গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর দ্রুত সময়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরানোর প্রত্যাশা ছিল ফ্যাসিবিরোধী রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের। গত ৫ আগস্ট হাসিনার পতনের বর্ষপূর্তিতে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। এই ধারাবাহিকতায় বহুল প্রত্যাশিত এই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবনে এ রোডম্যাপ ঘোষণা করেন নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ। তিনি জানান, নির্বাচনের তফসিল ডিসেম্বরের শুরুতে ঘোষণা করার পরিকল্পনা করেছে নির্বাচন কমিশন। এই রোডম্যাপ ২৪টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। নির্বাচন আয়োজনের সর্বশেষ কাজের সময়সীমা দেয়া হয়েছে আগামী বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি। এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের সকল কার্যক্রম চূড়ান্তভাবে স¤পন্ন করা হবে। রোডম্যাপ অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে (রোজার আগে) ভোটগ্রহণের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সংলাপ, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়, মিটিং, ব্রিফিং, প্রশিক্ষণ, মুদ্রণ, বাজেট বরাদ্দ, আইটিভিত্তিক প্রস্তুতি, প্রচারণা, সমন্বয় সেল, আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক থেকে যাবতীয় কর্মস¤পাদনা পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নসূচি রয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার মধ্য দিয়ে বলা যায়, নির্বাচনী যাত্রার আরো এক ধাপ অগ্রগতি হলো। বলা বাহুল্য, নির্বাচন জাতির প্রধান কাম্য হলেও নির্বাচনের সময় নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক মহলে মতভিন্নতা ছিল। সংস্কার, বিচার ইত্যাদির প্রসঙ্গ টেনে একদিকে সরকারের একটি অংশ যেমন বিলম্বে নির্বাচন হওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, তেমনি কিছু রাজনৈতিক দলও অনুরূপ অবস্থান নিয়েছিল। বিএনপি যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিল। তার সমমনা দলগুলো বিএনপির অবস্থানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। নির্বাচন নিয়ে এই দ্বিমুখী অবস্থানের প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে লন্ডনে যে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। এরপরও নির্বাচন নিয়ে নানা ধোঁয়াশা তৈরি হয়। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূস গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রতি অনড় থাকেন। ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণের পরও তিনি নানা উপলক্ষে নির্বাচন প্রশ্নে তার দৃঢ়তা প্রদর্শন করেছেন। নির্বাচন কমিশন তার নির্দেশনা অনুসারে নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পন্ন করার পদক্ষেপ নেয়। নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা সেইসব পদক্ষেপের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্ববহ। আমরা এ প্রেক্ষিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস, অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। নির্বাচন বিলম্বিত হোক বা অনির্দিষ্ট কাল ঝুলে থাক, এমন মনোভাব যারা পোষণ করে, নির্বাচনী ট্রেনের যাত্রা শুরু হওয়াতে তাদের হতাশ হওয়া স্বাভাবিক। এতে দেশের মানুষের করার কিছু নেই। নির্বাচনের বিরুদ্ধে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রও আছে। পতিত স্বৈরাচার ও তার প্রভূদেশ ভারত নির্বাচনের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্রজাল বিস্তার করে যাচ্ছে। দিল্লিতে বসে হাসিনা অরাজকতা সৃষ্টি করে নির্বাচন বানচাল করার পরিকল্পনা করছেন, এমন খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকার রাজনৈতিক দলসমূহকে সতর্ক ও সাবধান হতে হবে।

নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আমরা আশ্বস্থবোধ করছি যে, নির্বাচন কমিশন আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের জন্য এগিয়ে যাচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি রোডম্যাপে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। জামায়াতে ইসলামী তার প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছে, এই রোডম্যাপ গতানুগতিক ও কিছুটা বিভ্রান্তিমূলক। কোনো পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। এমনকি জুলাই সনদের আইনী ভিত্তি প্রদান ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়নি। এ অবস্থায় এই রোডম্যাপ অপরিপক্ব ও আংশিক। এনসিপির পক্ষে বলা হয়েছে, জুলাই সনদের আইনী ও সাংবিধানিক ভিত্তি নিশ্চিত না করে নির্বাচনের দিকে যাওয়াটা সরকারের আগের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের শামিল। ইসলামী আন্দোলনের অভিমত জাময়াতে ইসলামীর অনুরূপ। অন্যদিকে গণসংহতি আন্দোলন রোডম্যাপকে স্বাগত ও এবি পার্টি ইতিবাচক বলে অভিহিত করেছে। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, বিগত তিনটি নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি। ভোটের নামে প্রহসন হয়েছে। এতদিন বাদে অবাধে ভোট দেওয়ার একটা নির্বাচন এসেছে। রোডম্যাপ ঘোষণার পর দেশে নির্বাচনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এমতাবস্থায়, নির্বাচন নিয়ে নেতিবাচক কথা বলা মানুষের পছন্দ নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, নির্বাচনবিমুখ তারাই হতে পারে, নির্বাচনে যাদের পাওয়ার তেমন কিছু নেই। যারা নির্বাচন ছাড়াই ক্ষমতা উপভোগ করছে, তাদের নির্বাচনের প্রতি অনীহ হওয়া তো খুবই স্বাভাবিক। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচারণায় কিংবা প্রশ্নবিদ্ধ জরিপে যারা ক্ষমতার দোড়গোড়ায় পৌঁছে গেছে বলে মনে করতো, নির্বাচনের দিন যত এগিয়ে আসছে তারা ততই হতাশ হচ্ছে, প্রমাদ গুণছে। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন নির্বাচনের পদ্ধতি ঠিক না হওয়া নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছে, তার কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। সংবিধানে তাদের দাবি, পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের কোনো বিধান নেই। নির্বাচন কমিশনের তরফেই সেটা জানিয়ে দেয়া হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপি জুলাই সনদের আইনী ভিত্তি ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে যে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে, তার প্রেক্ষিতে পর্যবেক্ষকদের অভিমত হলো, জুলাই সনদ তো এখনো ঘোষণাই করা হয়নি। জুলাই সনদের আইনী ভিত্তি ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা চলমান। একটা সিদ্ধান্ত তো আসবেই। এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সে জন্য নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন আটকে থাকতে পারে না।

যারা ঘোষিত রোডম্যাপে সন্তোষ প্রকাশ করতে পারেনি, তাদের প্রকৃত বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে। যেখানে সরকার দৃঢ়, নির্বাচন কমিশন প্রস্তুত, দেশের মানুষ অধীর অপেক্ষায় রত, সেখানে নির্বাচন নিয়ে এতটুকু নেতিবাচক মনোভাব দেখানো ঠিক নয়। অচিরেই দেশে একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসছে, এই আশাবাদ বিভিন্ন ক্ষেত্রে শুভ পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। শেয়ারবাজারে তেজিভাব সৃষ্টির আভাস পাওয়া যাচ্ছে, বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীরা উল্লাস প্রকাশ করছেন এই ভেবে যে, তাদের সুদিন আসছে। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে দেশি বিনিয়োগই বাড়বে না, বিদেশি বিনিয়োগও বাড়বে। মোটা অংকের বিদেশি বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি এসেছে, যার বাস্তবায়ন দ্রুতায়িত হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে নির্বাচনের পক্ষে অভিমত আসছে। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা চাইছে, নির্বাচন ও গণতন্ত্রায়ন তরান্বিত হোক। এসব দিকের বিবেচনায় যত তাড়াতাড়ি নির্বাচন হয়, দেশের জন্য ততই মঙ্গল। বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা থাকতেই পারে এবং এটা অস্বাভাবিক নয়। মতভিন্নতা গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তবে জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে রাজনৈতিক ঐকমত্যের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। এখন জাতির প্রধান স্বার্থ ও লক্ষ্য নির্বাচন। এই স্বার্থ ও লক্ষ্যের বাস্তবায়ন সব রাজনৈতিক দলকে একমত হয়েই করতে হবে। যেসব দল দ্বিধায় আছে, অমতে আছে, আমরা আশা করবো, তারা অবিলম্বে নির্বাচনী যাত্রায় শামিল হয়ে যাবে।



Contact
reader@banginews.com

Bangi News app আপনাকে দিবে এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা যা আপনি কাগজের সংবাদপত্রে পাবেন না। আপনি শুধু খবর পড়বেন তাই নয়, আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগও করবেন। বিশ্বাস না হলে আজই ডাউনলোড করুন। এটি সম্পূর্ণ ফ্রি।

Follow @banginews