মাছরাঙা। উজ্জ্বল রঙের ছোট বা মাঝারি আকৃতির পাখি। গ্রামের আঁকাবাঁকা পথের ধারের ছোট-বড় পুকুরের পাড়ঘেঁষে বা বাঁশের খুঁটিতে দেখা মেলে অনিন্দ্য শিকারি মাছরাঙার। অ্যালসিডিনিস উপবর্গের সব প্রজাতিই মাছরাঙা নামে পরিচিত। এ উপবর্গের Alcedinidae (গাঙ মাছরাঙা), Halcyonidae (গেছো মাছরাঙা) ও Cerylidae (পান মাছরাঙা) এই তিন গোত্র রয়েছে। বিশ্বে প্রায় ৯০ প্রজাতির মাছরাঙা দেখা যায়। এদের প্রায় সবারই দেহের তুলনায় মাথা বড়, লম্বা, ধারালো ও চোখা চঞ্চু, খাটো পা ও খাটো লেজ রয়েছে। বেশিরভাগ মাছরাঙার দেহ উজ্জ্বল রঙের। স্ত্রী-পুরুষে সামান্য ভিন্নতা দেখা যায়। অধিকাংশ মাছরাঙা বিষুবীয় অঞ্চলে বসবাস করে এবং এদের বড় একটা অংশকে কেবলমাত্র বনে দেখা যায়। এরা অনেক ধরনের প্রাণী শিকার করে। তবে তার বড় একটি অংশ জুড়ে রয়েছে মাছ। এরা সাধারণত ডালে থেকে ডাইভ দিয়ে পানির মধ্য থেকে মাছ শিকার করে। অন্যান্য শিকারের মধ্যে রয়েছে পোকামাকড়, ব্যাঙ, সরিসৃপ, পাখি এমনকি ছোট আকারের স্তন্যপায়ী। মাছরাঙা সাধারণত জলাশয়ের পাশে খাড়াপাড়ের গর্তে বাসা বানায়।
পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামগুলোতে গেলে কখনো নদীর পাড়ঘেঁষে, কখনো গ্রামের আঁকাবাঁকা পথের ধারে ছোট-বড় পুকুরের বাঁশের খুঁটিতে দেখা মেলে অনিন্দ্য এই শিকারি পাখির। তবে গ্রামে পাতি মাছরাঙা বেশি দেখা যায়। এই মনকাড়া পাখিরও নানা নাম আছে। উপকূলে যেসব মাছরাঙা দেখা যায় তার মধ্যে অন্যতম পাতি মাছরাঙা, সাদাবুক মাছরাঙা, বাদামিডানা মাছরাঙা, ছোট মাছরাঙা, কলার্ড মাছরাঙা, পাকড়া মাছরাঙা ইত্যাদি। এই পাখিটি যেখানে একটু পানি আছে সেখানেই খুঁটির ওপর ওতপেতে থাকে। এদের মাছ শিকারের কৌশল আলাদা রকম। পাখিটির বিচক্ষণতা আছে বলেই মানুষের দেখামাত্র স্থির থাকে না। তবে এরা শান্ত প্রকৃতির, তবে মাছ ধরায় পটু। নীরব ও চুপচাপ ত্বরিতগতিতে পুকুরে মাছ শিকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পানির গভীরেও প্রবেশ করতে দ্বিধা করে না। অনেক পাখির ভিড়ের মধ্যে মাছরাঙা রূপের গুণে অন্যতম।
মাছরাঙার প্রধান খাদ্য মাছ হলেও পানির নানা পোকা খাদ্য হিসাবে খায়। পাখিটির ডিমের রং চকচকে সাদা। হেমন্তের পর বসন্তে স্ত্রী-পুরুষ জোড়া বাঁধে। তারপর তৈরি করে বাসা। অন্য পাখির চেয়ে প্রখরতা আছে বলে বাসা আলাদা রকমের হয়। বাসা সহজে কেউ চিনতে পারে না। তবে যেসব জায়গায় শীতকালে পানি জমে যায়, সেসব জায়গার মাছরাঙারা অন্যত্র যাওয়ার সংকেত অনুমান করতে পারে। একসময় গ্রামের নদ-নদীর ঝোঁপে, বিলে, ঝিলে, ধানখেতে, পুকুর পাড়ে, জমে থাকা অল্প পানিতে মাছরাঙা দেখা যেত। পাশাপাশি ঘুমভাঙা সকালে ও গোধূলির ঘনঘটায় দেখা যেত সাদা বক, কালি বকের ওড়াউড়ি। তারাই গ্রামের চিরায়িত প্রতিচ্ছবি।
গ্রামগঞ্জের মাঠে-ঘাটে, বন-জঙ্গলে, গাছে গাছে মাছরাঙা পাখিসহ নানা ধরনের পাখি দেখা গেলেও কালের আবর্তে এখন চিরচেনা সেই পাখির দেখা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বনাঞ্চলের পরিবেশ দূষণ, নির্বিচারে গাছ কাটা, জমিতে কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার, পাখির বিচরণ ক্ষেত্র ও খাদ্য সংকট আর জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে বিলুপ্তির পথে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন পাখি।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা শুভেন্দু সরকার জনান, অবাধে পাখি শিকারের কারণে এখন আর গ্রামগঞ্জেও আগের মতো পাখির দেখা মেলে না। জলাশয়ের অভাবে মাছরাঙা বাসা তৈরি করতে পারে না। আবার তুলমামূলক কম জলাশয়ের মাছ শিকার করায় পাখির খাদ্য সংকট বাড়ছে। নানা প্রজাতির পাখির বাসস্থানের সংকট। ফলে দিন দিন পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে।