পাঁচ শতাংশ কোটা কমিয়ে এক শতাংশ করে আদালত যে রায় দিয়েছেন, তা আদিবাসীদের জন্য মানবিক, ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত হয়নি বলে আমরা মনে করছি।
খ্রিষ্টিনা খংলার কথা হয়তো কারো কারো মনে আছে। আদিবাসী তরুণ-তরুণীদের তো বটেই, আদিবাসীদের আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গী-সহমর্মী বাঙালিদেরও ভুলবার কথা নয় খ্রিষ্টিনার কথা।
খ্রিষ্টিনার কথা মনে পড়ল, আদিবাসীদের জন্য চাকরিতে পাঁচ শতাংশের পরিবর্তে এক শতাংশ কোটা বরাদ্দ কতটা যৌক্তিক হয়েছে, তা ভাবতে গিয়ে। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কুকিজুড়িপুঞ্জিতে খ্রিষ্টিনাদের বাস। আদিবাসী খাসিরা নিজেদের গ্রামগুলোকে বলে পুঞ্জি। কুলাউড়া থেকে মুড়ইছড়াপুঞ্জি পর্যন্ত একটা জায়গায় সিএনজিচালিত অটোরিকশাতে করে যাওয়া যায়। এরপর গাড়ি, এমনকি বাইসাইকেলে করেও চলার পথ নেই। সেখান থেকে কুকিজুড়িপুঞ্জিতে যাওয়ার একমাত্র উপায় পদদল। পায়ে হেঁটে কয়েকশ ফুট উঁচু কয়েকটি ছোট পাহাড় আর পাহাড়ি ঝিরি পেরিয়ে কুকিজুড়িতে পৌঁছাতে হয়। এই দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ২০২১ সালের ২৭ অগাস্ট খ্রিষ্টিনাকে দাঁতের ডাক্তার দেখাতে কুলাউড়া নিয়ে যাচ্ছিলেন ওর বাবা রাজ নংরুম। পথে ছোট্ট মেয়েটির সামনে ওর বাবাকে মারধর করে বাঙালিরা।
ওই ঘটনার পর কয়েকজন লেখক-শিক্ষক-সাংবাদিকসহ আমরা আদিবাসী অধিকার আদায়ের কর্মীরা গিয়েছিলাম সেখানে। সরেজমিনে ওখানে গিয়ে জানলাম, সামাজিক বনায়নের নামে বাঙালিদের পানজুম করায় বাঁধা দেওয়ার কারণে খাসিদের ওপর এমন সব হামলা চালানো হচ্ছিল। সমাজিক বনায়নের কথিত উপকারভোগী বাঙালিরা বনের যে সব জায়গায় গাছপালা কমে গেছে, সেখানে বন সৃজনের নামে পানজুম করতে শুরু করলে আদি পানচাষি খাসিদের সঙ্গে বিরোধ শুরু হয়। বাঙালিদের এমন উদ্যোগ আসলে খাসিদের পেটে লাথি দেওয়ার মতো। এখনও আদিবাসী এই জাতিটির জীবন-জীবিকার প্রধান উৎস পানচাষ এবং সামাজিক বনায়নে পানচাষের অনুমোদন ছিল না।
এই লেখাটি লেখার সময় খোঁজ নিলাম খ্রিষ্টিনা এখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। আশা করি, একদিন ছোট্ট মেয়েটি বড় হবে, উচ্চশিক্ষিত হয়ে একটি চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করবে। যদিও নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি আদিবাসী শিশুদের পড়াশোনা শুরু করার ক্ষেত্রে ভাষা একটা বড় সংকট। আদিবাসী শিশুদের কাছে শিক্ষার শুরুটা এখনও ভীতিকর অবস্থার মধ্যেই রয়ে গেছে বলে ‘আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষা শিক্ষা’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এমন তথ্য পাওয়া যায়। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কাপেং ফাউন্ডেশন, যারা আদিবাসীদের মানবাধিকার সম্পর্কিত কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে, তাদের উদ্যোগে এ গবেষণাটি করা হয়েছিল ২০২২ সালে।
যদিও নিজের অভিজ্ঞতা থেকে পড়াশোনা শুরুটা কত কঠিন, এটা আদিবাসীদের প্রত্যেকের জানা আছে। আমরা কতটা দুরূহ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি, সেটা বলবার জন্য কোনো গবেষণার প্রয়োজন হয় না। তবু ওই গবেষণাটির উদ্ধৃতি দিচ্ছি, বিষয়টিকে অধিকতর যুক্তিগ্রাহ্য করার জন্য।
‘আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষা শিক্ষা’ শীর্ষক প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী তালিকা’য় ৫০টি জাতির কথা বলা হলেও সরকারি উদ্যোগে এখন পর্যন্ত মাত্র পাঁচটি ভাষায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাউপকরণ তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষা উপকরণ তৈরি করা হলেও পাঠদানের মতো শিক্ষক নেই কোথাও। অথচ ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে স্পষ্ট করে ‘আদিবাসী শিশু যেন নিজেদের ভাষা শিখতে পারে, সেই লক্ষ্যে তাদের জন্য আদিবাসী শিক্ষক ও পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা করা’র কথা বলা আছে। সরকার স্বীকৃত তালিকার ৫০টি ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’র মধ্যে কমপক্ষে ৩০টি ভাষার প্রচলন রয়েছে। শুরুতে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের জন্য তালিকাভুক্ত ছয় জাতির মধ্যে সাঁওতালরা বর্ণমালা বিতর্কে বাদ পড়ে গেছে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, বর্ণমালা থাকা না থাকা প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা-উপকরণের তৈরিতে খুব জরুরি নয়। জরুরি হচ্ছে শিশুদের কাছে বোধগম্য ভাষায় শিক্ষা দানের উদ্যোগ। প্রয়োজন প্রশিক্ষিত শিক্ষক এবং শিক্ষা উপকরণ।
প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, ইতোমধ্যে যে পাঁচটি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা হয়েছে, তারা সংখ্যালঘু জাতিগুলোর মধ্যে সংখ্যা এবং শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে থাকা। অথচ মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা এবং বিপণ্নদের ভাষাকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনা করা উচিত। উদাহরণ হিসেবে দিনাজপুরের কড়াদের কথা বলা হয়। তাদের ১০০ মানুষ এবং আনুমানিক ৩০ জন শিশুর জন্য একটি মাত্র স্কুল প্রয়োজন। কডা, পাত্র, খাসিদের জন্যও একই কথা প্রযোজ্য বলে দাবি করা হয়েছে। তবে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের সব জনগোষ্ঠীর নিজ নিজ মায়ের ভাষায় পড়তে শেখার সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি। ‘মাতৃভাষায় শিক্ষা’ বলতে প্রথমে যার যার মাতৃভাষার মৌখিক ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। অথচ এর বদলে তাদের ভাষার লিখিত রূপ বা নিজস্ব হরফ আছে কিনা, এমন বিভ্রান্তিপ্রসূত গৌণ প্রশ্নের সঙ্গে শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করার তাগিদকে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে।
এমন অবস্থায় খ্রিষ্টিনা খংলারা অন্যান্য সকল আদিবাসী শিশুর মতো ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই নিজেদের মায়ের মুখ থেকে শিখছে এক ভাষা (মাতৃভাষা) আবার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পা দেওয়ার পর থেকেই তাদেরকে নতুন করে করতে হচ্ছে বাংলা কিংবা ইংরেজি ভাষা রপ্ত করার সংগ্রাম। নতুন ভাষা শেখার বাধ্যবাধকতাকে অনেকেই ‘সুযোগ’ হিসেবে দেখলেও আদিবাসী শিশুদের মনোজগতের উপর যে নিদারুণ নিপীড়ন এযাবৎকাল ধরে চলে এসেছে সেটাই আজকালকার যুগে হয়ে উঠেছে স্বাভাবিকতা। ফলে বাংলা কিংবা ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করে ভালো ফলাফল অর্জন করা তাদের জন্য প্রকৃতপক্ষে দুরূহ হয়ে পড়ে। এর ফলে খ্রিষ্টিনা খংলাসহ আদিবাসীদের ঝরে পড়ার হারও অনেক বেশি। তাই খাসি পুঞ্জির একজন আদিবাসী শিক্ষার্থীর সঙ্গে ঢাকা বা অন্যান্য শহরের উন্নত স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সুযোগ পাওয়া একজন শিক্ষার্থীকে তুলনা করা বা সমান চোখে দেখা কখনোই যৌক্তিক বলে আমি মনে করি না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আঙ্গিনা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সব একাডেমিক স্তরে খ্রিষ্টিনাদের মতো আদিবাসীদের যে ধরণের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তা মূলধারার একজন শিক্ষার্থীর অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কেননা, খ্রিষ্টিনার মতো আদিবাসীরা জানে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ভাষা এবং ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ও দারিদ্র্যপীড়িত পরিবার-সমাজ থেকে উঠে এসে মূলধারার জনগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়া ভাষা, সংস্কৃতি ও সিলেবাস অনুযায়ী তাকে পড়াশুনা করে ভালো ফলাফল অর্জন করা এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কথিত মেধার লড়াইয়ে এগিয়ে থেকে কোনো পেশাগত পদ বা চাকরি অর্জন করা কতটা কঠিন একটি কাজ, তা ভেবে দেখুন। তাই আমি মনে করি সকলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারা পর্যন্ত আদিবাসীদের সমান চোখে দেখা বা সমান প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেয়া যুক্তিযুক্ত নয়, এর ফলে এরা বরং দিনকে দিন আরো পেছনে পড়ে থাকবে। তারপরও তাদের এমনটিই করা হলো, তারা অচিরেই হোঁচট খাবে এবং প্রান্তিক থেকে আরও বেশি প্রান্তিকতার শিকার হবে এবং সামগ্রিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ায় আমলাতন্ত্রের যে ভূমিকা সেখানে আদিবাসীদের অংশগ্রহণ অনেক অনেক কমে যাবে। আদিবাসীদের জন্য কোটা সংরক্ষণ কোনো করুণা নয়– এটা তাদের অধিকার।
কোটাপদ্ধতি বাতিল হওয়ার আগে ৩৮তম বিসিএসে আদিবাসীদের ২১ জন সুপারিশ পেয়ে সরকারি চাকরি পান। তাদের মধ্যে প্রশাসনে ১০ জন। অন্যরা পররাষ্ট্র, পুলিশসহ সাতটি ক্যাডারে গিয়েছিলেন। কোটা বাতিল হওয়ার পর দুটি সাধারণ বিসিএসের (৪০ ও ৪১তম) ফলাফলে একজন করে সুপারিশ পেতে দেখা গেছে। তাদের একজন ৪০তম বিসিএসে নিরীক্ষায় এবং অন্যজন ৪১তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুযোগ পেয়েছেন।
কোটাবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা হয়ে গেছে। প্রাণক্ষয়ের ঘটনা ঘটেছে উভয়পক্ষে। এত কিছুর পর সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে কোটা সমস্যার একটা মীমাংসাও করে দেওয়া হয়েছে। এটা নিশ্চয়ই ২০১৮ সালের সব কোটা বাতিল করে দেওয়ার চেয়ে ভালো হয়েছে, অন্তত মন্দের ভালো তো বলা যায়।
২০১৮ সালেও কোটাপ্রথার যৌক্তিক সংস্কার চাওয়া হয়েছিল, এবারও আন্দোলনকারীরা অভিন্ন দাবি জানিয়েছিল। স্পষ্ট করে বলতে গেলে, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছিল, সেটাই ছিল ক্ষোভের প্রধান কারণ। কেননা, জাতির গর্ব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানিয়ে সংরক্ষণ করা ওই কোটার সুবিধা তারা ভোগ করেছেন। পরে তাদের সন্তানসন্ততিরাও পেয়েছেন। সবশেষে পাচ্ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় প্রজন্ম, নাতি-নাতনিরা।
আদালতের নির্দেশনায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে পাঁচ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করা হয়েছে, সেটি যদি শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানের জন্য প্রযোজ্য হয়, তাহলে এর কোনো উপযোগিতা থাকবে না। অবশ্য এরই মধ্যে গণমাধ্যমে দেখলাম মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজ্জাম্মেল হক বলেছেন, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়টি নিয়ে আবার আপিল বিভাগে যাওয়ার কথা ভাবছেন তারা। ২৬ জুলাই নরসিংদীতে তিনি এক সভায় বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের আর চাকরির বয়স নেই, এই বিষয়টি আদালতকে জানাবেন তারা। “মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু এটি মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয় নয়। বরং বিষয়টি মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতি এবং তাঁদের নাতি-পুতিদের নিয়ে”– সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তানিয়া আমীর এক নিবন্ধে এমনটাই লিখেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের কন্যা। তার ওই নিবন্ধের আরো একটি অংশ উল্লেখ করতে চাই– “বীর মুক্তিযোদ্ধারা সমাজের অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নন, তাঁরা অগ্রগামী সৈনিক। তাঁদের অনগ্রসর বলা হলে আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করা হবে। আমাদের সংবিধানপ্রণেতারা মুক্তিযোদ্ধাদের অনগ্রসর হিসেবে চিহ্নিত করেননি। বঙ্গবন্ধু যখন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, তা ছিল সংবিধান প্রণয়নের আগে।”
হয়তো শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরপ্রজন্ম কিছু রয়ে গেছে। তাদের জন্য বিশেষ কিছু সরকার করবে কিনা, এ নিয়ে আদিবাসীদের তর্ক করবার কিছু নেই। তবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আমাদের একটা দিশা দেখিয়েছেন, আমরাও নিশ্চয়ই আবার আপিল বিভাগে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি। বলতে পারি, সরকারের ‘ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী তালিকা’র ৫০টি জাতিগোষ্ঠীর অধিকাংশের মধ্যে আজ পর্যন্ত একজনও প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি পায়নি। বলে রাখা ভালো আমরা আদিবাসীরা নিজেদের এই ‘ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী’ শব্দবন্ধে চিহ্নিত করতে নারাজ, এটা আমাদের অপছন্দ। সরকারি ‘ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী তালিকা’র বাইরে আরও অনেক আদিবাসী রয়ে গেছে এখনও। যেমন কড়া আর কডা। তালিকায় দিনাজপুরের কড়াদের কথা থাকলেও নেই রাজশাহী অঞ্চলে বসবাসকারী কডাদের কথা। অথচ কডাদের ভাষা নিয়ে রীতিমতন পিএইচডি গবেষণা হয়েছে। তালিকাভুক্ত কড়াদের সংখ্যা মাত্র শখানেক। তাদের মধ্য থেকে একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া ছেলেটি, লাপোল কড়া পড়ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওই জাতিগোষ্ঠীর একজনও সরকারের কোনো স্তরে চাকরি পায়নি আজ পর্যন্ত। শুরুতে খাসি জনগোষ্ঠীর যে খ্রিষ্টিনার কথা বলছিলাম, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন উচ্চশিক্ষিত নারী আছেন, কিন্তু সরকারের উচ্চপর্যায়ে কারোর স্থান তো দূরের কথা, সরকারি চাকরিও পাননি। পাহাড়ের আদিবাসীদের মধ্যে সংখ্যায় চতুর্থ এবং বাংলাদেশের আদিবাসীদের পঞ্চম অবস্থানে থাকা ম্রোদের মধ্যে একজনও সরকারের প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের কর্মকর্তা নেই। বম, পাঙ্খোয়া, খিয়াং ও খুমিদেরও একই অবস্থা।
