করতে হচ্ছে।

১৪ এপ্রিল থেকে এবার আট দিনের জন্য কঠোর লকডাউনের কথা বলা হয়েছে। এটি একেবারেই অবৈজ্ঞানিক। কারণ করোনাভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড ১৪ দিন। ফলে বিজ্ঞান বলে, কমপক্ষে ৩ সপ্তাহ লকডাউন হওয়া উচিত; ৪ সপ্তাহ হলে ভালো। কিন্তু কোনোভাবেই এটি দুই সপ্তাহর কম হতে পারে না। কেউ কেউ বলছেন, এক সপ্তাহ পর নাকি এটি বাড়ানো হবে।

কিন্তু এটিও সঠিক পথ হলো না, কারণ লকডাউনটা সামনে কত সময়ের জন্য আছে সেটি দেখে মানুষ তার জীবনযাপনের পরিকল্পনা করে, তাই সেটি শুরুতেই জানিয়ে দেওয়া উচিত।

এবার প্রাথমিক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, কলকারখানা বাদে সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। আমাদের অনুমানকে সত্য করে এরপরই জানানো হলো ব্যাংক খোলা থাকবে এবং অবিশ্বাস্যভাবে সেটি কম সময়ের জন্য (দুপুর একটা পর্যন্ত) যেটা মানুষের ভিড় বাড়াবে। ব্যাংকের সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হলো শেয়ারবাজার। প্রজ্ঞাপনে বন্ধ করা হয়েছিল সব ধরনের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট।

কিন্তু এখন মধ্যপ্রাচ্যগামী কর্মীদের জন্য বিশেষ ফ্লাইটের কথা বলা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের জন্য এত বড় অঙ্কের রেমিটেন্স উপার্জনকারী মানুষগুলো সময়মতো কর্মস্থলে না যেতে পারলে অনেকের চাকরি থাকবে না এ তথ্য কি এই সরকার জানত না?

এ লেখা যখন লিখছি তখন দেশ ‘কঠোর লকডাউনের’ প্রথম দিনটি পার করছে। এবং আমরা এর মধ্যেই রিপোর্টে দেখছি গার্মেন্টস শ্রমিকরা গণপরিবহণ না পেয়ে যথেষ্ট খারাপ পরিস্থিতিতে পড়েছেন।

অনেক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি কর্মীদের জন্য যাতায়াতের ব্যবস্থা করেনি। ওদিকে লকডাউনকে সামনে রেখে ঈদের মতো গাদাগাদি করে ৫০ লাখের মতো মানুষকে ঢাকা ছাড়তে দেওয়া হয়েছে; অর্থাৎ রোগটি সারা দেশে ভালোভাবে ছড়িয়ে পড়ার প্রচণ্ড ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

জানা গেছে, পরিচয়পত্র থাকার পরও বেশকিছু চিকিৎসক ও নার্স রাস্তায় বাধার মুখে পড়েছেন, এমনকি জরিমানা দিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের মুভমেন্ট পাশ নেই।

চিকিৎসাকর্মীদের এ বিষয়ের আওতামুক্ত রাখা হলেও সেই তথ্য কি মাঠপর্যায়ের পুলিশের কাছে পৌঁছানো যায়নি? এ ছাড়াও বহু চিকিৎসাকর্মী অনুমতি পেলেও হাসপাতালে যাওয়ার মতো যথেষ্ট পরিবহণ খুঁজে পাননি। তাদের কথা ভাবা হয়নি কেন?

ওদিকে মুভমেন্ট পাশ দেওয়ার জন্য একটি ওয়েবসাইট ও অ্যাপ বানানো হয়েছিল, যেটি ‘কঠোর লকডাউন’ শুরুর আগের দিন উদ্বোধন করা হয়। প্রথম দিনই এটির সেবাব্যবস্থা ভেঙে পড়ে সেবাগ্রহীতার চাপে। জরুরি কাজ থাকা বহু মানুষ মুভমেন্ট পাশ নিতে পারেননি। ডিজিটাল উন্নয়নের খুব বড়াই করি আমরা; কিন্তু এমন বিপর্যয় রোধে যথেষ্ট ব্যবস্থা কেন নেওয়া হয়নি?

সর্বশেষ, একটি মোটামুটি মানের লকডাউন দেশের সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষগুলোর জীবিকায় ভীষণ ক্ষতি তৈরি করে। গবেষণা সংস্থা সানেমের সম্প্রতি প্রকাশিত একটি রিপোর্ট আমাদের জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করা মানুষের সংখ্যা ৪২ শতাংশ, যা করোনা শুরুর আগের সময়ের দ্বিগুণ। ১৪ এপ্রিল যে লকডাউন শুরু হয়েছে সেই এক সপ্তাহের জন্য সরকার ৫৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে যা বিতরণ করা হবে ১ কোটি ২৫ লাখ পরিবারের কাছে।

প্রতি পরিবারে পাঁচজন সদস্য হলে ব্যক্তিপ্রতি প্রতিদিনের বরাদ্দ মাত্র ১৩ টাকা। কিন্তু এর চেতেও অবিশ্বাস্য কথা হচ্ছে এ টাকা বিতরণ শুরু হয়নি। এখানে আরেকটা তথ্য যুক্ত করে রাখা প্রাসঙ্গিক-পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এক সাম্প্রতিক গবেষণা আমাদের জানায় সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দের ৪৬ শতাংশই সঠিক দরিদ্র মানুষটার কাছে পৌঁছে না।

করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনাগত সংকট খুব স্পষ্টভাবে আমাদের সামনে এসেছে। দেশের জিডিপির তুলনায় খুব সামান্য টাকা খরচ করলে, এমনকি কোনো টাকা খরচ করা ছাড়াও নেওয়া যেত এমনসব পদক্ষেপও নিতে গিয়ে সমন্বয়হীনতা, দুর্নীতি এবং ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা দেখা গেছে। নাগরিক হিসাবে এটি দেখা খুবই হতাশার ব্যাপার আমাদের জন্য।

যে দেশের আর্থিক সামর্থ্য কম সে দেশ ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা দিয়ে আর্থিক দুর্বলতা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করবে, এটাই প্রত্যাশা।

ডা. জাহেদ উর রহমান : শিক্ষক, অ্যাক্টিভিস্ট



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews