হংকং-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদপত্র তথা আঞ্চলিক ভূরাজনীতির বিশ্লেষণের জন্য সুপরিচিত দ্য সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট ব্যাংককে মুহাম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক বৈঠক নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, যাতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ আছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যেকার এই দ্বিপাক্ষিক বৈঠকটি যে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ক্ষেত্রেও প্রভূত মনোযোগ আকৃষ্ট করতে পেরেছে, এই রিপোর্টই তার প্রমাণ।
ওই পত্রিকাটি বলছে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের তিক্ততার মধ্যেও এই বৈঠকটিকে একটি ‘কুলিং-অফ’ মুহূর্ত হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। তাদের রিপোর্টের শিরোনামও হলো ‘মোদি-ইউনূস মিটিং আ কুলিং-অফ মোমেন্ট ইন স্ট্রেইনড ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ টাইজ’!
বিভিন্ন বিশ্লেষককে উদ্ধৃত করে দ্য সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট আরও দাবি করছে—বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যেকার গভীর পারস্পরিক সন্দেহ আর আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহে দুই দেশের সম্পর্ক আবার নতুন করে গড়ে তুলতে অনেক সময় লাগবে। কিন্তু তার মধ্যেও ব্যাংককের এই বৈঠকটিকে বলা যেতে পারে— একটি ‘ট্যাকটিকাল পজ’ বা কৌশলগত বিরতি।
পত্রিকাটির বিশ্লেষণে যে মূল পয়েন্টগুলো উঠে এসেছে তা এরকম:
১. গত বছর আগস্টে ভারতের দীর্ঘদিনের মিত্র শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কে লাগাতার অবনতি ঘটেছে। হাসিনার আকস্মিক দেশত্যাগে ভারত সে দেশে শুধু একজন নির্ভরযোগ্য সঙ্গীকেই হারায়নি, সে দেশে যে নতুন নেতৃত্ব এসেছে— তারা যেহেতু বিশ্বের অন্যান্য শক্তিগুলোর প্রতিও অনেক বেশি ‘ওপেন’– তাই ভারতও তাদের প্রতি নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতি ‘রিক্যালিব্রেট’ করতে বা নতুন করে সাজাতে বেশ হিমশিম খাচ্ছে!
২. ঢাকা এই বৈঠককে ‘অত্যন্ত গঠনমূলক ও ফলপ্রসূ’ বলে বর্ণনা করেছে, আর দিল্লি বলেছে— যাবতীয় দ্বিপাক্ষিক ইস্যু ‘গঠনমূলক আলোচনার মাধমে’ নিষ্পত্তি করতে দুই নেতাই একমত হয়েছেন। কিন্তু এই কূটনৈতিক সৌজন্যের আড়ালে দুই নেতার মধ্যে যে বেশ তীক্ষ্ণ বাক্যবিনিময় হয়েছে তা কিন্তু স্পষ্ট।
এই পটভূমিতেই দ্য সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট বলছে, এই বৈঠক দুই দেশের মধ্যে সংলাপের একটা বিরল সুযোগ এনে দিয়েছিল ঠিকই– কিন্তু এটাকে ঠিক ‘ব্রেকথ্রু’ বলাটা ঠিক হবে না! বরং টানা বেশ কয়েক মাসের উথালপাথাল এবং আঞ্চলিক সমীকরণগুলোর পরিবর্তনের পর এটা ছিল দু’পক্ষের জন্যই সম্পর্কটা ঝালিয়ে নেওয়ার ও পর্যালোচনার একটা মুহূর্ত বা ‘ট্যাকটিকাল পজ’!
এই রিপোর্টটির জন্য পত্রিকাটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিশ্লেষকদের সঙ্গেও কথা বলেছে।
ক. লন্ডন-ভিত্তিক লেখক, বাংলাদেশ-গবেষক ও জিওপলিটিক্যাল অ্যানালিস্ট প্রিয়জিত দেবসরকার বৈঠকটি নিয়ে বেশ ইতিবাচক, কারণ তিনি মনে করছেন— এটি ‘শেষ পর্যন্ত পারস্পরিক উন্নয়ন আর সমৃদ্ধিকরণের মহাসড়কে যাওয়ার পথই প্রশস্ত করবে।’
তিনি সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এমন কিছু গভীর শিকড় আর সংযোগ আছে, যেগুলো আলাদা করা সম্ভব নয়। ফলে নিজেদের মধ্যে সম্পর্কের ব্যাপারে উভয় দেশকেই বাস্তববাদী (প্র্যাগম্যাটিক) হতে হবে।’
খ. ব্যাংককে আসার ঠিক আগেই মুহাম্মদ ইউনূস চীন সফরে গিযেছিলেন এবং সেখানে তিনি চীনা বাণিজ্য প্রতিনিধিদের উদ্দেশে বলেন, ‘ভারতের স্থলবেষ্টিত (ল্যান্ডলকড) উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সমুদ্রপথে পৌঁছনোর রাস্তা বাংলাদেশের ভেতর দিয়েই এবং চীন ওই অঞ্চলে বিনিয়োগ করলে অর্থনীতি লাভবান হবে।’ ড. ইউনূসের এই বার্তা ভারতে রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। ভারতে বিশ্লেষকরা মনে করেন, চীনের নেতৃত্বে ওই অঞ্চলে কোনও অবকাঠামো প্রকল্প হাতে নেওয়া হলে তা উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে।
লন্ডনের কিংস কলেজে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক হর্ষ ভি পান্থ এই প্রেক্ষাপটেই সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে বলেছেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার তুলনামূলকভাবে ছোট দেশগুলো বরাবরই ভারত ও চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের মধ্যে একটা ভারসাম্য রেখে চলতে চেষ্টা করে। কিন্তু এখন দিল্লিতে এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, বাংলাদেশের নতুন নেতৃত্ব তাদের সব ডিম চীনের ঝুড়িতেই রাখার চেষ্টা করছে!’
অধ্যাপক পান্থ আরও বলছেন, গত কয়েক মাসের অস্থিরতার পর ব্যাংককের বৈঠকে দু’পক্ষ পরস্পরকে ‘বুঝবার ও মেপে নেওয়ার’ চেষ্টা করেছে বলেই তিনি মনে করেন। ‘তবে এখনই কোনও বড় মাপের সমঝোতা হবে বলে মনে হয় না, তবে রেটোরিকের মাত্রাটা একটু কমিয়ে আনার এবং সম্পর্ককে কিছুটা স্বাভাবিক পর্যায়ে নেওয়ার চেষ্টাটা আমি দেখতে পাচ্ছি’, জানিয়েছেন তিনি।
গ) ভারতের ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও দীর্ঘদিনের বাংলাদেশ গবেষক শ্রীরাধা দত্ত আবার বলছেন, শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে ‘লিমিটেড এনগেজমেন্টে’র সিদ্ধান্ত নিয়ে ভারত ভুল করেছিল বলেই তিনি মনে করেন। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ইমলামপন্থিদের দখলে গেলো বলে– এ ধরনের প্রচার চালিয়ে ভারতের মিডিয়াও ঢাকার নতুন নেতৃত্বকে নিয়ে উদ্বেগ আর জল্পনায় ইন্ধন দিয়েছিল।’
শ্রীরাধা দত্তর মতে, ভারত আসলে বাংলাদেশকে তখন এমন একটা ‘ইমোটিভ লেন্স’ বা আবেগের চশমা দিয়ে দেখেছিল যে, তারা মনে করেছিল— নতুন সরকারের আমলে পরিস্থিতির অবনতি হতে বাধ্য! অথচ সেই মুহূর্তে বাংলাদেশ স্থিতিশীলতা আনার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কিন্তু ভারত ‘তখন সম্ভাব্য অন্য দৃশ্যপট’ কী কী হতে পারে, তা পরখ করেই দেখেনি।
পারস্পরিক আস্থা আবার আগের মতো পর্যায়ে ফিরিয়ে আনতে অনেক সময় লাগবে, সেটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। ‘মোদি-ইউনূস বৈঠক একটা ভালো সৌজন্যমূলক পদক্ষেপ ছিল, কিন্তু এর মধ্যে তার চেয়ে বেশি কিছু খুঁজতে যাওয়ার অর্থ হয় না।’
‘মনে রাখতে হবে ভারতের প্রধান লক্ষ্য হলো— বাংলাদেশ যাতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বহুদলীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যায় সেটা নিশ্চিত করা। দ্বিপাক্ষিক স্তরে (দুই নেতার মধ্যে) এই খোলামেলা কথাবার্তা সেই লক্ষ্যে অবশ্যই সহায়ক হবে’ মন্তব্য করেন শ্রীরাধা দত্ত।