বাংলাদেশে বাঙালির বাইরে পার্বত্য চট্টগ্রাম, গারো পাহাড়ের পাদদেশ এবং সমতলে অন্তত ৫৪টি ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষির ৪০ লাখের অধিক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করে। আদিবাসীর সংখ্যা নিয়েও চলে রাজনীতি– ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৬ লাখ ৫০ হাজার ১৫৯ জন ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’র মানুষ রয়েছে, যাদের মধ্যে ৮ লাখ ২৪ হাজার ৭৫১ জন পুরুষ ও ৮ লাখ ২৫ হাজার ৪০৮ জন নারী।
২০২২ সালের শুমারিতে বিভাগ অনুযায়ী, বরিশালে জনসংখ্যা ৪ হাজার ১৮১ জন, চট্টগ্রামে ৯ লাখ ৯০ হাজার ৮৬০, ঢাকায় ৮২ হাজার ৩১১, খুলনায় ৩৮ হাজার ৯৯২, ময়মনসিংহে ৬১ হাজার ৫৫৯, রাজশাহীতে ২ লাখ ৪৪ হাজার ৫৯২, রংপুরে ৯১ হাজার ৭০ ও সিলেটে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৪ জন।
৫০টি জাতিসত্তার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগোষ্ঠী চাকমাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি– ৪লাখ ৮৩ হাজার ২৯৯। সংখ্যার দিক দিয়ে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অবস্থানে আছে পার্বত্য চট্টগ্রামেরই দুই জাতিগোষ্ঠী মারমা ও ত্রিপুরা। মারমাদের সংখ্যা ২ লাখ ২৪ হাজার ২৬২ আর ত্রিপুরাদের সংখ্যা ১ লাখ ৫৬ হাজার ৫৭৮। চতুর্থ স্থানে আছে সমতলের জাতিগোষ্ঠী সাঁওতাল। তাদের সংখ্যা ১ লাখ ২৯ হাজার ৪৯ জন।
জেলার নিরিখে দেশে রাঙামাটিতে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এ জেলায় এসব জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা ৩ লাখ ৭২ হাজার ৮৬৪। এরপরই আছে আরেক পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি। এখানে জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩৭৮।
আমি এরই মধ্যে বলেছি, আদিবাসীদের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। আমাদের নেতৃস্থানীয়দের দাবি, এই সংখ্যা ৩০ লাখের কম হবে না। ২০১১ সালের আদমশুমারিতে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’র জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ১৪১, যা দেশের মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ১০ শতাংশ। এর মধ্যে ৭ লাখ ৯৭ হাজার ৪৭৭ জন পুরুষ ও ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৬৬৪ জন নারী।
সর্বশেষ জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ বছরে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’র জনসংখ্যা মাত্র ৬৪ হাজার বেড়েছে এবং এর ফলে দেশের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে আদিবাসীরা। এই সব শুমারিতে যে আস্থা রাখার কোনো সুযোগ নেই, তার একটি ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যায় ২০১১ সালের শুমারি থেকে। ২০১১ সালের ওই শুমারিতে দেখানো হয়েছিল পটুয়াখালীতে চাকমাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। অথচ একদা রাখাইন অধ্যুষিত এই জেলাটিতে এখন আর রাখাইনরাও উল্লেখ করার মতো সংখ্যক নেই এবং চাকমারা কোনো দিনই ছিল না।
ঐতিহাসিকভাবে আমাদের এ জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা নানা শোষণ-বঞ্চনা ও প্রান্তিকতার শিকার। সংখ্যার রাজনীতি দিয়ে তাদের এক শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার ফলে এক শতাংশ কোটা বরাদ্দের যৌক্তিকতা তৈরি হয়। যদিও কোটা থাকার পরও বরাদ্দ কোটায় চাকরি না দেওয়ার অনেক ঘটনা আছে। সেই সব ঘটনার দুয়েকটি বলি, ২০১০ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জে পুলিশের কনস্টেবল ও সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পরীক্ষায় আদিবাসী প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত কোটা শুধু উপেক্ষা করা হয়নি, রীতিমতন প্রার্থীদের অপমান করার ঘটনাও ঘটানো হয়েছিল। ২০১৬ সালে যাবতীয় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সাতক্ষীরায় আদিবাসী কোটায় চাকরি হয়নি মুণ্ডা মেয়ে বিথীকার। এমন কত কত ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে বিফল হয়েছি আমরা। তখন আদিবাসীদের কোটা ছিল পাঁচ শতাংশ, এখন তা নামিয়ে আনা হয়েছে, এক শতাংশে।
কিন্তু এটা সংখ্যাতত্ত্বের হিসাব নয়– কোটা সংস্কারের নামে পাঁচ শতাংশ কোটা কমিয়ে এক শতাংশ করে আদালত যে রায় দিয়েছেন, তা আদিবাসীদের জন্য মানবিক, ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত হয়নি বলে আমরা মনে করছি। বরং কোটা হ্রাস হওয়ার কারণে ভেঙে গেছে আদিবাসীদের উঠে আসার সিঁড়ি। আদিবাসীদের কোটা হ্রাস করার ফলে টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের মাধ্যমে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি দারিদ্র্য ও অসমতা হ্রাস করে জনগণের বিশেষ করে প্রান্তিক ও অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর জীবনমানের গুণগত পরিবর্তনের যে ঘোষণা সেটা অসম্ভবই থেকে যাচ্ছে। এতে করে অসমতা সৃষ্টি হবে এবং যারা অনগ্রসর তথা আদিবাসীরা আরো পিছিয়ে পড়বে। আদিবাসীদের পাঁচ শতাংশ কোটা হ্রাস হওয়ার কারণে স্মার্ট বাংলাদেশের যে ভিশন এবং টেকসই উন্নয়নের যে লক্ষ্যমাত্রা অর্থাৎ সমতা, ন্যায্যতা, দক্ষতাভিত্তিক এবং অন্তর্ভুক্ততিমূলক ও প্রতিনিধিত্বমূলক সমাজ গঠনে আদিবাসীরা পিছিয়ে পড়বে বলে আমরা মনে করছি। তাই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কোটা হ্রাস করা এখনই উপযুক্ত সময় নয় বরং বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ও উন্নয়ন থেকে বঞ্চিতদের তথা আদিবাসী জাতিসমূহকে সমতায় নিয়ে আসতে আরো সকল প্রকার চাকরিতে কোটা বৃদ্ধিসহ আদিবাসী এলাকাগুলোতে মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং পর্যাপ্ত যোগ্য শিক্ষক বৃদ্ধি করার প্রয়োজন বলে মনে করছি। কোটাকে আমরা দান কিংবা করুণা হিসেবে চাইছি না। এ রাষ্ট্রে আমরা আদিবাসীরা বরাবরই বৈষম্যের শিকার, তাই এই বৈষম্য দূর করে সাংবিধানিক সমতায় নিয়ে আসার যে দায়বদ্ধতা, সেখানে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে তুলে আনার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাই সরকারি চাকরিতে পিছিয়ে পড়া আদিবাসীদের জন্য যে পাঁচ শতাংশ কোটা ২০১৮ সালের আগে ছিল, তা পুনর্বহালের দাবি জানাচ্ছি।
আদিবাসীদের সংরক্ষিত কোটা উপেক্ষার প্রতিবাদ
তবু আদিবাসী কোটায় চাকরি হল না মুণ্ডা মেয়েটির
মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরির বয়স নেই, দয়া করে আদালত শুনবেন: মন্ত্রী মোজাম্মেল